অপরূপ ওয়েলিংটন এবং অটোগ্রাফশিকারি এক বুড়ো

সাগর-পাহাড়ে অপরূপ এক শহর ওয়েলিংটন।
সাগর-পাহাড়ে অপরূপ এক শহর ওয়েলিংটন।

নিউজিল্যান্ডের কোন শহরটা সবচেয়ে সুন্দর? এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর একেক জনের কাছে একেকটা হয়। একটু ঘুরিয়ে বরং এভাবে বলা ভালো—নিউজিল্যান্ডের কোন শহরটা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়?

পাঁচবার এই দেশে ট্যুর করার সুবাদে (২০১৫ বিশ্বকাপে দুই বারে নেলসন আর হ্যামিল্টনে আসা ধরলে ছয়বার বলতে হয়) সবগুলো শহরই দেখা হয়ে গেছে। বেশির ভাগই একাধিকবার। সবচেয়ে ভালো লেগেছে কোনটি?

কোনটার কথা বলি! সাগরপাড়ের ছোট্ট দুই শহর নেলসন আর নেপিয়ারের অন্য একটা সৌন্দর্য আছে। ছিমছাম, গোছানো, একটু আয়েশি ভাব। হ্যামিল্টন শহরটার সঙ্গে আমার একটা আবেগের সম্পর্কের কথা তো অনেকবারই বলেছি। সেটি প্রিয় ব্যক্তিগত কারণে।

নিউজিল্যান্ডকে প্রকৃতি দুহাত ভরে দিয়েছে। প্রতিটি শহরই তার মতো করে সুন্দর। তবে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে মাপকাঠি ধরলে কুইন্সটাউনের আসলে কোনো তুলনা হয় না। পাহাড়-লেক মিলিয়ে অপূর্ব এক শহর। একবারই গিয়েছি, সেটিও প্রায় এক যুগ আগে। তারপরও কুইন্সটাউনের কথা মনে হলে এখনো মনে একইরকম মুগ্ধতা জাগে। নির্দিষ্ট কোথায় যাওয়ারও দরকার নেই, যেদিকে তাকানো যায়, সেটিই যেন অপূর্ব এক ভিউকার্ড। অকারণেই তো পর্যটকে গিজগিজ করে না কুইন্সটাউন।

ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ পেলে যাঁর আর কিছু চাই না। ছবি: উৎপল শুভ্র
ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ পেলে যাঁর আর কিছু চাই না। ছবি: উৎপল শুভ্র

নির্ভেজাল ছুটি কাটানোর জায়গা কু্ইন্সটাউনকে আলাদাই করে রাখি। এরপর কোনটি? আমার পছন্দ ওয়েলিংটন। মাঝখানে প্রায় ১১ বছরের বিরতি দিয়ে তৃতীয়বারের মতো এসেও যে শহরটাকে সেই আগের মতোই ভালো লাগছে। শহরজুড়ে উঁচু-নিচু রাস্তা। যেটির কারণটা বুঝিয়ে দিচ্ছে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়। পাহাড়ও আছে, সাগরও। সাগরের একটা অংশ স্নিগ্ধ হারবার হয়ে ঢুকে গেছে শহরে। হারবারের একটা বাংলা আছে। কিন্তু সেটি লিখতে ইচ্ছা করল না। ‘হারবার’ কত সুন্দর শোনায়, পোতাশ্রয় একটুও নয়।

নর্থ আইল্যান্ডের একেবারে মাথায় এই ওয়েলিংটন। সাগরের ওপারে সাউথ আইল্যান্ড। মাঝখানের অতল জলরাশির কথা ভুলে গিয়ে দুটি দ্বীপকে এক করলে ভাবলে ওয়েলিংটন পড়ে ঠিক মাঝখানে। এ কারণেই নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে ব্যস্তসমস্ত ও জনবহুল শহর অকল্যান্ড থেকে রাজধানী সরিয়ে আনা হয়েছে এখানে। সেটি অবশ্য সেই ১৮৬৫ সালের কথা। এর আগে ২৪ বছর নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ছিল অকল্যান্ড। এরও আগে বছরখানেক ওল্ড রাসেল নামে ছোট্ট এক শহর। হঠাৎ এসব ইতিহাস নিয়ে কেন পড়েছি, যেখানে কারও আগ্রহ থাকলে ইন্টারনেট ঘাঁটলেই এসব পেতে পারেন। এই ডায়েরি ব্যক্তিগত দিনলিপি হয়ে থাকাই ভালো।

তা আজ একটা ব্যস্তসমস্ত দিনই গেল। শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে হারবারের পাশে যে লজটাতে উঠেছিলাম, সকালে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে নতুন ঠিকানায়। মার্কসম্যান মটর ইন নামে একটা মোটেলে। যেখানে এসে ওঠার মূল কারণ বেসিন রিজার্ভের সঙ্গে নৈকট্য। রাস্তা পেরোলেই স্টেডিয়াম। চাইলে মোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়েও খেলা দেখা যায়। এই মোটেলের সঙ্গেও আমার অনেক পুরোনো সম্পর্ক। আঠারো বছর আগে প্রথম ওয়েলিংটনে এসে এখানেই উঠেছিলাম। মোটেলটা চালাতেন দুই বুড়ো-বুড়ি। তিন ছেলেমেয়ের সবাই অন্য দেশে থাকে। তাঁরা দুজন এই মোটেল নিয়ে আছেন। বিশালদেহী বুড়োর পুরো নামটা মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, তাঁকে ‘টম’ নামেই ডাকতে বলে দিয়েছিলেন। সাত দিন ছিলাম এখানে। বুড়ো-বুড়ির সঙ্গে খুব খাতির হয়ে গিয়েছিল। আমার কারণে অকারণে রসিকতা করার অভ্যাসটা খুব পছন্দ হয়েছিল তাঁর। নিজেও ছিলেন মজার মানুষ। তার একটা উদাহরণ মোটেলে চেক ইন করার পর থেকেই মনে পড়ছে।


মোটেলের বারান্দা থেকে বেসিন রিজার্ভ মাঠটা দেখা যায় বলছিলাম। ২০০১ সালের ওই টেস্টে বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক এবার ম্যানেজার হয়ে আসা খালেদ মাসুদ, কোচ ট্রেভর চ্যাপেল। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর তাঁরা দুজন মাত্রই কাভারের ঘোমটা খুলে বেরিয়ে আসা উইকেট দেখতে মাঠের মাঝখানে। আমি মোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তা দেখছি। খেলা শুরুর লক্ষণ দেখলে তবেই মাঠে যাব। আমার পাশেই টম। ট্রেভর চ্যাপেলকে দেখেই যিনি চিৎকার করতে শুরু করেছেন, ‘হেই ট্রেভর, ইউ চিটার, গো ব্যাক। আন্ডারআর্ম চ্যাপেল, গো ব্যাক।’ বলছেন আর হো হো হাসছেন।

সেই টম এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, জানি না। মোটেলের বর্তমান মালিক চীনা। রিসেপশনেও এক চীনা তরুণ। টম নামে কেউ কখনো এই মোটেলের মালিক ছিলেন, এটি তাঁর জানার কথা নয়। জানেনও না। বুড়ো-বুড়ি হয়তো ছেলে-মেয়ে কারও কাছে চলে গেছেন। অথবা নিজেরাই অন্য কোনোখানে। এটাই বিশ্বাস করতে মন চাইছে। যদিও যে সম্ভাবনাটার কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, সেটি সত্যি হওয়াটাই বেশি স্বাভাবিক। শরীর শক্তপোক্ত থাকলেও আঠারো বছর আগেই তো টমের অনেক বয়স। তাঁর বউয়েরও।

মোটেল থেকে একটু ভারাক্রান্ত মন নিয়েই তাই বেসিন রিজার্ভে গেলাম। সেখানে গিয়ে আরেক বুড়োর সঙ্গে দেখা। ছবিতে তাঁকে যতটা বয়স্ক দেখাচ্ছে, ডেভিড পারসনসের বয়স কিন্তু তা নয়। দুই মাস আগে ষাট হয়েছে। হাতে অটোগ্রাফ নেওয়ার খাতা নিয়ে বসে আছেন। এসব দেশে এটা খুব কমন দৃশ্য। নিউজিল্যান্ডের প্র্যাকটিস শেষ, বাংলাদেশ দল তখনো আসেনি। টমের কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে ছিল বলেই হয়তো মাঝের এই সময়টা তাঁর সঙ্গে গল্প করে কাটালাম। পেশায় অ্যাকাউনট্যান্ট। নিউজিল্যান্ডের শিশুদের নিয়ে কাজ করে, এমন একটি সংস্থায় চাকরি করেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ নেবেন বলে আজ ছুটি নিয়ে নিয়েছেন। অটোগ্রাফ নিতে সুবিধা হবে বলে ওয়েলিংটনে ক্রিকেট জাদুঘরে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। সেই সুবাদে পাওয়া অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডটা মাঠে ঢোকার সুযোগ করে দেয়।

ডেভিড পারসনসের খাতায় অকালপ্রয়াত ফিল হিউজের অটোগ্রাফ। ছবি: লেখক
ডেভিড পারসনসের খাতায় অকালপ্রয়াত ফিল হিউজের অটোগ্রাফ। ছবি: লেখক

পারসনসের হাতে স্ক্র্যাপবুকের মতো বড় দুটি খাতা। একটিতে সিরিজ ধরে ধরে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ। সবার পাসপোর্ট সাইজ ছবি। পাশে অটোগ্রাফের জন্য একটা বক্স করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পাতাটায় তখনো শুধু ছবি। আরেকটা খাতার পাতায় পাতায় অসংখ্য অটোগ্রাফ। তার মধ্যে একটি দেখিয়ে পারসনস্ বললেন, ‘এটা ফিল হিউজের অটোগ্রাফ।’


সম্ভাব্য একটা মৃত্যুর কথা ভেবে এমনিতেই আমার মন খারাপ, ক্রিকেট খেলতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা অস্ট্রেলিয়ান তরুণের অটোগ্রাফটা দেখে তা আরও খারাপ হলো। হিউজের অটোগ্রাফটায় আলতো করে হাত বোলালাম। মনটা অন্যদিকে ঘোরাতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শুধু কি অটোগ্রাফই সংগ্রহ করেন নাকি অন্য আরও ক্রিকেট স্মারকও?’ পারসনসের বাড়িতে ক্রিকেটের অনেক স্মারকচিহ্নই আছে। অটোগ্রাফ সংবলিত স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ছবি এর মধ্যে একটি। ডাকে ব্র্যাডম্যানের অ্যাডিলেডের বাড়ির ঠিকানায় ছবিটা পাঠিয়েছিলেন। ব্র্যাডম্যান অটোগ্রাফ দিয়ে সেটি ফেরত পাঠিয়েছেন। পারসনস্ নিজের সংগ্রহের মধ্যে এর চেয়েও যেটিকে ‘দামি’ মনে করেন, তা হলো হেনরি ফলির একটা জার্সি। ১৯৩০ সালে নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট ম্যাচে ওপেন করেছিলেন ফলি। ওই একটাই টেস্ট। দুই ইনিংসে দুই-দুই করে চার রান। তারপরও ‘অমর’ হয়ে আছেন টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম আউট হওয়া কিউই ব্যাটসম্যান হিসাবে। হেনরি ফলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই মারা যান। পারসনস্ কোনো একটা সূত্রে ফলির ছেলের খোঁজ পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ছেলের কাছে বাবার একটা জার্সি ছিল, সেটিই দিয়ে দেন পারসনসকে। গল্পটা শেষ করে পারসনস্ বললেন, ‘জানেন, আমাকে জার্সিটা দেওয়ার এক মাস পর হেনরি ফলির ছেলেও মারা যান।’ আশ্চর্য তো, আজ দেখি মৃত্যু আমার পিছু নিয়েছে!

অটোগ্রাফ নিতে গিয়ে সবচেয়ে আনন্দের আর সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চেয়েছিলাম। আনন্দের অভিজ্ঞতাটা তাঁকে উপহার দিয়েছেন ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে আসা ভারতীয় দলের কোচ ডানকান ফ্লেচার। ওয়েলিংটনে একটি ওয়ানডে ও একটি টেস্ট খেলেছিল ভারত। ওয়ানডের সময় টিম হোটেলে ক্রিকেটাররা যখন বাসে উঠছেন, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন পারসনস্। নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বাসের জানালা দিয়ে ফ্লেচার সেটি দেখে থাকবেন। কয়েক দিন পর ওয়েলিংটনে আবার টেস্ট খেলতে এল ভারত। বেসিন রিজার্ভে যেদিক দিয়ে ক্রিকেটাররা ঢোকে, পারসনস্ সেখানে অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে দেখে এগিয়ে গেলেন ফ্লেচার। খাতাটা নিয়ে আসার একটু পর যখন তা ফেরত দিলেন, সেটিতে ভারতীয় দলের সবার অটোগ্রাফ।

বাংলাদেশের সব ক্রিকেটারের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন ডেভিড পারসনস। ছবি: রতন গোমেজ
বাংলাদেশের সব ক্রিকেটারের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন ডেভিড পারসনস। ছবি: রতন গোমেজ

আর সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা? সেটি উপহার দিয়েছেন ডেভিড ওয়ার্নার। পারসনস্ তাঁর খাতা খুলে ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে আসা অস্ট্রেলিয়া দলের পাতাটা দেখালেন। বাকি সবার অটোগ্রাফ আছে, শুধু ওয়ার্নারের নেই। ‘এতবার অনুরোধ করলাম, ওয়ার্নার ফিরেও তাকাল না’—পারসনসকে খুব দুঃখিত দেখায়।

এর ঘণ্টাখানেক পর বেসিন রিজার্ভ থেকে বেরিয়ে আসছি, পারসনস্ এসে বললেন, ‘আপনি আমাকে অটোগ্রাফ নিতে নিয়ে আনন্দের স্মৃতির কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আপনিও আমাকে তেমন একটা স্মৃতি উপহার দিয়েছেন। যেভাবে ক্রিকেটারদের দাঁড় করিয়ে অটোগ্রাফ নিয়ে দিলেন, আমি তা কখনো ভুলব না।’

আমি কী আর এমন করেছি! বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যখন মাঠে ঢুকছেন, তাঁদের অনুরোধ করেছিলাম, ‘বুড়ো মানুষটা অটোগ্রাফের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। দিয়ে দেন না প্লিজ।’
এটার জন্যই পারসনসের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এতবার ধন্যবাদ দিতে লাগলেন যে, একসময় একটু লজ্জা পেয়ে বললাম, ‘আপনি তো দেখছি পৃথিবীর সব “ধন্যবাদ” শেষ করে ফেলছেন! কাজটা কি ঠিক হচ্ছে, ভবিষ্যতে কারওর এটার প্রয়োজন পড়বে না?’

ডেভিড পারসনস এমন একটা হাসি দিলেন, যা দেখে টম-ফিল হিউজ মিলিয়ে মেঘলা হয়ে থাকা মনের আকাশটায় একটু রোদের ঝিলিক!