৫০ বছর আগের ভাগাড় এখন মুগ্ধতা ছড়ানো বাগান

হ্যামিল্টন গার্ডেনসে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গেও দেখা হলো। ছবি: লেখক
হ্যামিল্টন গার্ডেনসে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গেও দেখা হলো। ছবি: লেখক

‘গোবরে পদ্মফুল’ উপমাটা এখানে খুব খেটে যাচ্ছে। ৫০ বছর আগেও যেটি ছিল পরিত্যক্ত এক ভূমি, হ্যামিল্টন শহরের ময়লা ফেলার ভাগাড়, সেখানেই এখন কী অপূর্ব এক বাগান! নাম যেহেতু ‘হ্যামিল্টন গার্ডেনস্’, আক্ষরিক অর্থে ‘বাগান’-ই বলতে হয়। তবে প্রচলিত অর্থে বাগান বলতে যা বোঝায়, এটি তা নয়। পার্কও নয়। বোটানিক্যাল গার্ডেন যে নয়, সেটি তো হ্যামিল্টন গার্ডেনসের পরিচিতিতেই লেখা আছে।

তাহলে এটি কী? এত দিনে আজ সেটি জানার সুযোগ হলো। ‘এত দিনে’ বলছি, কারণ এখানে যেতে যে প্রায় ১৮ বছর লেগে গেল! এই হ্যামিল্টনের প্রায় সবকিছুই আমার চেনা বা দেখা। আগের ডায়েরিতেই লিখেছি, নিউজিল্যান্ডে আমার সবচেয়ে পরিচিত শহর এই হ্যামিল্টন। দেড় যুগেরও বেশি আগে নিউজিল্যান্ডে প্রথম এসে অকল্যান্ড ছুঁয়ে এই শহরেই এক সপ্তাহ ছিলাম। এরপর আরও তিনবার এসেছি। সর্বশেষ ২০১৫ বিশ্বকাপে। বারবার আসার কারণে এই শহরের অনেক কিছুকেই খুব আপন বলে মনে হয়। এই শহরের প্রতীক ওয়াইকাটো নদীকেও যেমন। এর একটা বড় কারণ হয়তো প্রতিবারই যে হোটেলে থেকেছি, সেটি এই ওয়াইকাটো নদীর তীরেই দাঁড়িয়ে। নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরিদের আদি নিবাস ছিল এই হ্যামিল্টনেই। গতকাল মাওরি ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্নে সাজানো সেই জাদুঘর আবারও ঘুরে এলাম। গাড়িতে হ্যামিল্টন থেকে আধঘণ্টা দূরত্বের যে ভেড়ার খামারটায় লর্ড অব দ্য রিংস সিনেমার সেট করা হয়েছিল, পর্যটকদের অবশ্য দ্রষ্টব্যের তালিকায় ঢুকে যাওয়া সেই হবিটনও দেখে এসেছি আগেই। অথচ বার দু-এক প্ল্যান করেও এই হ্যামিল্টন গার্ডেনসেই কেন যেন যাওয়া হয়নি!

বাহারি ফুল আর গাছের সমারোহ হ্যামিল্টন গার্ডেনসে । ছবি: লেখক
বাহারি ফুল আর গাছের সমারোহ হ্যামিল্টন গার্ডেনসে । ছবি: লেখক

ক্রাইস্টচার্চ প্রবাসী বাংলাদেশি এক তরুণ এতবার হ্যামিল্টনে এসেছি আর হ্যামিল্টন গার্ডেনসে যাইনি শুনে যারপরনাই অবাক। বারবার বলে দিয়েছেন, এবার যেন এই ভুল আর না করি। এবার তাই একটা প্রতিজ্ঞামতোই করে ফেলেছিলাম, বাকি সব তো মোটামুটি দেখেছিই, এবার হ্যামিল্টন গার্ডেনসে একটা চক্কর দিতেই হবে।
টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়ে গেলে আর সময় পাওয়া যাবে না। আজই ছিল শেষ সুযোগ। সেটি কাজে লাগাতে পারায় অবশ্য ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসামের বড় ভূমিকা। নিউজিল্যান্ডে এর আগে একবার ঘুরে গেলেও হ্যামিল্টনে ওর এবারই প্রথম। কথায় কথায় ওকে হ্যামিল্টন গার্ডেনস্ সম্পর্কে যা শুনেছি আর পড়েছি, সেসব জানিয়ে বলেছিলাম, ‘এবার হ্যামিল্টন গার্ডেনসটা দেখতেই হবে।’ শোনার পর থেকেই ওর প্রবল উৎসাহ। আজ দুপুরে সেডন পার্কে দুই দলের অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলন শেষেই ইসাম তাগাদা দিতে শুরু করল, ‘চলেন যাই, আজকেই সুযোগ। ঘুরে আসি।’ ইসাম আসার পর থেকে লেখার বাইরে সময়টা খুব ভালো কাটছে। যেকোনো ট্যুরে আসার পর থেকেই আমার নিয়মিত অভ্যাস ‘দেশে ফিরতে আর কত দিন’—সেই দিন গোনাটাও একটু কমেছে। রাজীব হাসানেরও কৃতিত্ব আছে এখানে। প্রথম আলোতে আমার সহকর্মী নিউজিল্যান্ডে কয়েক দিনের জন্য ঘুরতে এসেছে। হ্যামিল্টন ওর সফরসূচিতে ছিল না। ওর অকল্যান্ডে থাকার পরিকল্পনা শুনে আমি বললাম, ‘এত কাছে এসে নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের একটা টেস্ট ম্যাচ দেখার সুযোগ নষ্ট করবি কেন? হ্যামিল্টনে চলে আয়।’ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে হ্যামিল্টনে তিন দিনের জন্য রাজীব আমার রুমমেট। সময়টা খুব ভালো কাটছে। ‘হোম সিকনেস’ অনেকটাই দৌড়ে পালিয়েছে।

ছবির মতো সাজানো হ্যামিল্টন গার্ডেনস। ছবি: লেখক
ছবির মতো সাজানো হ্যামিল্টন গার্ডেনস। ছবি: লেখক

তিনজন মিলে কাল ভর দুপুরে তাই হ্যামিল্টন গার্ডেনসে। দুপুর বলতে শুধু সময়টার কথা বলছি না, রোদে ঝলমল সত্যিকার দুপুর বলতে যা বোঝায়, তেমন দুপুর। ক্রাইস্টচার্চে শেষ দুদিন বৃষ্টি আর ঠান্ডায় এমন বিরক্ত হয়ে ছিলাম যে, হ্যামিল্টনে আসার পর মনে হচ্ছে, স্বর্গে এসেছি। এখন পর্যন্ত প্রতিটি দিনই সকাল-সন্ধ্যা নিরবচ্ছিন্ন সোনালি রোদে রাঙানো। সন্ধ্যার দিকে গায়ে হালকা জ্যাকেট চড়াতে হচ্ছে। দিনের বেলায় সেটি তো লাগছেই না, দিব্যি টি শার্ট পরে ঘুরে বেড়ানো যাচ্ছে। শহর থেকে গাড়িতে মিনিট দশেক দূরত্বের হ্যামিল্টন গার্ডেনসে গিয়ে প্রথম চমকটা ঢোকার আগেই। এত নামধাম শুনেছি, এন্ট্রি ফি না জানি কত হয়! ঢোকার আগে টিকিট কেনার কাউন্টার খুঁজতে শুরু করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কার করলাম, এই গার্ডেনসে প্রবেশের দ্বার সবার জন্য অবারিত। একটা ডোনেশন বক্স আছে। কারও ইচ্ছা হলে সেটিতে কিছু দেবে, না হলে নাই। গার্ডেনটাকে ঘুরে এমন মুগ্ধ হলাম যে, আমারও কিছু দিতে ইচ্ছা করল। নিউজিল্যান্ড ডলারের সঙ্গে বাংলাদেশি টাকার বিনিময় হার চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত যে তা আর দিইনি, সেটি স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।
হ্যামিল্টন গার্ডেনস্ নিয়ে লিখতে বসে রাজ্যের প্যাঁচাল পেড়ে যাচ্ছি, আসল জিনিসটা নিয়ে কিছু লেখাই হচ্ছে না। আসলে লিখে বোঝানো একটু কঠিন বলেই হয়তো অবচেতন মন এদিক-ওদিকে বেশি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপরও সংক্ষেপে একটু হ্যামিল্টন গার্ডেনসের বিশেষত্বটা বলি। বাগান যখন, ফুল তো থাকবেই। গোলাপ, রডোডেনড্রন, ক্যামেলিয়া ফুটে আছে চারপাশে। আরও কত নাম না জানা ফুল, সেসবের হিসাব নেই। তবে ‘ফুল’ হ্যামিল্টন গার্ডেনসের মূল দ্রষ্টব্য নয়। যেখানে এটি আলাদা, তা হলো বিভিন্ন থিমে ভাগ করা এর বিভিন্ন অংশ। উপমহাদেশ থেকে এসেছি বলে ‘ইন্ডিয়ান চার বাগ গার্ডেন’টাই প্রথম চোখ কাড়ল। এর বাইরে যেগুলোর কথা মনে পড়ছে, তা হলো—জাপানিজ গার্ডেন অব কনটেমপ্লেশন, চাইনিজ স্কলার গার্ডেন, মর্ডানিস্ট গার্ডেন, ইতালিয়ান রেনেসাঁ গার্ডেন...। প্রতিটি অংশ আলাদা এবং একটা ফলকে সেটির বৈশিষ্ট্য লেখা। আমেরিকান রীতিতে সাজানো মর্ডানিস্ট গার্ডেন যে সত্যিই ‘মডার্ন’, সেটা বোঝাতেই হয়তো সেটিতে মেরিলিন মনরোর বড় একটা পোর্ট্রেটও আছে। উড়ে যেতে বসা স্কার্ট সামলানোর বিখ্যাত সেই ছবিটা নয়, মনরো এখানে কাঁধ পর্যন্তই শেষ।

হ্যামিল্টন গার্ডেনসে মেরিলিন মনরোর পোট্রেট । ছবি: লেখক
হ্যামিল্টন গার্ডেনসে মেরিলিন মনরোর পোট্রেট । ছবি: লেখক

আমাদের তিনজনেরই সবচেয়ে বেশি পছন্দ হলো ইতালিয়ান গার্ডেনটা। সামনে সবুজ ঘাসের লনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুলের বাগান। পেছনে একটা সুরম্য ভিলা। সেটিতে ঢুকে পেছনের রেলিং দেওয়া টানা বারান্দাতে দাঁড়াতেই দেখি, পাশেই বয়ে চলেছে ওয়াইকাটো নদী। নদীর ওপারে ঘন গাছপালা। নদীর কূল কূল ধ্বনি আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ—আর কোনো শব্দ নেই। এই কোলাহল আর হানাহানিময় পৃথিবী থেকে যেন আলাদা কোনো জগৎ। চারপাশে যেন শান্তির সুবাতাস বইছে।
হ্যামিল্টন গার্ডেনস ঘুরে আসার পর থেকেই যে মুগ্ধতার আবেশ ঘিরে আছে, শুধু গাছ আর ফুল সেটির কারণ নয়। এ তো যেকোনো বোটানিক্যাল গার্ডেনেই থাকে। এখানে আপনাকে মুগ্ধ করবে যেভাবে তা সাজানো হয়েছে। গাছ-ফুলের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট জলাধার, নানা আকারের ভাস্কর্য, কোথাও বা শুধুই সবুজ এক টুকরো প্রান্তর। এটা আসলে তাড়াহুড়ো করে দেখার জিনিস না। হ্যামিল্টন গার্ডেনসের আকাশে-বাতাসে এমন প্রশান্তি ছড়িয়ে যে, এখানে একটা চক্কর দিয়ে কোথাও চুপ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যায়। সেই বসার ব্যবস্থাও করা আছে পুরো বাগান জুড়ে।
শুধু চোখের প্রশান্তি দেওয়া গাছ আর ফুলই নয়, ব্যবহারিক কাজে লাগে এমন গাছের আলাদা বাগানও আছে এখানে। ঔষধি গাছের আলাদা একটা অংশ, এমনকি তরিতরকারির গাছেরও। ইয়া বড় বড় কিছু মিষ্টি কুমড়া দেখলাম সেখানে। ছড়ানো ছিটানো এত সব বৈচিত্র্যকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করা পথগুলোও দারুণ। কোথাও দুপাশে একেবারেই চিকন হলুদ রঙের বাঁশের ঝাড়, কোথাও ছোট্ট একটা সেতু, কোথাও ঘন সবুজ প্রাচীরের মতো বানিয়ে ফেলা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরা গাছ, আবার কোথাও বা ছোট্ট একটা সুড়ঙ্গ...
কোন বাগানটাতে যেন অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের অমর চরিত্রগুলোর একটা ভাস্কর্য দেখলাম। নিচের ফলকটাতে উৎকীর্ণ লুইস ক্যারলের একটা উক্তি, ‘যদি তুমি না জানো কোথাও যাচ্ছ, পথই তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবে।’ কী দারুণ কথা! হ্যামিল্টন গার্ডেনসের কিছু পথে তো আমরা সত্যি সত্যিই গন্তব্য না জেনেই হাঁটলাম। পথ ঠিকই আমাদের ‘সেখানে’ নিয়ে গেল!