কল্পনার ছবিটাকেও ছাড়িয়ে...

উৎপল শুভ্র
উৎপল শুভ্র

শুরুর একটা ছবি তো মনে আঁকাই ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার। সেই ছবিটা কি এত সুন্দর ছিল? মনে হয় না। এতটা তিনি কীভাবে ভাববেন! কীভাবে ভাববেন, ২০ বছর পর বিশ্বকাপ অভিষেকের বিলেতে ফিরে শুধু বিশ্বকাপেই নয়, ওয়ানডেতেই নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড গড়ে ফেলবে বাংলাদেশ! সেটিও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, যে দলের বোলিং আক্রমণ বর্তমান ওয়ানডে ক্রিকেটে সেরা কি না, এই আলোচনা হয়।

বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে যে দলটি নিয়ে মাঠে নেমেছেন, সেটি আট-নয় মাস আগেই মাশরাফির ঠিক করে রাখা। গত সেপ্টেম্বরে দুবাইয়ের এক তপ্ত দুপুরে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের পেছনে তাঁকে নিয়ে একান্ত একটা আড্ডায় বসেছি। সেখানেই বিশ্বকাপে তাঁর প্রথম একাদশ জানিয়ে দিয়েছিলেন অধিনায়ক। ‘আমার বিশ্বকাপ দল আমি পেয়ে গেছি। নামগুলো লিখেও নিতে পারেন’-বলার পর ব্যাটিং অর্ডার ধরে এগারোটা নাম বলে দিয়েছিলেন। পুরোনো নোটবুক বের করে যাতে একটাই পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। মাশরাফির প্রথম একাদশে শুধু মোসাদ্দেকই ছিলেন না, সেখানে ছিলেন লিটন কুমার দাস। ওপেনিংয়ে তামিম আর লিটন, তিনে সৌম্য।

পরদিন এশিয়া কাপ ফাইনাল। অধিনায়কের মস্তিষ্ক সেটির রণকৌশল নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা। সেটির মধ্যেও বিশ্বকাপ ঠিকই উঁকি দিচ্ছিল। বলতে গেলে দুই বছর আগে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলার সময় থেকেই তো মাশরাফি ভাবতে শুরু করেছিলেন এই বিশ্বকাপ নিয়ে। মাঝখানে রাজনীতিতে অতর্কিত আমন্ত্রণ ঝড় তুলেছিল তাঁর মনোজগতে। ‘পাখির চোখ’ থেকে একটু সরিয়েও দিয়েছিল মাশরাফির মন। তিনি মাশরাফি বলেই রাজনীতির হাত ধরে আসা হাজারো ঝুটঝামেলা সামলে ঠিকই নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন বিশ্বকাপের জন্য। ক্রিকেটের অধিনায়ককে তো শুধু নিজের প্রস্তুতি নিয়ে ভাবলেই চলে না, বরং কখনো কখনো সেটির জন্যই সবচেয়ে কম সময় মেলে। মাশরাফি প্রস্তুত করে নিয়েছেন তাঁর দলকেও।

এর চেয়েও বড় একটা কাজ ছিল। বাংলাদেশ দলকে ঘিরে আমজনতার পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশাকে বাস্তবতার জমিনে নামিয়ে আনা। দেশ ছাড়ার আগে শেষ সংবাদ সম্মেলনে সেই চেষ্টাই করে গেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের আগে মনস্তাত্ত্বিক খেলার বদলে প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষকে ‘ফেবারিট’ বলে স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়াও সেটিরই একটা অংশ। ভুল বলা হলো। এটিও তো একধরনের মনস্তাত্ত্বিক খেলারই অংশ। ইতিবাচকতাকে যাঁর নামের প্রতিশব্দ বলা যায়, তিনি নিশ্চয়ই ড্রেসিংরুমে জিগীষাই ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে সানন্দে নিজেদের আন্ডারডগ বলে মেনে নিয়ে চাপের পুরোটাই রপ্তানি করে দিতে চেয়েছেন প্রতিপক্ষের ড্রেসিংরুমে। ‘চাপ’ শব্দটাকে দক্ষিণ আফ্রিকানরা কেমন যমের মতো ভয় পায়, এটা কে না জানে! ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে ‘ওপেন সিক্রেট’ কি এটাই নয়!

মনে মনে একটা ছবি অবশ্যই আঁকা ছিল মাশরাফির। তাতে কি টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করা ছিল? ঠিক নিশ্চিত নই। ওভালে উদ্বোধনী ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করেই জিতেছে ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের প্রথম তিন দিনে তিন শ ছাড়ানো স্কোরের একমাত্র ব্যতিক্রমও সে ম্যাচেই। একই প্রতিপক্ষ, একই মাঠ এবং খেলাটাও সেই একই উইকেটে। পরে বোলিং করলে সেখানে স্পিনারদের বাড়তি একটু সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। তার ওপর তাড়া করার সময়ই নিজেদের ‘চোকার্স’ পরিচয়টা বেশি ফুটিয়ে তোলে প্রোটিয়ারা। এটা জানা থাকার পরও মাশরাফি টসে জিতলে প্রথমে ব্যাটিং নিতেন কি না, সংশয় থাকছে। টসের পর প্রশ্নটা তিনি এড়িয়ে যাওয়াতে যে সংশয়টা আরও বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে, টসটা হেরে কী ভালোই না হয়েছে!

তামিম আর সৌম্যর কাছ থেকে যা চেয়েছিলেন, তা-ই পেয়েছেন। সাকিব আর মুশফিকের কাছ থেকেও। মাহমুদউল্লাহ আর মোসাদ্দেকের কথাই বা বাদ থাকে কেন! তাঁরা দুজনও তো অধিনায়কের মনে মনে সাজানো পাণ্ডুলিপি মেনেই যেন নিখুঁত ‘অভিনয়’ করলেন। ইমরান তাহির একটু ঝামেলা করতে পারেন, এটাও পাণ্ডুলিপিতে থাকার কথা। সেটি করলেনও দক্ষিণ আফ্রিকান লেগ স্পিনার। ২০১৯ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বয়সী খেলোয়াড় হয়েও উইকেট পাওয়ার আনন্দে যিনি কিশোর হয়ে যান। মাঝখানে একটু পথ হারিয়ে ফেলার আতঙ্কটাও তাঁরই ‘উপহার’। সেটি সামলে বাংলাদেশে ইনিংসের শেষটা তুলির পোঁচ নয়, যেন ব্রাশের স্ট্রোক। মাশরাফির মনে আঁকা ছবিটাতেও এমন ছিল বলে মনে হয় না। বিশ্ব ক্রিকেটে বেশির ভাগ দলের মতো বলে-কয়ে যেখানে তিন শই করতে পারে না বাংলাদেশ, সেখানে ৩৩০-এর কথা কীভাবে ভাববেন অধিনায়ক!

টি-টোয়েন্টিপ্রসূত উদ্ভাবনী ব্যাটিং, ভারী ব্যাট আর দুই প্রান্ত থেকে দুটি নতুন বল মিলিয়ে তিন শ রান অনেক দিনই ওয়ানডেতে জয়ের নিশ্চয়তা নয়। তবে ৩০০ আর ৩৩০ তো আর এক নয়! বাংলাদেশ যেমন রেকর্ড গড়েছে, এই ম্যাচে জিততে রেকর্ড গড়তে হতো দক্ষিণ আফ্রিকাকেও। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড।

এই দিনে কি আর তা হওয়ার কথা! এটি যে মাশরাফির মনে আঁকা ছবিটাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার দিন!