'আমলাতান্ত্রিক আইসিসি'র ওপর রাগ পাকিস্তানের

সরফরাজ আহমেদ বর্ণবাদী আচরণ করে চার ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছেন। ফাইল ছবি
সরফরাজ আহমেদ বর্ণবাদী আচরণ করে চার ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছেন। ফাইল ছবি

সরফরাজ আহমেদের শাস্তি নিয়ে আইসিসির ওপর রাগ কমছেই না পাকিস্তানের। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) এর আগেই নিজেদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছিল। তখন সংবাদমাধ্যমে কিছু না বললেও এবার পিসিবি সভাপতি এহসান মানি বেশ তীব্রভাবেই আইসিসির সমালোচনা করেছেন। আইসিসির এই সিদ্ধান্তে ‘সাধারণ বিচারবুদ্ধি’র চেয়ে ‘আমলাতন্ত্র’ বা ‘কাগুজে নিয়মকানুন’ আইসিসিকে বেশি প্রভাবিত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন মানি।

এহসান মানি নিজেও আইসিসির সভাপতি ছিলেন। ইমরান খান সরকারে আসার পর পিসিবি প্রধানের দায়িত্ব নেওয়া মানি প্রথম বড় বিতর্কের মুখে পড়লেন এই ঘটনাতেই। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তান অধিনায়ক সরফরাজ বর্ণবাদী মন্তব্য করে চার ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছেন। দেশেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে তাঁকে। পিসিবি মনে করে, ঝামেলা মাঠের বাইরেই মিটিয়ে ফেলার পরও আইসিসির শাস্তি দেওয়াটা বাড়াবাড়ি। বিশেষ করে কেবল আইসিসির বর্ণবাদ-বিরোধী বিধির একটি শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন হয়নি বলেই শাস্তি হয়েছে বলে মনে করে পিসিবি।

সরফরাজ যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতে শুধু বর্ণবাদ নয়, প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারের মাকে অসম্মান করার অপরাধও হয়। ফলে আইসিসির দেওয়া চার ম্যাচের শাস্তি অনেকের কাছেই যথার্থ মনে হয়েছিল। যদিও এর আগে পিসিবি তাদের হতাশা প্রকাশ করে প্রকাশ্যে। এখন মানি বলছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আইসিসি বেশি করে নিয়মকানুন দেখেছে। আইসিসি যে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করত, পিসিবির উদ্যোগে এর চেয়ে বেশিই করা হয়েছিল। কিন্তু আইসিসি তা বিবেচনায় নেয়নি।

ওই ঘটনার পর সরফরাজ একাধিকবার প্রকাশ্যে ক্ষমা চান। তাঁর বর্ণবাদী মন্তব্যের শিকার হওয়া ব্যাটসম্যান আন্দিলে ফিকোয়াওর কাছে ক্ষমা চেয়ে হাত মিলিয়ে ছবিও তুলেছেন সরফরাজ। দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি সরফরাজকে ক্ষমা করে দেন। এই ঘটনায় শুরু থেকে চুপ থাকলেও আকস্মিকভাবে আইসিসি চার ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়। এ নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল। কারণ আইসিসির নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসার আগেই পিসিবি সরফরাজকে সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডেতে একাদশের বাইরে রাখে।

এখন মানি দাবি করছেন, শুধু এক ম্যাচ নয়, তাঁরা নিজেরাই বাকিদের সতর্কবার্তা দিতে সরফরাজকে দুই-তিন ম্যাচ নিষিদ্ধের কথা ভাবছিলেন। পাকিস্তান নিজেরাই এত উদ্যোগ নেওয়ার পর আইসিসি কেন শাস্তি দিল, সেটার ব্যাখ্যা পাচ্ছেন না মানি, ‘আমাদের বক্তব্য হলো, ক্ষমা চাওয়া হয়েছিল, সেটা গৃহীতও হয়েছিল। এরপর একমাত্র প্রশ্ন হতে পারে, সরফরাজের শাস্তিটা পাওনা ছিল কি না। আমি তো আগেই বলেছি, সরফরাজকে ২-৩ ম্যাচের জন্য বসিয়ে রাখা উচিত ছিল। আমি এটা খুব করে চেয়েছিলাম, যেন বাকিদের কাছে একটা শক্তিশালী বার্তা যায়।’

আইসিসি সরফরাজের শাস্তি ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় ফিকোয়াওকে রাখতে চেয়েছিল। সরফরাজকে যে শিক্ষামূলক কর্মসূচিতে অংশ নিতে হবে, আইসিসির বর্ণবাদী বিধি অনুযায়ী ফিকোয়াওয়ের তাতে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তবে ফিকোয়াও আবার সরফরাজের সঙ্গে এককক্ষে বসে হাত মিলিয়ে বিষয়টি সেখানে মিটমাট করতে আগ্রহী ছিলেন না। আইসিসির বিধিতে আছে, এই এক রুমে বসে মধ্যস্থতার বিষয়টি সুরাহা করতে হবে আইসিসির কোনো প্রতিনিধিকে।

কেবল এই নিয়মটি ঠিকমতো মানা হয়নি বলেই সরফরাজ শাস্তি পেয়েছেন বলে দাবি করলেন মানি, ‘আমরা সব মিটিয়েই ফেলেছিলাম। তাই সাধারণ বিচারবুদ্ধি বলে, ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে গেলে ভালো হতো। আমরা সব পর্যায়েই ক্ষমা চেয়েছিলাম, সবাই ক্ষমা করেও দিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও ভালো। কিন্তু ফিকোয়াও মর্মাহত, আর সে সমাধান প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আগ্রহী না বুঝে আইসিসি হুট করে বিষয়টিতে ঢুকে পড়ে সরফরাজকে শাস্তি দিল। আমার মতে এটা কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। দুজনকে একই কক্ষে (আবার) বসালে আর কীই-বা হতো? তারা তো আর স্কুলে পড়ে না।’

আইসিসি অবশ্য মনে করে, বর্ণবাদী ঘটনা এতটাই গুরুতর ছিল, এখানে হস্তক্ষেপ করতেই হতো। দুই বোর্ড নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নিলেই হবে না, আইসিসির নিয়ম অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। এতে করে আইসিসি সবার কাছে এই বার্তা দিতে চেয়েছে, কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের ঘটনায় সামান্য ছাড়ও আইসিসি দেবে না।

আবার পিসিবির বক্তব্য, আইসিসি যদি শাস্তি দেবেই, তাহলে এত দেরি করল কেন? মঙ্গলবার ঘটনা ঘটেছে, আইসিসি সরফরাজকে শাস্তি দিয়েছে শনিবার রাতে। এর আগে বিবৃতিও দেয়নি। সরফরাজ যে শাস্তি পেয়েছেন, এটা প্রথম জানিয়েছেন ডু প্লেসি, এমনকি পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক শোয়েব মালিকও বিষয়টি জানতেন না পরিষ্কারভাবে। চতুর্থ ওয়ানডেতে টস হয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পরে আইসিসির বিবৃতি আসে।

মানি বলছেন, ‘আমার এখানেই আপত্তি। তারা বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছিল। আমাদের বিবৃতি আর ক্ষমা চাওয়া তো ততক্ষণে সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। এটা এমন একটা ঘটনা, এ নিয়ে লুকোছাপা করার কিছু নেই। এটা নিয়ে আপনাকে পরিষ্কার ও দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে হবে। আমরা এর সবই করেছিলাম। কিন্তু আইসিসি যেহেতু দুজন খেলোয়াড়কে এক কক্ষে ডেকে নিতে পারল না, শুধু এ কারণেই তারা সরফরাজকে শাস্তিটা দিয়ে দিল। আমার কাছে এটাই স্রেফ কাণ্ডজ্ঞানহীন কাণ্ড। এতটা আমলাতান্ত্রিকতা কেন? একজন আইসিসির মধ্যস্থতাকারীর সামনে এই দুজন এক কক্ষে বসে হাত মেলায়নি বলেই আপনাকে হুবহু বইয়ের নিয়ম মেনে চলতে হবে? আমাদের আইসিসির কোনো সমঝোতাকারীর দরকার নেই। আমরা এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থান এ জন্যই নিয়েছি, কাগুজে নিয়মকানুনের কাছে কোনো না কোনোভাবে সাধারণ বিচারবুদ্ধি পরাজিত হয়েছে।’

কোনোভাবেই পিসিবি সরফরাজের অপরাধকে খাটো করে দেখছে না, বা তাঁর পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে না বলেও দাবি করেন মানি। তিনি বরং মনে করেন, সরফরাজের মন্তব্য খুবই বাজে ছিল। দুটি কারণে এটি আরও বাজে। প্রথমত দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের কারণেই বর্ণবাদী মন্তব্য খুবই স্পর্শকাতর। দ্বিতীয়ত, মন্তব্যটি খোদ একটি দলের অধিনায়ক করেছেন। মানি বলেছেন, সরফরাজকে ভবিষ্যতের জন্য কড়া সতর্কবার্তা দেওয়া হবে, বাকিদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করা হবে। তবে তাঁর বক্তব্য, সংস্কৃতিগত পার্থক্যের কারণেও এমনটা ঘটেছে, ‌‘আসলে এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক একটা ব্যাপারও জড়িয়ে আছে। ও যে শব্দটা বলেছে, পাকিস্তানে হলে কেউ হয়তো গায়ে মাখত না। আমি বলছি না পাকিস্তানের সংস্কৃতিতেও এমনটা বলা ঠিক। তবে ও যেভাবে কথাটা বলেছে, তাতে কিন্তু কারও প্রতি তীব্র বিদ্বেষ বা ক্ষোভজনিত কিছু ছিল না।’