কোন কোন জায়গায় পিছিয়ে পড়ল লিভারপুল?

এক পয়েন্টের আক্ষেপ রয়েই গেল লিভারপুলের। ছবি : এএফপি
এক পয়েন্টের আক্ষেপ রয়েই গেল লিভারপুলের। ছবি : এএফপি
>

এক পয়েন্টের জন্য ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা হাতছাড়া হলো লিভারপুলের। ইংলিশ লিগের সেরা হওয়ার জন্য লিভারপুলের অপেক্ষা ঠেকল তিরিশ বছরে। পয়েন্টের দিক দিয়ে নিজেদের ইতিহাসের সেরা মৌসুম কাটানোর পরেও শিরোপা এল না তাদের ঘরে। কিন্তু কেন এল না? কী কমতি ছিল লিভারপুলের?

শিরোনাম দেখে অনেক লিভারপুল সমর্থক তেড়ে আসতে পারেন। বিশেষ করে ‘কমতি’ শব্দটি দেখে। লিভারপুলের কী আসলেই কোনো ‘কমতি’ ছিল এ মৌসুমে? ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের সর্বোচ্চ পয়েন্টই যেখানে আগে ছিল ৯১, সেখানে লিভারপুল পেয়েছে ৯৭! এত পয়েন্ট নিয়েও দলটা খালি হাতে ফিরল! কেন এমনটা হলো এ গবেষণা হতেই পারে। ৯৮ পয়েন্ট নিয়ে শিরোপা জিতেছে ম্যানচেস্টার সিটি। ইয়ুর্গেন ক্লপের দল ঠিক কোন জায়গায় পেপ গার্দিওলার দলের চেয়ে পিছিয়ে পড়ল, এ নিয়ে প্রথম আলোর বিশ্লেষণ...

সেই সেট পিস সমস্যা
গত কয়েক মৌসুমের তুলনায় এই মৌসুমে লিভারপুলের রক্ষণভাগ ভালো খেলেছে। এবারের লিগের সেরা রক্ষণভাগ লিভারপুলেরই ছিল, এমনটা বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হয় না। বিশেষত ভার্জিল ফন ডাইক আসার পর থেকে লিভারপুলের রক্ষণভাগের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। আগে লিভারপুলের রক্ষণভাগের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সেট পিস (ডি বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি-কিক, কর্নার) ঠিকমতো সামলাতে না পারা এখন সেই সমস্যা কমে গেছে অনেকটাই। তবে এখনো যে লিভারপুলের খেলোয়াড়দের মাথায় সেটপিসের ভীতি মাঝেমধ্যে হানা দেয়, সেটি বোঝা গেছে লেস্টার সিটি আর ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেডের বিপক্ষে দুই ম্যাচে। দুই ম্যাচেই প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিল লিভারপুল। পরে দুটি সেট পিস থেকেই হজম করতে হয় গোল। এই দুটি ম্যাচে হারানো পয়েন্টই শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হলো। এই দুই ম্যাচ থেকে ৪ পয়েন্ট পেলে আজ হয়তো লিভারপুলই লিগ জিতত।

গোললাইন প্রযুক্তি
পুরো মৌসুমটা লিভারপুলের সমর্থকেরা অবশ্যই চিরদিন মনে রাখবে। তবে এই ‘মনে রাখা’র একটা বড় অংশ জুড়ে থাকবে গোললাইন প্রযুক্তি। এটি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে না থাকলে হয়তো লিগই জিতে যেত তারা। ম্যানচেস্টার সিটির মাঠে গিয়ে এ মৌসুমে ২-১ গোলে হেরেছিল লিভারপুল। এই ম্যাচে সাদিও মানের একটা দুর্দান্ত শট ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক এডারসনের গায়ে লেগে প্রতিহত হয়। পরে গোললাইনের ওপর থেকে সেটি ক্লিয়ার করে জন স্টোনস। গোললাইন প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখা যায়, অল্পের জন্য বলটি গোললাইন পার করেনি। গোলটা হলে সে ম্যাচে লিভারপুলকে হারতে হয় না, ম্যাচটি ড্র হয়ে যায়। সেই এক পয়েন্ট পেলে লিভারপুলের হয়তো শিরোপা জেতাটা সহজ হয়ে যেত।
গোললাইন প্রযুক্তি যেমন লিভারপুলের সহায় হয়নি, ঠিক তেমনি ম্যানচেস্টার সিটিকে দারুণভাবে সহায়তা করেছে। এই তো লিগের শেষ দিকেই বার্নালির মাঠে ১-০ গোলের কষ্টার্জিত হয়ে পেয়েছিল সিটি। সে ম্যাচে আগুয়েরোর একটি শট গোললাইন থেকে ক্লিয়ার করেছিলেন বার্নলি ডিফেন্ডার বেন মি। গোললাইন প্রযুক্তি সেটিকে ‘গোল’ ঘোষণা করে। সেই গোল না হলে সিটি ড্র করে ফিরত। ফলে লিভারপুলের শিরোপা জয় অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যেত।

স্কোয়াডের শক্তি
গতবার বেশ কয়েকজন নতুন খেলোয়াড় দলে এনে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করেছিল লিভারপুল। অ্যালিসন বেকার, নাবি কেইটা, জের্দান শাকিরি, ফাবিনহো— এই চারজন এই মৌসুমে মূল একাদশের শক্তি বৃদ্ধি করেছেন। কিন্তু মূল একাদশের বাইরে বেঞ্চের খেলোয়াড়দের শক্তিমত্তার দিক দিয়ে সিটির চেয়ে লিভারপুল বেশ দুর্বল ছিল। সিটির ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় রিয়াদ মাহরেজ মূলত বেঞ্চের খেলোয়াড়। মূল স্ট্রাইকার সার্জিও আগুয়েরোর বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে আছেন ব্রাজিলের মূল স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল জেসুস। গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের সেরা তরুণ খেলোয়াড় লিরয় সানে আর সবচেয়ে দামি ইংলিশ সেন্টারব্যাক জন স্টোনসও বেঞ্চেরই খেলোয়াড়।

ফলে সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা যদি মূল একাদশের খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দিয়ে বেঞ্চের খেলোয়াড়দের বাজিয়ে দেখতে চান, সিটির মূল একাদশের শক্তির হেরফের হয় না। গত কয়েক মৌসুম ধরে আদর্শ খেলোয়াড় কিনে কিনে নিজেদের শক্তির মাত্রা এভাবে বাড়িয়েছে সিটি। লিভারপুলের ক্ষেত্রে এই কথা বলা যায় না। দলের মূল তিন ফরোয়ার্ডের যোগ্য বিকল্প এখনো বেঞ্চে নেই। রবার্তো ফিরমিনো না থাকলে দলের আক্রমণ অনেকটাই ভোঁতা হয়ে যায়। উপযুক্ত বিকল্প নেই মোহাম্মদ সালাহ আর সাদিও মানেরও। লেফটব্যাক হিসেবে ম্যাচের পর ম্যাচ খেলে যাচ্ছেন অ্যান্ডি রবার্টসন, কেননা বিকল্প হিসেবে থাকা আলবার্তো মোরেনোর ওপর কোচ ক্লপের আস্থা নেই। এই মোরেনোর ভুলেই দুই বছর আগে ইউরোপা লিগের শিরোপা হারিয়েছিল লিভারপুল। বিকল্প স্ট্রাইকার হিসেবে দলে থাকা ড্যানিয়েল স্টারিজের আর সেই ফর্ম নেই। ডিভক অরিগি মৌসুমের শেষ দিকে বেশ কিছু গোল পেলেও তিনি যে ভরসা করার মতো স্ট্রাইকার, এটা কোনো পাঁড় লিভারপুল ভক্তও বলবেন না। লিগ জয়ের জন্য স্কোয়াডের শক্তিটা যে বাড়তি হওয়া প্রয়োজন, এবারের মৌসুমে সেটি দেখিয়েছে সিটি।

ইয়ুর্গেন ক্লপ কি এসব সমস্যাগুলো সমাধান করে সামনের মৌসুমে লিগ জিততে পারবেন? আবারও অপেক্ষাতেই থাকতে হচ্ছে লিভারপুল সমর্থকদের।