আফরানের মা, ঘুম থেকে উঠে দেখ...

আগামী ৯ মার্চ কম্বোডিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জন্য ২৭ সদস্যের প্রাথমিক জাতীয় দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। তালিকায় জায়গা পেয়েছেন সোহেল রানা।
স্ত্রী ঝুমা খাতুন ও একমাত্র ছেলে আফরানের সঙ্গে সোহেল রানা। ছবিটি এখন শুধুই স্মৃতি। সংগৃহীত ছবি
স্ত্রী ঝুমা খাতুন ও একমাত্র ছেলে আফরানের সঙ্গে সোহেল রানা। ছবিটি এখন শুধুই স্মৃতি। সংগৃহীত ছবি

স্বামী ফুটবল খেলতে মাঠে গেলেই জায়নামাজে বসতেন তাসলিমা আফরিন ঝুমা। দুই হাত তুলে দোয়া করতেন তিনি যেন ভালো খেলে সুস্থ শরীর নিয়ে ফিরতে পারেন বাসায়। আল্লাহর কাছে রাখতেন একটা ফরিয়াদও, ‘আফরানের বাবা যেন জাতীয় দলে ডাক পায়।’

‘বাবা ভু. . বাবা ভুহহহ...’ বাবার কোলে চড়ে এভাবেই কল্পিত গাড়ি চালাত দুই বছরের ছেলে আবদুল্লাহ আফরান। বাবার বুট, জার্সি-প্যান্ট নিয়ে খেলা করতেও পছন্দ ছিল সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুটির। একমাত্র ছেলের মনের আনন্দের উপলক্ষগুলো খুব সহজেই বুঝতে পারতেন বাবা। মাঠে নামার আগে বুকের ধন ছেলের সঙ্গে কথা না বললে চলত না তাঁর।

আফরানের মায়ের ডাক শুনেছেন সৃষ্টিকর্তা। প্রথমবারের মতো জাতীয় ফুটবল দলে ডাক পেয়েছেন আফরানের বাবা সোহেল রানা। কম্বোডিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জন্য ২৭ সদস্যের প্রাথমিক দলে আছে সোহেলের নাম। বিশ্বস্ত সূত্রমতে তাঁর চূড়ান্ত দলে থাকাটাও প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু আজ পৃথিবীতে নেই আফরান ও তার মা। প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পেয়েও তাই সোহেলের মনে আনন্দের উল্টো পিঠের কষ্টের বিউগলের সুরটাই বাজছে বেশি। প্রিয়তমা স্ত্রী শুনতে পারল না স্বামীর জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার সুসংবাদ। ছেলে আফরান দেখতে পারল না জাতীয় দলের জার্সিতে বাবাকে। আনন্দটা ভাগ করবেন কাদের সঙ্গে—এ কষ্টটা শেল হয়ে বিঁধছে সোহেলের বুকে।

বারবার আঘাত হানছে একটি প্রশ্ন—‘আফরানের বাবা তুমি কবে জাতীয় দলে খেলবা?’ প্রশ্নটি প্রায়ই সোহেলকে করতেন তাঁর স্ত্রী। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় কণ্ঠটা থেমে গেছে চিরতরে। সে দুর্ঘটনাতেই ছেলেকে হারিয়েছেন সোহেল। প্রশ্নটা তোলা বা উত্তর শোনার আর কেউ নেই। সে তো আগেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। নইলে বাসায় থাকত উৎসব। হাতে হাত রেখে কত কথা, শত শত সুখ-দুঃখ বিনিময় করে নেওয়া। সেসব স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টেই সোহেল অভিমানী নালিশ জানাবে ‘বেইমান’ ভাগ্যের কাছে। তাই আজ নিজেই বারবার প্রশ্ন তুলছেন, ‘আমি কাকে দেব জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার সুসংবাদ?’

২৪ নভেম্বর ২০১৮, সোহেলের জীবনের সবচেয়ে কালো দিন। ফেডারেশন কাপের ছুটি শেষ করে স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে মোটরসাইকেলে চেপে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকার বসুন্ধরার বাসায় ফিরছিলেন শেখ রাসেলের এই মিডফিল্ডার। পথিমধ্যে সাভার নবীনগরের নয়ারহাটের রাস্তায় ঘটল ভয়ানক দুর্ঘটনা। চোখের সামনে ট্রাকের চাকার তলে পিষ্ট হন প্রিয়তমা স্ত্রী ও বুকের ধন ছেলেটা।

পারিবারিক আয়োজনে সোহেল ও ঝুমার প্রেমের বিয়ে ২০১৪ সালের পয়লা মে। পরের বছর ১৫ ডিসেম্বর তাঁদের কোলজুড়ে আসে আফরান। সামনে অপেক্ষা করছিল অনাবিল সুখের সম্ভাবনা। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে মাঝরাতে কখনো কখনো ‘আফরানের মা’ বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম ভাঙে সোহেলের, ‘আফরানের মার কোনো চাওয়া ছিল না। আমার ভালোই ছিল ওর সুখ। আমাকে শুধু খেলায় মনোযোগ দিতে বলত। আর বলত, আফরানের বাবা তুমি জাতীয় দলে খেলবা না!’

দুর্ঘটনার পর হাসপাতালের বিছানায় সব হারানোর শোকে ভেঙে পড়েছেন সোহেল। সংগৃহীত ছবি
দুর্ঘটনার পর হাসপাতালের বিছানায় সব হারানোর শোকে ভেঙে পড়েছেন সোহেল। সংগৃহীত ছবি

মানুষটা না থাকলেও অলক্ষ্যে এই কথাটি দিয়ে মাঠে তাতিয়ে দিয়েছেন শোকার্ত স্বামীকে। সোহেলের অন্তরে ঘণ্টা বাজিয়ে জানান দিত পূরণ করতে হবে প্রিয়তমা স্ত্রীর স্বপ্ন। দুই চোখের ‘মণি’কে হারিয়ে গায়ে শোকের চাদর থাকলেও সোহেল ছিলেন স্ত্রীর স্বপ্নপূরণে মরিয়া। জীবনসঙ্গীর প্রতি এই ভালোবাসাটুকই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নতুন করে বাঁচার। চার বছর আগে অনূর্ধ্ব-২২ দলের প্রতিনিধিত্ব করা সোহেল এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার মাধ্যমে গড়তে চেয়েছেন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার সৌধ।

স্ত্রী হারানোর শোক বুকে নিয়ে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়ে শেখ রাসেলের জার্সিতে প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেনও দুর্দান্ত। যা নজর এড়ানোর কোনো সুযোগই ছিল না কোচ জেমি ডের। ব্রাদার্সের বিপক্ষে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচটাই মূলত সোহেলকে খুলে দিয়েছে জাতীয় দলের দরজা। ৩-২ গোলে দলের জয়ের ম্যাচে চোয়ালবদ্ধ সোহেল সেদিন কি না করেছেন! মধ্যমাঠে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সতীর্থ ফরোয়ার্ডদের পায়ে জুগিয়েছেন বল। সে তো সব মিডফিল্ডারই করে থাকেন! কিন্তু সোহেলের প্রতিটা পদক্ষেপ ও বলের স্পর্শে যেন প্রতিজ্ঞা, ‘প্রিয়তমা স্ত্রী তোমার জন্য হলেও ছিনিয়ে আনব জাতীয় দলের টিকিট।’ জার্সিটা গায়ে চাপানোর সময় সোহেলের মনে হয়েছে, স্ত্রী যেন পাশ থেকে বলছে, ‘ভালো করে খেলো আফরানের বাবা।’ ভালো খেলেছেন বলেই তো প্রথমবারের মতো পেয়েছেন জাতীয় দলে ডাক।

কিন্তু কাকে দেবেন সুসংবাদটি। তিন দিন আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে খবরটি শোনার পর সোহেলের ভাবনাতে এসেছে এই প্রশ্ন, ‘খবরটা শোনার পর সবার আগে আফরানের মা ও বাবুর কথা মনে পড়ছে। মানুষটি শুনে যেতে পারল না আমার জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবরটি। আনন্দের সময়ে ওরা নেই। ওদের অভাবটা খুব বোধ করছি।’ সোহেল বিশ্বাস করেন কোনো দূরলোক থেকে নিশ্চয়ই আফরান ও তার মা পাশাপাশি বসে দেখছেন তাঁকে।

তবু নিশ্চিত করতে গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবেন। প্রিয় মানুষের শেষ ঠিকানার পাশে চুপটি করে বসবেন। জমে ওঠা আবেগ আর কান্না সামলে তারপর বলবেন, ‘আফরানের মা ঘুম ভেঙে দেখ, আফরানের বাবা জাতীয় দলে ডাক পেয়েছে।’