মেসি কেন পারেন না: বিবিসির বিশ্লেষণ (প্রথম পর্ব)

লিওনেল মেসি এ রকমই একটা মঞ্চে দাঁড়াতে চান, তবে খালি হাতে নয়। ছবি: রয়টার্স
লিওনেল মেসি এ রকমই একটা মঞ্চে দাঁড়াতে চান, তবে খালি হাতে নয়। ছবি: রয়টার্স
>ফুটবল বিশ্বের এ এক অমীমাংসিত রহস্য। আন্তর্জাতিক ফুটবলে কেন একটিও শিরোপা জিততে পারেননি লিওনেল মেসি? আরও একটি কোপা আমেরিকা শুরু হলো, গত দুই আসরে যে টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেও মেসির আর্জেন্টিনা শিরোপা জেতেনি। মেসির এই না-পারা নিয়ে বিবিসির বিশেষ বিশ্লেষণ দুই পর্বে প্রকাশিত হবে প্রথম আলো অনলাইনে। মার্টিন মাজুরের মূল রচনা অনুবাদ করেছেন রেজওয়ান রহমান

তখন তিনি খুব তরুণ ছিলেন, খুব লাজুক ছিলেন, ছিলেন বিশেষ কিছু। 

তাঁর বিশেষত্বের ব্যাপারটি জানত আর্জেন্টিনা। দুর্লভ রত্নকে গড়তে হবে যত্ন দিয়েই, জানত এটিও।
কিন্তু ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে তাঁর অভিষেকের ১৪ বছর পরেও আর্জেন্টিনা তাকে পরিপূর্ণরূপে গড়তে পারল কই! এখনো জাতীয় দলের হয়ে নিজের সেরা রূপে ধরা দেননি মেসি, এদিকে সময় যে ফুরাল।
নিজ দেশকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করতে গেলেই ৩২ বছর বয়সী মেসির কী যেন হয়, বারবারই যেন কোনো চক্রে আটকে ফেলেন নিজেকে।

প্রত্যেক টুর্নামেন্টের আগে তাঁকে ঘিরে আশার জাল বোনা হয় এবং প্রত্যেক বারই তা হতাশায় রূপ নিয়ে শেষ হয়। অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল। ২০০৫ সালে অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে শিরোপা জয় করেছিলেন, জয় করেছিলেন তিন বছর পরের বেইজিং অলিম্পিকের সোনাও। কিন্তু মূল জাতীয় দলের হয়ে? জিততে পারেননি একটি আন্তর্জাতিক ট্রফিও।

‘কতবার ব্যর্থ হয়েছে এটা কোনো ব্যাপার নয়; ব্যাপার হলো, প্রত্যেকবারই আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে, চেষ্টা করতে হয়েছে। ছোটদের জন্য এটা একটা ভালো বার্তা, কেবল ফুটবলে নয়, জীবনে চলার পথেও। আমি আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জিতেই অবসরে যেতে চাই’—কথাটি মেসি বলেছেন এ মাসেই।

ব্রাজিলে কোপা আমেরিকা শুরু। মেসি জানেন, দেশের হয়ে কোনো বড় শিরোপা জয়ের শেষ কিছু সুযোগের একটি হতে যাচ্ছে এটি। ফুটবল জীবনের সবচেয়ে বাজে কিছু মুহূর্ত কেটেছে যে শিরোপার পিছু ছুটে, কিন্তু এখনো তা অধরাই রয়ে গেছে।
৬৭ গোল নিয়ে আর্জেন্টিনার ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসি-ই। জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে মাঠে নামার রেকর্ডটিও খুব বেশি দূরে নয়। ১৪৭ ম্যাচে মাঠে নেমে যে রেকর্ডের মালিক হাভিয়ের মাচেরানো, তাঁর চেয়ে মেসি কম খেলেছেন ১৭ ম্যাচ।

কিন্তু আজ অব্দি আর্জেন্টিনার হয়ে যে আটবার বড় কোনো টুর্নামেন্টে নেমেছেন মেসি (চারটি বিশ্বকাপ, চারটি কোপা আমেরিকা) প্রত্যেকবার একটি প্রশ্নই মনের কোণে উদিত হয়েছে: সেই মেসি কোথায়, যাকে আমরা প্রতি সপ্তাহে বার্সেলোনার জার্সিতে দেখি?
মেসির এই দুই সত্তা নিয়ে অভিযোগ তো ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই আছে। যে মেসির একপাশে পাওয়া যায়, পেপ গার্দিওলার অধীনে, পৃথিবীর সবচেয়ে দারুণ দলগুলোর একটির হয়ে, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা আর জাভিকে পাশে নিয়ে সবকিছু জয়ী এক ফুটবলারকে।

আর অন্যপাশে, বিক্ষুব্ধ, অহংবোধে পরিপূর্ণ একজাতীয় দলের হয়ে অস্বস্তিতে ভোগা এক ফুটবলারকে, যাদের হয়ে টানা ১৬ ম্যাচে গোলখরায় ভোগার ইতিহাসও তাঁর আছে।
প্রত্যেক কোপা আমেরিকাই তাই বিপর্যয় নিয়ে সামনে আসে। প্রত্যেক বিশ্বকাপ আসে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ জানিয়ে। প্রত্যেকবার টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়ের পরে আর্জেন্টাইনরা যখন সমালোনায় বিদ্ধ করে, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে মেসিকে ভেঙেচুরে ফেলেতে চেয়েছে, মেসি দ্রুত স্পেনের বিমানে চড়েছেন, স্পেনে পা রেখেই যেন কোনো জাদুর স্পর্শে, আর্জেন্টিনায় পাওয়া আঘাত পরিপূর্ণরূপে সারিয়ে ফেলেছেন।

জাতীয় দলে সতীর্থেরাই মেসির প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে যেন! ছবি: রয়টার্স
জাতীয় দলে সতীর্থেরাই মেসির প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে যেন! ছবি: রয়টার্স

বার্সেলোনা তাঁর জন্য সব সময়ই আশ্রয় হয়েছে, তাঁকে নিয়ে ওঠা সন্দেহকে বাতাসে মিলিয়ে দিয়েছে, তাঁর নেতৃত্বগুণকে আবারও জাগিয়ে তুলেছে। অবশ্য, প্রত্যেকবার বার্সেলোনার হয়ে তাঁর নবজাগরণ সাগরের ওই পাড়ে আর্জেন্টাইনদের মনে প্রশ্নও জাগিয়েছে। ওখানেই কেন, এখানে নয় কেন? আমরা কি ভুল কিছু করছি ওর সঙ্গে? ওর আর কী দরকার? প্রত্যেকবার নতুন করে জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে প্রত্যাশা বেড়েছে। তার কাছে আশা বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে নিন্দুক বেড়েছে। বারবারই এই চক্র ঘুরেফিরে এসেছে।

অবশেষে এই চক্রে মোচড় এসেছে। এবার বার্সেলোনা থেকে মেসি এসেছেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে।

লিভারপুলের কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে পরাজিত হয়েছেন অপ্রত্যাশিতভাবে, পরপর দুই বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বাদ পড়েছেন অসম্ভবকে সম্ভব করে। এর পরে আবার হেরেছেন ভ্যালেন্সিয়ার কাছে, কোপা দেল রের ফাইনালে। যদিও তাঁর নেতৃত্বে লা লিগার শিরোপা ধরে রেখেছে তাঁর দল বার্সেলোনা, কিন্তু এই বছরে সমর্থকদের চাওয়া ছিল আরও বেশি। একই সঙ্গে গুঞ্জন উঠেছে, মেসি আর সুয়ারেজ ইতিবাচক নেতা হয়ে উঠতে পারেননি ড্রেসিংরুমে। সব মিলিয়ে বার্সেলোনার হয়ে বিপর্যস্ত এক মৌসুমই কাটিয়েছেন যেন!

কেমন হবে, যদি এবারে সেই ধারা ভাঙে? কেমন হবে, আর্জেন্টিনা মেসির দুর্দিনের সহায় হলে?

শেষবার আর্জেন্টিনা বড় কোনো শিরোপা জয় করে পোডিয়ামে দাঁড়িয়েছিল ১৯৯৩ সালে। মাঝের এই সময়ে তাঁরা চারবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে (২০০৪, ২০০৭, ২০১৫, ২০১৬) এবং ২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল উঠেছিল। এই পাঁচ ফাইনালের চারটিতেই আর্জেন্টিনা পরাজিত হয়েছিল মেসিকে নিয়ে। মেসি সে ম্যাচগুলোতে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে, পারেননি কোনো গোল করতে।

আর্জেন্টিনার এই ২৬ বছরের শিরোপা খরার কারণে সমর্থকদের ভেতরেও দ্বিধা-বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। কেউ মেসিকে দেখতে চান রক্ষাকর্তা রূপে, কেউবা অপেক্ষা করেন তাঁর ভরাডুবির জন্য, যেন তারা তাঁকে আবারও ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে পারেন। আরও এক বড় টুর্নামেন্টে নামার আগে, আর্জেন্টিনার অধিনায়ককে ঘিরে তর্ক আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুই পক্ষ দুই প্রান্তে দাঁড়িয়েছে, সম্ভবত সবচেয়ে পরস্পরবিরোধী হয়ে।

নতুন প্রজন্মের কাছে মেসি ঈশ্বরতুল্যই। ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে তাঁর তুলনা হওয়া অবধারিত, আর বয়স্কদের চোখে তিনি কখনোই ম্যারাডোনা হতে পারবেন না। তিনি কখনো একা হাতে বিশ্বকাপ জেতাতে পারবেন না, যেমনটা ম্যারাডোনা করেছিলেন ১৯৮৬-তে। আর যদি কোনোক্রমে করেও ফেলেন, তা ম্যারাডোনা হওয়ার মতো যথেষ্ট হবে না।

জাতীয় দলে খেলা শুরুর দিন থেকেই, স্বার্থপরতার অভিযোগ ছুটে যায় তাঁর দিকে। জাতীয় সংগীতে গলা মেলান না, সতীর্থদের সঙ্গে খুব বেশি খাতির-দোস্তি নেই, ম্যানেজারের নির্দেশ মানেন না, যথেষ্ট যত্নশীল নন, যথেষ্ট গোল করেন না, না মাঠের ১০ নম্বর হতে পেরেছেন, না হতে পেরেছেন ৯ নম্বর, দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেন, দলের ট্যাকটিকস ভন্ডুল করেন, এমন অভিযোগও বেশ পুরোনো। ১৭ বছর বয়স থেকেই এ অপবাদগুলো তাঁর সঙ্গী, আজ তিন সন্তানের পিতা হয়েও খণ্ডাতে পারেননি অপবাদগুলো।

যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ পাঁচবার ব্যালন ডি'অর জয়ের পরে, ক্লাবের হয়ে সম্ভাব্য সবকিছু জয়ের পরে এ অপবাদগুলো বেশ অদ্ভুত শোনায়। তবে জাতীয় দলের হয়ে এক ম্যাচে খারাপ খেললেই, আর্জেন্টিনায় 'মেসি-হটাও' দাবি ডালপালা মেলে।
২০১৮ বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে মেসির প্রভাব ছিল সর্বোচ্চ, বলা যায় মেসির পায়েই বিশ্বকাপ খেলছিল আর্জেন্টিনা। জয় ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই, এমন ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে দলের রাশিয়া যাওয়া নিশ্চিত করেছিলেন তিনিই।

কিন্তু, বিশ্বকাপের মূলপর্ব একই চিত্রনাট্য অনুসরণ করেনি।

(বাকি অংশ আগামীকাল)