আফগানদের ক্রিকেটানন্দ

গ্যালারিতে এক টুকরো আফগানিস্তান। প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতে জাতীয় দলকে নিয়ে কাল ফতুল্লায় ছুটে এসেছিলেন আফগান তরুণীরা  প্রথম আলো
গ্যালারিতে এক টুকরো আফগানিস্তান। প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতে জাতীয় দলকে নিয়ে কাল ফতুল্লায় ছুটে এসেছিলেন আফগান তরুণীরা প্রথম আলো

মাঠে ঢুকলেন তাঁরা হইহই করতে করতে। গ্যালারিতে জায়গা নেওয়ার পর শুরু হলো কণ্ঠের জোর পরীক্ষা। প্রায় সবার গায়েই ’আফগানিস্তান’ লেখা টি-শার্ট। হাতে আফগান পতাকা, গালেও দেশের পতাকা এঁকে নিয়েছেন প্রায় সবাই। মাঠে তখন ধুঁকছে আফগানিস্তান, তাতে তাঁদের বয়েই গেছে! সমানে চেচিঁয়ে যাচ্ছেন সবাই। আসগর স্টানিকজাই আর সামিউল্লাহ শেনওয়ারির ব্যাটের ধার যখন বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল তাঁদের কণ্ঠের ধার। ইনিংস শেষে স্কোরবোর্ডের চেহারা দেখে যখন নিস্তব্ধ, হতবিহ্বল বাংলাদেশের সমর্থকেরা, একদল আফগান মেয়ের নাচ, চিৎকার-চেঁচামেচি, উচ্ছ্বাস যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছিল গোটা মাঠে। ফতুল্লার গ্যালারির ওই অংশ যেন এক টুকরো আফগানিস্তান!
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ক্রিকেট এখন এক আশ্চর্য সঞ্জীবনী সুধা। যে সুধা অন্তত কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দেয় কঠিন বাস্তবতা। কিছুক্ষণের জন্য নাকে লাগে না রক্তের গন্ধ বা বারুদের ঝাঁজ। ভুলিয়ে দেয় দুঃস্বপ্নের অতীত, সমস্যাসংকুল বর্তমান, অনিশ্চয়তায় ভরা ভবিষ্যৎ। ক্রিকেট এখন আফগানদের কাছে এই কঠিন পৃথিবীতে আরেকটি দিন বাঁচা, আরেকটি দিনের সংগ্রামের অণুপ্রেরণার উৎস। ক্রিকেট দলের ২০১৫ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন দেশে এনে দিয়েছিল জাতীয় উৎসবের উপলক্ষ। দেশে ফেরার পর বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল নবী-শাহজাদদের। সিনেমা, সাহিত্য, সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ইতিহাসের আফগানিস্তানে এখন বিনোদনের সবচেয়ে বড় খোরাক ক্রিকেট। ফতুল্লার গ্যালারিতেও যেন সেই প্রতিচ্ছবি। রান হোক বা না হোক, উইকেট পড়ুক বা হোক ছক্কা, উদ্যাপনের উপলক্ষ যেন সবকিছুতেই।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচেও ফতুল্লার গ্যালারিতে ছিলেন বেশ কজন আফগান দর্শক। কাল গ্যালারি মাতিয়ে রাখল ২৪-২৫ জনের ওই দলটি। সবাই পড়াশোনা করছেন চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এ। খেলা দেখার জন্যই সবাই এসেছেন ঢাকায়। আফগানিস্তান এশিয়া কাপে খেলছে জানার পর থেকেই সবাই মিলে পরিকল্পনা করেছেন অন্তত একটি খেলা দেখার। ঢাকায় এসে একটি হোটেল উঠেছেন সবাই, কাল রাতেই আবার ফিরে যাওয়ার কথা।
ওই দলে পাওয়া গেল একজন ক্রিকেটারকেও! পাশাপাশি বসে ছিলেন দুই ‘জারা’—রোস্তামি ও আহমাদি। ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে চাওয়ার কথা শুনেই লাজুক হাসিতে জারা রোস্তামি বললেন, ‘আমি নিজেও কিন্তু ক্রিকেট খেলেছি! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিকেট ক্লাব আছে, মাস ছয়েক খেলেছি ক্লাবে। এখন পড়াশোনার এত চাপ যে সময় করতে পারছি না।’ নিজে এখন না খেললেও দাবি করলেন ক্রিকেটের খোঁজখবর ভালোই রাখেন। প্রিয় ক্রিকেটার তাঁর আসগর স্টানিকজাই। ‘সেটা কি আজ (কাল) সর্বোচ্চ রান করেছেন বলেই?’ প্রশ্নটি শেষ হওয়ার আগেই কেড়ে নিলেন জারা, ‘না, না, মোটেও না। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচেও আসগর ফিফটি (৬৬) করেছিলেন, তখন থেকেই প্রিয়।’ বোঝা গেল জারার দাবি মিথ্যে নয়, ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন ভালোই।’
চার বছর ধরে বাংলাদেশে আছেন জারা, সর্বশেষ দেশে গেছেন দুই বছর আগে। তবে ভালো করেই জানেন দেশে এখন কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। পাশে বসা বন্ধু জারা আহমাদি নিজে থেকেই বললেন, ‘এমনিতে আফগানিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। তবে ক্রিকেট দলের টানা সাফল্যে ক্রিকেটও এখন দারুণ জনপ্রিয়। আফগানিস্তানের খেলা টিভিতে দেখালে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়।’
এই জারা যখন কথা বলছেন, আরেক জারা তখন ব্যস্ত বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তোলায়। সঙ্গে নাচ-গান, হইচই চলছিলই। এই মেয়েদের কাউকে না কাউকে নিশ্চয়ই ছুঁয়ে গেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। হারিয়েছেন স্বজন, একটি মর্টার শেল মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে সাজানো বাগান। ধুলোয় মিশেছে স্বপ্ন। ক্রিকেট আবার হাসতে শিখিয়েছে তাঁদের, আরও লাখো আফগানকে। মাঠের জয়-পরাজয় তাই একদমই তুচ্ছ। আফগানদের প্রতিবার মাঠে নামাই তো একেটি জয়। জীবনের জয়সংগীত!