তেতে উঠতে 'কিছু একটা' লাগে সাকিবের

>

লিওনেল মেসির ভীষণ রকমের ভক্ত সাকিব আল হাসান আদতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ঘরানার। একটা কিছু তাঁর লাগে তেতে ওঠার জন্য।

এই জীবনটা তো নিজেই বেছে নিয়েছেন সাকিব আল হাসান। ছবি: প্রথম আলো
এই জীবনটা তো নিজেই বেছে নিয়েছেন সাকিব আল হাসান। ছবি: প্রথম আলো

পরীক্ষার আগের দিন পড়ায় বিশ্বাসী নন সাকিব আল হাসান। অবশ্য বৃষ্টির কারণে অনুশীলন বাতিল হওয়ায় কাল দলেরই অনুশীলন হয়নি। তবু ঘরবন্দী থাকতে চাইলেন না সাকিব। সপরিবার কোথায় যেন বেড়াতে যাচ্ছিলেন। আলাইনাও হয়েছে বাবার ন্যাওটা। এই মেয়ের কারণেই সাকিবের স্ত্রী শিশিরকেও যাযাবর জীবন বেছে নিতে হয়েছে। হোটেলই ঘরসংসার। সাংবাদিকদের বাসায় দাওয়াত দেওয়ার সুযোগই তো নেই!

সাম্প্রতিক সময়ে সাকিবকে ঘিরে যে উত্তাপ, তাতে মূল আলোচ্য বিষয় দুটি। সাকিবের ‘না থাকা’ এবং সেই বিতর্কের উপজাত হিসেবে স্ত্রী শিশিরের একটি ‘দাওয়াতবিষয়ক’ ফেসবুক পোস্ট। ওই না থাকা তো অনুশীলনে নয়; বিশ্বকাপ দলের অফিশিয়াল ছবিতে। সবাই আছেন, দলের প্রাণভোমরাটাই নেই। ছবিটা পূর্ণতা পায় কী করে!

আইপিএল থেকে দেরিতে বিশ্বকাপ দলে যোগ দেওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলের প্রতি সাকিবের নিবেদন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাকি সব হয়তো মেনে নিতে রাজি আছেন, দলের প্রতি নিবেদন নিয়ে প্রশ্নটা একটু তাতিয়ে দিয়েছে নিশ্চিত। প্রস্তুতি ম্যাচে বাকি সবার মধ্যে একটা গা-ছাড়া ভাব ছিল। কিন্তু সাকিব ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে নিজেকে উজাড় করে দিলেন আপাত-অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটিতে।

পরশু সিরিজে নিজেদের প্রথম ম্যাচে সাকিব ব্যাটে-বলে আরও দুর্দান্ত। ডিপে নিলেন অসাধারণ এক ক্যাচ। সাংবাদিকের আঙুলের ডগায় ‘পাল্টা জবাব’ শব্দজোড়া নিশপিশ করতেই পারে। তবে অতীতেও দেখা গেছে, বিতর্কের কোলাহল সাকিব মুহূর্তেই থামিয়ে দেওয়ার জাদুটা জানেন।

সাকিবকে নিয়ে নিয়মিতই দেখা দেওয়া বিতর্কগুলোয় তাঁর অবদান কতটা, কতটা বাকিদের—এ নিয়েই তো বিতর্ক হয়। তবে এ বিষয়ে তাঁর ঘোর নিন্দুকও একমত হবেন, তীব্র সমালোচনার মুখে তিনি ভালো খেলেন। লিওনেল মেসির ভীষণ রকমের ভক্ত সাকিব আদতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ঘরানার। একটা কিছু তাঁর লাগে, তেতে ওঠার জন্য।

কাল সাকিবকে যখন প্রশ্ন করা হলো, মাঠের বাইরের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো তাঁকে কতটা প্রভাবিত করে, সাকিব পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আমাকে নিয়ে কোনো ইস্যু হয়েছে নাকি আবার, জানি না তো!’ পরে খোলাসা করলেন বিতর্কের মুখে তাঁর মনস্তত্ব কীভাবে সব সামলে নেয়।

সাকিব নিজের কাজের ফলাফলের প্রতি মনোযোগী, এর পেছনের ব্যাকরণে নয়। উদয়াস্ত নেটে না খেটেও যদি ভালো ইনিংস এনে দিতে পারেন কিংবা উইকেট; ওভাবেই তো নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছেন!

আর ঠিক এ কারণেই হিলস ক্রিকেট ক্লাব মাঠের অস্থায়ী প্রেসবক্স থেকে তাঁকে প্রস্তুতি ম্যাচেই অতটা সিরিয়াস দেখে কৌতূহল জাগল। এরপর পরশু ১০ ওভারে মাত্র ৩৩ রান দিয়ে ড্যারেন ব্রাভোর উইকেট। ব্যাট হাতে সমান বলে অপরাজিত ৬১। প্রায় ৬ ওভার ডট বলই দিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে শেষে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলল, তাতে মূল ভূমিকা বাংলাদেশের পেসারদের, কিন্তু নেপথ্যের ভিত্তিটা দুই স্পিনারের গড়া। মোস্তাফিজের বলে কাটারের ক্যাচটা যেভাবে লুফে নিয়েছেন, উল্টো প্রান্তের প্রেসবক্সের দূরত্ব থেকে দেখলেও, এখনো চোখে লেগে আছে।

সাকিব অবশ্য পাল্টা দাবি করতে পারেন, বিতর্ক না হলে আমি বুঝি ভালো খেলি না? তা করেননি। তবে এই দাবি করছেন, ‘বলতে পারব না যে বেশি উজাড় করে দিয়ে খেলছি কি না। আসলে ছয় মাস পর জাতীয় দলে খেলছি, দীর্ঘ বিরতির কারণে একটু রোমাঞ্চ, একটু স্নায়ুচাপ তো থাকেই। চেষ্টা ছিল যে শুরুটা ভালোভাবে করতে পারি। ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে অবদান রাখতে পেরেছি। সেটা অবশ্যই ভালো লাগার বিষয়। এখন চেষ্টা থাকবে আত্মবিশ্বাসটা যেন ধরে রাখতে পারি।’

নিজের কাজটা ঠিকমতো করতে পারছেন কি না, দিন শেষে নিজের নিক্তিতে সেটা মেপে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারলেই সাকিব খুশি। স্তাবকের ফুলমাল্য বা নিন্দুকের গালমাল্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ই নাকি নেই, ‘এসব নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তা করি না। আমার দায়িত্ব–কাজ দলে অবদান রাখা, দলের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। ওটাতেই সব সময় মনোযোগ রাখি।’

কিন্তু দিন শেষে তিনিও তো মানুষ। একজনের সঙ্গে ঝগড়া হলেই অনেকের রক্তচাপ বেড়ে যায়। আর সামাজিক মাধ্যমের এই যুগে প্রক্ষালণকক্ষে বসে যে কাউকে গালি বা জ্ঞান দেওয়ার এই যে প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, এতে তো তাঁর কাজ আরও কঠিন। এই চাপ কীভাবে সামলান? সাকিবের কাছে এবার আসল উত্তর মিলল। তিনি জানেন, নিজের কাজটা ঠিকমতো করতে পারলে সব ডাবলিনের সামার—মানে ঠান্ডা আরকি!

তবে এমন অনেক বিতর্ক আছে, যেগুলোতে মনে হয়েছে, কোথাও যেন বোঝাবুঝির সমস্যা আছে। সাকিবকে কি বেশির ভাগ সময় সবাই ভুল বোঝে? এর উত্তরে সাকিব ফ্যাকাশে এক হাসি হাসলেন। তবে বলে দিলেন, এই যে চাপের জীবন, এটা কঠিন। আর তিনিও কঠিনেরেই ভালোবাসিলাম মন্ত্রটা পড়ে নিয়েছেন ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার সময়টাতেই।

বাংলাদেশের সব অঙ্গন মিলিয়েই এক নম্বর তারকা হওয়াটা, সব সময় আতশকাচের নিচে থাকা, ব্যক্তিগত জীবনও সংবাদের বিষয় হয়ে ওঠা—এর সবই সাকিব উপভোগ করেন বলেই জানালেন, ‘আমার কাছে ভালো লাগে। জানি না কারণটা কী। ঠিক আছে, এ রকম যে পরিস্থিতি হতে পারে একজন ক্রিকেটারের জীবনে, শৈশবে আমার যাঁরা কোচ ছিলেন, খেলা শিখিয়েছেন; তাঁরা তখনই বুঝিয়ে বলেছিলেন। তাঁদের কাছে এসব শুনে বড় হয়েছি। তাই নতুন করে কিছু মনে হয় না। যখন খেলা শুরু করেছি, তখন থেকে এটা মেনে নিয়েই চলছি।’