সাড়া ফেলেছে রংপুরের ১৫ বছর বয়সী কিশোর

জাতীয় টিটির চমক মুহতাসিন আহমেদ হৃদয়
জাতীয় টিটির চমক মুহতাসিন আহমেদ হৃদয়

জাতীয় টেবিল টেনিসে কতজনই তো চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। মুহতাসিন আহমেদ ওরফে হৃদয়ের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আর কী এমন! কিন্তু যখন জানা যাবে, ছেলেটির বয়স মাত্র ১৫ বছর, ২০০৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে জন্ম, তার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়া তখন অনেক বড় খবরই। 

সেটিও পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন মানস চৌধুরীকে হারিয়ে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার পল্টনে শহীদ তাজউদ্দীন ইনডোরে এই অভাবনীয় কাণ্ডটি ঘটিয়েছে মুহতাসিন। জিতে নিয়েছে ৩৮তম জাতীয় টিটির পুরুষ এককের ফাইনালটা। তীব্র লড়াইয়ের পর ৪-৩ গেমে রুদ্ধশ্বাস জয়। টিটি অঙ্গনে মুহতাসিন এখন যেন একটুখানি তাজা বাতাস।
একটা সময় বাংলাদেশের পুরুষ টিটির বড় নাম ছিলেন নাসিমুল হাসান (কচি), ছোট থেকেই ভালো খেলতেন। ১৫–১৬ বছর বয়সে অনেক টুর্নামেন্টও জেতেন। তবে নাসিমুল জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা হয়েছেন ১৯–২০ বছর বয়সে। মুহতাসিনের মতো এত কম বয়সে টিটি, ব্যাডমিন্টন, টেনিসসহ মূল খেলাগুলোতে (দাবা বাদে) কেউ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বলে মনে করা কঠিন।

মুহতাসিন এখানেই আলাদা, তার হাত ধরে গর্বিত এখন রংপুরের টিটিও। এই রংপুরের একটা টিটি ঐতিহ্য আছে। ষাটের দশকে বাংলাদেশের টিটি সংস্থার শুরুটা রংপুরেই। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় টিটি ফেডারেশন হলো। তারপর লম্বা কাহিনি। রংপুর থেকে উঠে আসেন কামরুন নাহার (ডানা), যিনি মূলত ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হলেও সত্তরের দশকে জাতীয় টিটির চেনামুখ। নারী এককে তাঁর তৃতীয় হওয়া বা জোবেরা রহমান লিনুকে সঙ্গী করে দ্বৈতে সেরা হওয়ার কথা ভোলা যায় না। সেই কামরুন নাহার রংপুরে যে টিটি ক্লাবে অনুশীলন করতেন (রংপুর টেবিল টেনিস সংস্থা), সেটিরই উত্তরসূরি এই মুহতাসিন। তার হাত ধরেই এই প্রথম রংপুরের কেউ জাতীয় টিটির এককে সেরা।
বিখ্যাত এই ক্লাবটির জন্ম ১৯৬৪ সালে। অবস্থান রংপুর জেলা প্রশাসন ভবনের কাছে। নিউ ইঞ্জিনিয়ারপাড়ার ঠিকাদার ফরহাদ আহমেদের একমাত্র সন্তান মুহতাসিনের সেখানে যেতে সময় লাগে কয়েক মিনিট। যেখানে জমজমাট আক্তার মেমোরিয়াল টিটি টুর্নামেন্ট হতো আগে। ভালো সংগঠকের অভাবে এখন আর সেভাবে হয় না। তাই খেলাটা ঝিমিয়ে পড়েছে।

অথচ স্বাধীনতার পর ক্লাবটি আয়োজিত টুর্নামেন্ট ঢাকার অনেক ক্লাব যেত। ভারতের তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন–রানারআপ পশ্চিম বাংলার রুপা গাঙ্গুলি এবং পাঞ্জাবের কল্পনা তেওয়ারীরা এখানে খেলে গেছেন। রুপা তখন বাংলাদেশের ছেলেদেরও হারিয়ে যান। এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কামরুন নাহারের আপন চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আকমল তাজ। নিজে পূর্ব পাকিস্তান দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় ছিলেন।
তাঁর দক্ষ পরিচালনায় ষাটের দশকে ক্লাবটির দামি ডানলপ বার্না টেবিল ছিল, যেটি তখন ঢাকায়ও কম দেখা যেত। কামরুন নাহাররা এটিতেই খেলতেন। এখন ক্লাবটির তিনটি টেবিলের অবস্থাই খারাপ। মুহতাসিন তবু এখানেই অনুশীলন করে এবং তার চেয়ে পিছিয়ে থাকা ছেলেদের সঙ্গে।

ফাইনালে হৃদয়ের সামনে (লাল জার্সি) পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন মানস চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় উডেনফ্লোরে। ছবি: সৌজন্য
ফাইনালে হৃদয়ের সামনে (লাল জার্সি) পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন মানস চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় উডেনফ্লোরে। ছবি: সৌজন্য

অথচ ছেলেটি ঢাকায় এসে হারায় সাবেক-বর্তমান জাতীয় চ্যাম্পিয়নদের। এবার কোয়ার্টারে গতবারের চ্যাম্পিয়ন জাবেদকে হারিয়েছে। সেমিতে ধরাশায়ী সাবেক এক নম্বর পরাগ। অথচ তার শুরুটা এই সেদিন। ২০১৫ সালে ঢাকায় প্রথম একটা টুর্নামেন্ট খেলেই চ্যাম্পিয়ন। বয়স তখন মাত্র ১২। ২০১৬ সালে জাতীয় জুনিয়রে প্রথম খেলা হলো দিনাজপুরে। গত বছরই এল প্রথম সাফল্য, জুনিয়র এককে চ্যাম্পিয়ন। রংপুরের সফল কোচ মিহির সেনের মেধাবী ছাত্রটি এবারই প্রথম সিনিয়র জাতীয় মিটে খেলেই চমক দিয়েছে।

মুহতাসিন রংপুর জিলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে বিজ্ঞানে। পিইসি আর জেএসসিতে এ প্লাস। মানে পড়া আর খেলা দুটোতেই ভালো। এই ধারাটা এগিয়ে নিতে চায় সে। তাই বলে, সুযোগ-সুবিধা পেলে আরও ভালো করা সম্ভব। কামরুন নাহারও সেটিই বলেন, ‘মাত্র ১৫ বছর বয়সে এটি অভাবনীয় সাফল্য। কিন্তু রংপুরের টিটি ক্লাবের ফ্লোরটা ম্যাট হওয়া উচিত। আমি চাইব, ফেডারেশন এটা করে দিক। তাতে আরও নবীন বেরোবে। এসএ গেমসে ভালো করব আমরা।’
আর মুহতাসিন কী বলে? একটাই দাবি করছে কাল রংপুর থেকে ফোনে, ‘আমাদের এখানকার টিটি ক্লাবের বোর্ড তিনটি অনেক ধীর। ক্ষয়ে যাচ্ছে, বাউন্স করে না। এখানে খেলে ঢাকার ফাস্ট বোর্ডে অসুবিধা হয়। অনেক কষ্ট করে অনুশীলন করি আমরা। আমি চাই আমাদের দিকে সবাই একটু নজর দিক, সুযোগ-সুবিধা বাড়াক।’ মুহতাসিন জানাল, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কাছে কিছু চাইলে তারা নাকি ‘আচ্ছা দেখছি’ বলে ফোনটা রেখে দেয়!

টিটি ফেডারেশন টিটি বোর্ড দেয় জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে, কিন্তু জেলা ক্রীড়া সংস্থার টিটি রুমের দরজাই খোলে না অনেক দিন। ধুলো পড়ে থাকে। তবু উঠে আসে মুহতাসিনরা। সবাই চান ছেলেটি হারিয়ে না যাক। আলো ছড়াক বাংলাদেশের টেবিল টেনিসে। কিন্তু তাকে লালন-পালন করতে ফেডারেশন বা সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব পালন করবেন তো?