মাশরাফির আছে জাদুর কাঠি

>মাশরাফি বিন মুর্তজা মানেই উজ্জীবিত বাংলাদেশ! মাঠে ও মাঠের বাইরে দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখা অধিনায়ককে নিয়ে লিখেছেন বাঁহাতি স্পিনার আবদুর রাজ্জাক

বন্ধুত্বের দাবি আমি জানাতে পারি। দীর্ঘদিন একসঙ্গে খেলার অধিকারও খাটাতে পারি। কিন্তু জানি, কোনোটাই কাজে আসবে না শেষ পর্যন্ত। মাশরাফি বিন মুর্তজা আমার কাছে যেমন, আপনার কাছে, সবার কাছেই একটা খোলা বইয়ের মতো। তার গোপন কিছু নেই। মাশরাফি বাইরে যেমন ভেতরেও তেমন।

এই মাশরাফিকে নিয়ে চিন্তা করে বলার কিছু নেই। তার সম্পর্কে নতুন কিছু জানানোরও নেই। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই আমরা দেখেছি, তার চেষ্টা আর প্রতিজ্ঞার প্রতি সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়া। ভাগ্যেও অফুরান সমর্থন। হ্যাঁ, চোটজর্জর ক্যারিয়ার আর হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচার করিয়েও মাশরাফি ইংল্যান্ডে তার চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলতে গেছে, ভাগ্যের আশীর্বাদ আছে বলেই তো! আর আছে তার সাহস। অসম্ভবকে সম্ভব করার জেদ। ভাগ্যের সাহায্য অনেকেই পায়। কিন্তু সবার মধ্যে এই বাড়তি জিনিসগুলো থাকে না। সে জন্যই সবাই মাশরাফি নন। সবার হাতে নেই জাদুর কাঠি।

সবার কাছে একটা অনুরোধ। এই বিশ্বকাপ ২০১৯ মাশরাফির শেষ বিশ্বকাপ আমরা জানি। কিন্তু আমরা যেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেও তাকে এখনই বিদায় করে না দিই। বিশ্বকাপ ও আর খেলবে না বা খেলতে পারবে না। তবে মাশরাফি কিন্তু বলেনি যে সে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকেই সরে যাবে। এ ক্ষেত্রে ওর কথাটাকেই মূল্য দেওয়া উচিত। মাশরাফি যদি ঘোষণা দেয়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু ও বলার আগ পর্যন্ত এ নিয়ে কথা না বলাই ভালো।

এটা মাশরাফির চতুর্থ বিশ্বকাপ। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে খেললে পাঁচটা হতো। চোটের কারণে পারেনি। তবে চারটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলাও যা–তা ব্যাপার নয়। ২০০৩ সাল থেকে শুরু করে পাঁচটি বিশ্বকাপের সময় ধরে জাতীয় দলে নিজের অপরিহার্যতা ধরে রেখে খেলা চালিয়ে যাওয়া সামান্য বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় কথা, পারফরম্যান্সের কারণে মাশরাফি কখনো বাদ পড়েনি। যখন দলে ছিল না, চোটের কারণে ছিল না।

মাশরাফির এত লম্বা ক্যারিয়ার নিয়ে ওর ডাক্তারও বিস্মিত। গতবারের আগেরবার ও যখন ডেভিড ইয়াংকে দেখাতে গেল, অস্ট্রেলিয়ান এই ডাক্তার নাকি বলেছেন, ‘আমি বুঝে উঠতে পারি না, তুমি কীভাবে এখনো মাঠের মধ্যে খেলার চিন্তা করো, খেলো!’ কিন্তু ও তো খেলেই যাচ্ছে। হারার কথা চিন্তা করছে না। আয়ারল্যান্ডে দেশের পক্ষে প্রথম ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল জিতল, বিশ্বকাপ খেলবে, নিজেও ভালো খেলছে। এই বয়সে এসেও তার দলে থাকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এটা গোটা ক্রিকেট–বিশ্বেই বিশাল এক ব্যতিক্রম। ডেভিড ইয়াং তো এ রকম বড় বড় অস্ত্রোপচার আরও অনেক করেছেন। কিন্তু সবাই কি তাদের ক্যারিয়ার এত লম্বা করতে পেরেছে?

শুধু সতীর্থ নয়, দুজনের বন্ধুত্ব অনেক দিনের
শুধু সতীর্থ নয়, দুজনের বন্ধুত্ব অনেক দিনের

যদি বলেন মাশরাফি অন্যদের চেয়ে কোথায় আলাদা, আমি বলব ও খুব ডেডিকেটেড এবং সেটা কোন পর্যায়ে, তা কল্পনা করাও কঠিন। সে যেটা করবে বলে ঠিক করে, সেটা করে ছাড়ে। যত ঝড়-ঝাপটাই আসুক না কেন, মাশরাফিকে তা থেকে টলানো যাবে না। বিশেষ করে যদি সে বুঝে ফেলে, এটাই তার করা উচিত। ওর সবচেয়ে বড় গুণ বলি আমি এটাকেই। মানসিকভাবে অনেক দৃঢ় মাশরাফি। যে কাজটা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা যেমন করে; যেটা করবে না বলে ঠিক করে, সেটাও তাকে দিয়ে আপনি আর করাতে পারবেন না। 

একটা মানুষ যখন হাজারো বাধাবিপত্তি পার হয়ে এত দূর যায়, বুঝে নিতে হয় সে কোনো মিথ্যা বা বানোয়াট জিনিসের ওপর ভর করে জীবন কাটাচ্ছে না। তার সবটাই আসল। আমরা ওকে বাইরে থেকে যে রকম দেখি বা আপনারা যে রকম দেখেন, ওর ভেতরটাও একদমই সে রকম। আরোপিত কিছু নেই। কোনো ভান নেই। সবার মধ্যে এই জিনিসটা পাবেন না। সঙ্গে ওর ক্রিকেট–প্রতিভা তো আছেই। আমার চোখে বাংলাদেশে এত দিনে যত ক্রিকেট খেলোয়াড় এসেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান হচ্ছে মাশরাফি।

আর দূরদর্শিতা তো আছেই। মাশরাফির সঙ্গে সেই অনূর্ধ্ব-১৭ ক্রিকেট থেকে একসঙ্গে খেলেছি। আমাদের যখন একটু চিন্তাভাবনা করতে পারার বয়স হলো, মোটামুটি সবকিছু বুঝতে শিখলাম, তখন থেকেই ও বলত—বড় হয়ে এই করবে, সেই করবে। আসলেই করার পরিকল্পনা করত কি না জানি না, তবে ও বলত। এমনও বলত, ‘আমি এমপি হলে দোস্ত কেমন হবে?’ এটা অনেক আগের কথা, যখন আমরা জাতীয় দলে নতুন। আমি পাত্তা দিতাম না। বলতাম, ‘কী আর হবে! তুই এমপি হবি, রাজনীতি করবি, এই তো।’ এ রকম কথাগুলো বলে সঙ্গে সঙ্গে ও চুপ হয়ে যেত। কিছু একটা ভাবত। এখন মনে হয়, সে হয়তো তখনই ঠিক করে নিত ভবিষ্যতের করণীয়।

অধিনায়ক হিসেবে যদি বলেন, আমি বিচক্ষণ শব্দটাই ব্যবহার করব মাশরাফি জন্য। সিদ্ধান্ত নেওয়া বা না নেওয়ার ব্যাপারগুলো সাধারণত একই ধরনের হয় প্রত্যেক অধিনায়কের জন্য। কিন্তু সিদ্ধান্তটাতে সফল হওয়াটাই হচ্ছে বড় ব্যাপার। যে যত বেশি বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তারটা তত বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সব অধিনায়কই অনেক ভেবেচিন্তে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সফল সবাই হয় না। এদিক দিয়ে মাশরাফি অনেকের চেয়ে এগিয়ে। একইভাবে ও খুব হিসেবিও। মাঠে বা দলের মধ্যে সিদ্ধান্তগুলো অনেক হিসাব-নিকাশ করেই নেয় ও। দেখা গেল ম্যাচ নিয়ে আমাদের কিছু বলছে, এই হতে পারে, ওই হতে পারে বলতে বলতে সে ম্যাচের শেষ পর্যন্ত চলে যায়। এখানে ওকে দাঁড় করাব, ওই সময় তাকে বোলিং দেব বা অমুক ব্যাটিং করবে, বোলিংটা এভাবে করতে হবে। যেন ম্যাচটা কীভাবে কীভাবে আগাবে, সব ও দেখতে পাচ্ছে। অনেক সময় ও রকম হয়েও যেতে দেখেছি।

খেলাটার ভবিষ্যৎ যেমন ওর কল্পনায় ফুটে ওঠে, একইভাবে ও জানে কাকে দিয়ে কী করাতে হবে। কে কী পারবে, কে কী পারবে না। এ কারণে খেলোয়াড়দের খারাপ সময়েও মাশরাফিই বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় ভরসা। ধরুন, তামিমের খারাপ সময় যাচ্ছে, এখন অধিনায়কের কাজ কিন্তু শুধু তামিমকে উৎসাহ দেওয়া নয়। একই সঙ্গে তাকে ওই জায়গাটার কথা ভাবতে হয়। তামিমের জায়গা থেকে কীভাবে ভালো রান আসবে। বাজে সময়ে আমাদের দেশে খেলোয়াড়দের অনেক টেনশনে থাকতে হয়। বাদ পড়া নিয়ে টেনশন। এখন অধিনায়ক যদি ওই খেলোয়াড়টাকে বলে দেয়, ‘তুই টেনশন করিস না। তুই খেলবি’, এটা কিন্তু তার জন্য বিরাট একটা সাহস। মাশরাফি খুব ভালো জানে কাকে কী বললে অনুপ্রাণিত হবে। তামিমের জন্য এই কথাটা দরকার, সাকিবকে ওভাবে বলতে হবে। হয়তো এ কারণেই বোর্ডও ওকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা বেশি দেয়।

এই সবকিছুর সঙ্গে আর যেটা মাশরাফিকে লাল-সবুজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতীক করে দিয়েছে, সেটা হলো তার অসামান্য দেশপ্রেম। ও মনেপ্রাণে চায়, বাংলাদেশ জিতুক। বাংলাদেশ দল ভালো জায়গায় যাক। তার জন্য যা যা করা দরকার ও তাই করতে প্রস্তুত। কিন্তু এটা আপনি সব সময় ওকে দেখে বুঝবেন না। এশিয়া কাপের ফাইনালে হারার পর আমরা অনেকেই মাঠে কেঁদেছি। মানুষ জেনেছে আমরা আবেগ সামলাতে পারিনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে এটা আমার পছন্দ নয়। আমি খেলতে এসেছি, মানুষের সহানুভূতি কুড়ানোর জন্য আসিনি। খারাপ আমাদের সবারই লেগেছে। যে কেঁদেছে তারও লেগেছে, যে কাঁদেনি তারও লেগেছে। এখানে এটা বলার কারণ, মাশরাফির মধ্যে এই জিনিসটা আপনি কখনো পাবেন না। মানুষকে নিজের আবেগ-অনুভূতি দেখানোর জন্য ও কিছু করে না। ও চায় ফলাফলটা দেখাতে। ফলাফল ভালো হলে আপনি এমনিই বলবেন অধিনায়কের দূরদর্শিতার কারণে এটা হয়েছে। খারাপ হলে বলবেন অধিনায়ক ঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেনি।

আমার কেন জানি মনে হয়, বাংলাদেশ দল এবার বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারে। আমি বিশ্বাস করেই বললাম কথাটা। কদিন আগে আমি একটা টুইট করেছিলাম। আমি লিখেছি, আমাদের এবারের বাংলাদেশ দলটা ব্যাটিংয়ের দিক দিয়ে সেরা। এর আগে আমরা যত ব্যাটিং অপশন নিয়ে খেলেছি, এটা তার মধ্যে সেরা। আমাদের চার জন্য ব্যাটসম্যান আছে যারা এক শর বেশি ম্যাচ খেলেছে। বাকিদের ছোট না করেই বলছি; তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ—এই চারজন আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান, নির্ভরযোগ্য স্তম্ভ। আমার মনে পড়ে না এ রকম লাইনআপ নিয়ে আমরা কখনো বড় টুর্নামেন্টে গেছি। হ্যাঁ, ওরা আগেও একসঙ্গে খেলেছে। কিন্তু এখন যতটা পরিণত, তখন ততটা ছিল না। বিশ্বকাপের আগে সবাই ফর্মে আছে, ভালো খেলছে—এটাই সবচেয়ে বড় সাহস। বোলারদের অসাধারণ কিছু করার দরকার নেই। স্বাভাবিক কাজটা করতে পারলেই বিশ্বকাপে আমাদের দলের পক্ষে ভালো কিছু অর্জন করা সম্ভব হবে।

মাশরাফিসহ আমাদের অভিজ্ঞ যে পাঁচজন, তাদের সবাই-ই আসলে একেকজন অধিনায়ক। তাদের নিয়ে বলার কিছু নেই। তরুণেরাও এর মধ্যেই নিজেদের প্রমাণ করেছে, যেটা আমরা ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়েও দেখেছি। তাদের শুধু মাঝেমধ্যে একটু উসকে দিতে হবে। উৎসাহ দিতে হবে। এ কাজেও সেরাদের সেরা জনই আছে আমাদের ড্রেসিংরুমে। যার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বাংলাদেশ দলটাই আজ অন্য চেহারায়—মাশরাফি বিন মুর্তজা।

অনুলিখন: তারেক মাহমুদ