'চোকার' অপবাদ ঘুচিয়ে এই আর্জেন্টাইন এখন 'নায়ক'

এমন জয়ের পর উন্মাতাল আনন্দই মানায়। ছবি: টুইটার
এমন জয়ের পর উন্মাতাল আনন্দই মানায়। ছবি: টুইটার

পরশু ইতিহাদ স্টেডিয়ামে ম্যাচের ৯৩ মিনিটে মুখগুলো দেখেছিলেন? উন্মাতাল পেপ গার্দিওলা, রহিম স্টার্লিং, সার্জিও আগুয়েরোরা আত্মহারা। মুদ্রার অপর পিঠে যখন টটেনহাম। খেলোয়াড়দের কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন হতাশায়, সমর্থকদেরও মুখে রাজ্যের মেঘ। তখন মাউরিসিও পচেত্তিনো ঠিক কী ভাবছিলেন? টিভি স্ক্রিনে দেখা গেল হতাশায় পচেত্তিনো নিজের কোট খুলে ফেললেন। ‘ভিএআর’ রিভিউর পর এই আর্জেন্টাইনই ছিলেন সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ!

দেড় মৌসুম ধরে নিজেদের মাটিতে ছিল না টটেনহাম। খেলতে হয়েছে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে। নতুন মাঠের খরচাপাতির জন্য মালিকপক্ষ দলবদলে এক পয়সাও দেয়নি পচেত্তিনোকে। সবশেষ লুকাস মউরাকে কিনেছিলেন, তা–ও দুই বছর আগেকার কথা। ওদিকে প্রতিপক্ষ দলগুলো খেলোয়াড় কিনতে দেদার খরচ করছে, কিন্তু টটেনহাম কোচ পচেত্তিনোর সেই সুযোগ নেই। তার ওপর হ্যারি কেইনকেও পায়নি টটেনহাম পরশু চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল ফিরতি লেগে। কিন্তু সন হিউং-মিন, লরেন্তে, ডেলে আলি, এরিকসেনদের নিয়েই পচেত্তিনো টেক্কা দিলেন ‘পেট্রো ডলার’ সমৃদ্ধ ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে। সাত গোলের পাগলাটে সেই ম্যাচের পর ‘চোকার’ খ্যাত পচেত্তিনো রাতারাতি হয়ে উঠলেন নায়ক।

পচেত্তিনো খেলোয়াড়ি জীবনে অবশ্য খুব একটা এগোতে পারেননি। ছোটবেলায় আর্জেন্টিনার দুই বিশ্বকাপ জয় দেখেছেন বাবার হাত ধরে। সেই থেকে আগ্রহ জন্মেছিল ফুটবলে। নিউ ওয়েলস বয়েজে তাঁর প্রথম কোচ ছিলেন আর্জেন্টিনার সাবেক কোচ মার্সেলো বিয়েসলা। সেখান যোগ দিলেন এস্পানিওলে। মাঝে পিএসজি, বোর্দো ঘুরে পচেত্তিনো আবার ফিরলেন সেই এস্পানিওলেই। ১০ বছর রক্ষণ সামলে জার্সি তুলে রাখেন ওই স্প্যানিশ ক্লাবের হয়েই। গায়ে চড়াতে পেরেছেন আর্জেন্টিনার জার্সিও। ২০০২ বিশ্বকাপে ছিলেন, কিন্তু মাইকেল ওয়েনকে করা এক ফাউল থামিয়ে দেয় আর্জেন্টিনার যাত্রা! সঙ্গে তাঁর জাতীয় দলের ক্যারিয়ারও।

এস্পানিওলের জার্সিতে। ছবি: টুইটার
এস্পানিওলের জার্সিতে। ছবি: টুইটার

২০০৬ সালে এস্পানিওল ছাড়ার তিন বছর পর এই ক্লাবেই কোচ হয়ে আসেন পচেত্তিনো। দুই কোচ বরখাস্ত হওয়ার পর তাঁর ডাক পড়েছিল। কোচিং লাইসেন্স পাওয়ার দুই মাসের মাথায় এস্পানিওলের অবনমন থামানোর লড়াইয়ে নামতে হলো তাঁকে। প্রথম ম্যাচেই প্রতিপক্ষ পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনা। ম্যাচের আগে মাত্র দুটি অনুশীলন সেশন পেয়েছিলেন; সেটুকুই যথেষ্ট ছিল বার্সাকে আটকানোর জন্য। তিন বছর আগে দল ছাড়া পচেত্তিনোর ৯ জন সতীর্থ তখনো এস্পানিওলের খেলোয়াড়। প্রথম দেখায় গোলশূন্য ড্র হলেও দ্বিতীয় ম্যাচে পচেত্তিনো দেখালেন তাঁর কোচিং-জাদু। ২৭ বছর পর ক্যাম্প ন্যুতে ‘কাতালুনিয়া ডার্বি’ জিতল এস্পানিওল। জানুয়ারিতেও অবনমনের শঙ্কায় থাকা দলটিকে পচেত্তিনো মৌসুম শেষ করালেন ১০ম স্থানে তুলে।

তখনো কেউ ভাবতে পারেনি, খেলোয়াড়ি জীবনে কিছু করতে না পারা পচেত্তিনো কিছুদিনের মধ্যেই কোচ হিসেবে খ্যাতি কুড়োবেন। প্রায় প্রতি মৌসুমেই অবনমনের শঙ্কায় থাকা এস্পানিওলকে টেবিলের মাঝামাঝিতে রাখার চেষ্টায় ছিলেন পচেত্তিনো। সে লক্ষ্যে তাঁকে অসফল বলা যায় না। ২০১০-১১ মৌসুমে এস্পানিওলকে তুলে এনেছিলেন আটে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ ও সমর্থন না পাওয়ায় মৌসুমের মাঝপথেই ছাড়তে হয় এস্পানিওলের দায়িত্ব।

পরের মৌসুমেই সাউদাম্পটনের কোচ হওয়ার প্রস্তাব পান পচেত্তিনো। কোচ হিসেবে তরুণ তারকাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই বেশি পছন্দ করেন এই আর্জেন্টাইন। সাউদাম্পটন কোচ হিসেবে প্রথম জয় পান লিগজয়ী ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে। আগের মৌসুমেই দ্বিতীয় বিভাগ থেকে উঠে আসা সাউদাম্পটনে সেই মৌসুমেই ছিল নেমে যাওয়ার শঙ্কায়। কিন্তু পচেত্তিনো তা হতে দিলেন না। পুরো দল সাজানোর সুযোগ পেলেন পরের মৌসুমে, আর এতে সাউদাম্পটনকেও তুলে আনলেন টেবিলের আটে। যা ছিল ১৯৯০ সালের পর দলটির সেরা ফল।

ইংল্যান্ডে সাফল্যের খোঁজে থাকা টটেনহাম ১২ মৌসুমে ১০ বার কোচ বদলানোর পর ২০১৪ সালে পচেত্তিনোর শরণাপন্ন হয়। দলটির দায়িত্ব নিয়েই পচেত্তিনো রবার্তো সোলদাদোর বদলে ভরসা রাখেন হ্যারি কেইনের ওপর। আর ডেলে আলি ও এরিক দিয়েরকে নিয়ে সাজালেন মাঝমাঠ। কিন্তু শীর্ষ চারে জায়গা হলো। তবে পরের মৌসুমেই করলেন বাজিমাত। লেস্টার সিটির রূপকথার মৌসুমে তৃতীয় হয়ে শেষ করলেন লিগ মৌসুম। ১৯৯০ সালের পর সেবার সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থেকে লিগ শেষ করে টটেনহাম।

তরুণ খেলোয়াড়দের তুলে আনার কাজে বেশ পটু তিনি। সংগৃহীত ছবি
তরুণ খেলোয়াড়দের তুলে আনার কাজে বেশ পটু তিনি। সংগৃহীত ছবি

পরের মৌসুমে রেকর্ড ভাঙা যেন নেশায় পরিণত হলো পচেত্তিনোর। লিগ টেবিলে এগোলেন আরেক ধাপ। ভাঙলেন ৫৪ বছরের পুরোনো রেকর্ড। এ ছাড়া ৫২ বছর পর ঘরের মাঠে অপরাজিত থাকার রেকর্ডও এনে দিলেন টটেনহামকে। কিন্তু রেকর্ড গড়ে তো আর সব হয় না, দরকার শিরোপার। দিন শেষে কয়টি শিরোপা নামের পাশে আছে, তা–ই দেখতে চায় সকলে। পচেত্তিনো এই হিসাব মেলাতে বারবার ব্যর্থ।

তা না হওয়ার কারণ নেই। দল হিসেবে টটেনহাম খরচের পাল্লা কখনোই ভারী করেনি। গত কয়েক মৌসুমে প্রায়ই ১০০ মিলিয়ন ছাড়ানো দলবদলের মৌসুমে পচেত্তিনোর সর্বোচ্চ খরচ মাত্র ৩০ মিলিয়ন ইউরো। তবে যত কিছুই হোক না কেন, দলে নতুন তারকা তুলে আনার ব্যাপারে তাঁর সমকক্ষ খুব কম কোচই আছেন। সাউদাম্পটনে থাকতে তুলে এনেছিলেন নাথানিয়েল ক্লাইন, দেজান লভরেন, লুক শ-র মতো খেলোয়াড়দের। টটেনহামে আসার পর তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছেন হ্যারি কেইন, ডেলে আলি, সন হিউং-মিনরা।

পরশু ম্যাচের ৯৩ মিনিটে ফিরে আসা যাক। ‘ভিএআর’ রিভিউ, আগুয়েরোর পায়ে বল, তারপর অফসাইডের জন্য গোল বাতিল। না অহেতুক আনন্দ নয়, বরং স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন পচেত্তিনো। ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ শেষ করেই দিলেন এক চিৎকার। ঠান্ডা মাথার কোচ পচেত্তিনোর মেজাজ হারানো খুব কমই দেখা গেছে। পরশু অমন পাগলাটে ম্যাচেও মাথা ঠান্ডা ছিল এই আর্জেন্টাইনের।

বার্সা, ইন্টার, পিএসভির গ্রুপ থেকে তিন ম্যাচ শেষে ১ পয়েন্ট অর্জন করা টটেনহাম চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিতে পৌঁছাবে, তা আশা করাও ছিল দুঃসাহসের নামান্তর। কিন্তু পচেত্তিনো এই দুঃসাহস সত্যি বলেই প্রমাণ করলেন। সেটিও দলের সেরা খেলোয়াড় হ্যারি কেইনকে ছাড়াই। টটেনহাম ইউরোপসেরা হতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে মাউরিসিও পচেত্তিনো কিন্তু হাঁটছেন খ্যাতিমান কোচ হয়ে ওঠার পথেই।