জয় দিয়ে শুরু বাংলাদেশের

অপরাজিত ৮৩ রানের ইনিংসটি খেলার পথে অফসাইডে তামিম ইকবালের আরেকটি দুর্দান্ত শট। কাল ধর্মশালায় l ছবি: বিসিবির সৌজন্যে
অপরাজিত ৮৩ রানের ইনিংসটি খেলার পথে অফসাইডে তামিম ইকবালের আরেকটি দুর্দান্ত শট। কাল ধর্মশালায় l ছবি: বিসিবির সৌজন্যে

ম্যাচসেরা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাঁর নামটা ঘোষণা না করলেও চলত। তামিম ইকবালের হাতেই
যে ট্রফিটা উঠছে, তা তো সবার জানাই ছিল।
ক্রিকেট ইতিহাস নিঃসঙ্গ লড়াই খুব কম দেখেনি। হোক না নিছকই একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ, তামিমের কালকের ইনিংসটাকেও সেখানে নবতম সংযোজন বলে ধরতে হবে। যা বোঝাতে কাব্য-টাব্য করার প্রয়োজনই পড়ছে না। পরিসংখ্যানকে যতই ‘গাধা’ বলে তাচ্ছিল্য করা হোক, কখনো কখনো সেটিই সব বলে দেয়। এখানেও যেমন দিচ্ছে। ৫৮ বলে তামিমের অপরাজিত ৮৩। বাংলাদেশের ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যেখানে মাত্র ১৫।
দৃষ্টিটা পুরো ম্যাচে ছড়িয়ে দিন। তামিম-মহিমা তাতে আরও আলো ছড়াবে। দুই দল মিলিয়েই ম্যাচের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর ২৯। তামিম তো তাহলে একাই ম্যাচটা জেতালেন!
যদি একমত হয়ে গিয়ে থাকেন, বুঝতে হবে ম্যাচটা আপনি দেখেননি, শুধু স্কোরকার্ডেই ম্যাচের ছবি দেখছেন। পুরো ম্যাচে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেওয়ার যে কথাটা বলা হলো, তা দিলে তো তামিমকেও আড়াল করে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। মুখে হাসি নিয়ে তাঁর পাশে উঁকি দিচ্ছেন তাসকিন আহমেদ।
স্কোরকার্ড মাশরাফির কথা কিছুটা বলবে। ৪ ওভারে ১৪ রান দিয়ে ১ উইকেট। কিন্তু ৪ ওভারে ২১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকা তাসকিনের অবদান বোঝানোর সাধ্য তার নেই। মাশরাফিরটাও কি পুরোটা বলছে! বলবে হল্যান্ড ইনিংসের ১৭তম ওভারটিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে। ম্যাচ তখন দোদুল্যমান। একটু বোধ হয় হল্যান্ডের দিকেই ঝুঁকে। শেষ ৪ ওভারে ৪২ রান টি-টোয়েন্টিতে এমন অসম্ভব কিছু নয়, যেখানে হাতে আবার ৬ উইকেট আছে।
ক্রিকেট ম্যাচে কখনো কখনো এমন মুহূর্ত আসে, এর আগে-পরের সবকিছু তুচ্ছ হয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় সময়। এই ম্যাচে সেই মুহূর্তটি এল ওই ১৭তম ওভারে। মাশরাফি একবার ভেবেছিলেন, আল আমিনকে ডাকবেন বা কোনো স্পিনারকে। শেষে ঠিক করলেন, এই ম্যাচের নির্ধারক হতে যাওয়া ওভারটি নিজেই করবেন। তা কী ওভারটাই না করলেন!
৬টি বলই দুর্দান্ত। যাতে মাত্র ৩ রান দিয়ে ১ উইকেট। উইকেট একটা বেড়ে রান একটা কম হওয়ার কথা। তা হয়নি নিছকই দুর্ভাগ্য বলে। দ্বিতীয় বলটি স্টাম্পে লাগার পরও বেল পড়েনি, উল্টো একটা রান পেয়ে গেছেন টম কুপার। উইকেট পেলেন চতুর্থ বলে, দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে ১৩টি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘ডাচ’ হয়ে যাওয়া ফন ডার মারউইকে ফিরিয়ে দেওয়া বলটিতেই বোধ হয় লেখা হয়ে গেল ম্যাচের ভাগ্য।
তার পরও যদি অনিশ্চয়তা কিছু থেকে থাকে, সেটি উড়ে গেল তাসকিনের ইয়র্কারের এক অনুপম প্রদর্শনীতে। পরিস্থিতির চাহিদা চার-ছয়, অথচ ডাচ ব্যাটসম্যানরা স্টাম্প বাঁচাতেই ব্যতিব্যস্ত। ওই ওভারে ৬ রান, যার দুটি আবার লেগ বাই। মাশরাফি আর তাসকিনের দুর্দান্ত ওই দুটি ওভারের কারণেই ১৯তম ওভারে আল আমিনের ১৬ রান দিয়ে ফেলাতেও কোনো সমস্যা হলো না। এই ফর্মের তাসকিনের বলে কি আর শেষ ওভারে ১৭ রান নেওয়ার সাধ্য আছে টেল এন্ডারদের!
ডাচ অধিনায়ক পিটার বোরেন সংবাদ সম্মেলনে বিষণ্ন মুখে বারবারই ‘মুর্তজার করা ১৭তম ওভার’টির কথা বলে গেলেন। সঙ্গে তাসকিনের ইয়র্কার নিয়ে মুগ্ধতার কথাও। শুনতে শুনতে একটু অবাকই লাগছিল। একটা সময় ছিল, হল্যান্ড-আয়ারল্যান্ডের মতো দলগুলোর বিপক্ষে স্পিনই হতো বাংলাদেশের মূল মারণাস্ত্র। এই ম্যাচেও এশিয়া কাপ ফাইনালের একাদশ থেকে একজন পেসারকে বসিয়ে নেওয়া হয়েছিল বাড়তি এক স্পিনারকে। অথচ সেই আরাফাত সানি করলেন মাত্র ২ ওভার। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু পালাবদল যেন সম্পূর্ণ হলো এই ধর্মশালায় এসে। যখন পেসাররা আবারও জানিয়ে দিলেন, যেকোনো উইকেটেই তাঁরা মরণবাণ হানতে পারেন।
উইকেটের কথাটা আসছে সেটি ধোঁকা দিয়েছে বলে। অতীত ইতিহাস আর কিউরেটরের কথা অনুযায়ী যে উইকেট পেস আর বাউন্সে ভরা থাকার কথা, খেলা শুরুর পর দেখা গেল, সেটি উপমহাদেশের প্রথাগত ধীরগতির উইকেটই। যা আরও নম্বর যোগ করছে মাশরাফি-তাসকিনের বোলিংয়ে। তৃতীয় ওভারে একটু গড়বড় করে ফেলার আগে প্রথম ২ ওভারে আল আমিনও তো দুর্দান্ত।
গত বছর খানেকের কথা মনে রাখলে এটা এমন কোনো বিস্ময় নয়। বিস্ময় হতে পারে, পিটার বোরেন ম্যাচের নির্ধারক হিসেবে মাশরাফির ওভারটির সঙ্গেই যেটিকে রাখছেন। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের অসহায়ত্বের একটা বড় কারণ ছিল ছক্কা মারতে না পারা। কাল বাংলাদেশের ইনিংসে ৬টি ছক্কা, ছক্কা মারায় ওস্তাদ ডাচদের যেখানে মাত্র ১টি। ‘এক ছক্কা দিয়ে কি ছয় ছক্কার সঙ্গে লড়াই করা যায়’-বোরেনের আক্ষেপ বলে দিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরেকটি বদলের কথাও!

বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৫৩/৭
হল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৪৫/৬
ফল: বাংলাদেশ ৮ রানে জয়ী