শিখর থেকে শিখরে বাংলাদেশ

সাকিব ও লিটনের দুর্দান্ত এক জুটি জেতাল বাংলাদেশকে। ছবি: শামসুল হক
সাকিব ও লিটনের দুর্দান্ত এক জুটি জেতাল বাংলাদেশকে। ছবি: শামসুল হক
বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের তোলা ৩২১ রান বাংলাদেশ পেরিয়ে যায় ৫১ বল হাতে রেখে। সাকিব করেছেন ১২৪ রান, লিটন ৯৪। চতুর্থ উইকেটে দুজনের ছিল ১৮৯ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি।

কখনো কখনো দীর্ঘ লাফ দিতে একটু ঝুঁকে কুঁজো হতে হয়। শরীরটাকে গুটিয়ে নিতে হয়। ধনুক থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে তিরটাকেও একটু পিছু হটতে হয়। গত দুই ম্যাচে সেই দমটা নিয়ে বাংলাদেশ আবারও লং জাম্প দিল যেন। শপাং করে বেরিয়ে গেল তিরের ফলা হয়ে।

বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপটা শুরুই করেছিল এক শিখর ছুঁয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পথে গড়েছিল ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোর। আজ আবার আরেক শিখর ছোঁয়া। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার নিজেদের নতুন কীর্তি। শুধু নিজেদের বলে নয়, বিশ্বকাপেই এটি যেকোনো দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার গৌরব।

পেস আর বাউন্সে উড়িয়ে দেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দীর্ঘদেহী ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলাররা ৯০ মাইল গতিতে বল করার অপেক্ষায়। ব্যাটসম্যানদের এনে দেওয়া ৩০০ ছাড়ানো এক স্কোরের পর বাংলাদেশকে গতিতে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাই করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। উড়ল ঠিকই, তবে সেটা বল আর উইন্ডিজদের দর্প। সাকিবের সামনে আজ যে সবাই নতজানু হলেন। সুযোগ পেয়ে লিটন দিলেন কী দারুণ সঙ্গ। তাঁরও সেঞ্চুরিটা প্রাপ্য ছিল। তা হলো না। কিন্তু এ নিয়ে আক্ষেপ করবেন না নিশ্চয়ই!

দুর্দান্ত বাংলাদেশের কাছে ৭ উইকেটে হারল উইন্ডিজ। তাও কেমন জয়? ৩২২ রানের লক্ষ্য। এ বিশ্বকাপে কোনো দল আড়াই শ তাড়া করে জেতেনি এখনো। তিন শ ছাড়ানো স্কোর মানেই জয়ের নিশ্চয়তা। সে ম্যাচে বাংলাদেশের ৪০তম ওভার যখন শেষ হলো, তখন স্কোরবোর্ডে লেখা ৩০৫! ৬০ বলে ১৭ রান দরকার বাংলাদেশের। সেটা ৫১ বল হাতে রেখেই কাজ সারল বাংলাদেশ। দাপুটে জয়? না, উপমাটি কম হয়ে যাচ্ছে আজ।

সাকিব আল হাসান এ বিশ্বকাপকে নিজের বানাতে চান। বিশ্বকাপের আগেই অমনটা শোনা গিয়েছিল। অমন কথা অনেকের মুখেই শোনা যায়, কিন্তু কথা রাখতে পারেন খুব কম। কিন্তু সাকিবের ধাত আলাদা, সেটা ক্যারিয়ারের সব সময় বোঝা গেছে। সেটা নতুন করে আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন এই যা।

নবম ওভারে যখন নেমেছিলেন, বাংলাদেশের স্কোরটা তখন ভালোই। ৫০ বলে ৫২ রানের উদ্বোধনী জুটিকে যেকোনো বিচারেই ভালো বলতে হবে। তবে সে ভালোটাকে আরও ভালো করার দায়িত্ব নিয়েছেন সাকিব। গত কিছুদিনের খোলসবন্দী তামিম আজ বল্গা হরিণের মতো না হলেও ছুটছিলেন। কিন্তু সে তামিমকেও ম্লান দেখাচ্ছিল সাকিবের কাছে। সেটা হওয়ারই কথা। ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচেই ফিফটি ছাড়িয়েছেন। সর্বশেষ ম্যাচে সেটা সেঞ্চুরির কোটাও পেরিয়েছে।

নবম ওভারে নেমেছিলেন, ২১তম ওভার শুরু হতেই পেয়ে গেলেন ফিফটি। শিমরন হেটমায়ারের মতো ছক্কা মেরে বল হারাতে যাননি। ঠিক যতটা দরকার, ততটা করেছেন। আর তাতেই ৪০ বলে ফিফটি হয়ে গেল তার। ৭টি চার তার মাঝে। ওয়ানডেতে সর্বশেষ ৫ ম্যাচেই টানা ৫০ পেরোলেন সাকিব, ব্যাটে কতটা অবিশ্বাস্য ধারাবাহিক তিনি!

এর মধ্যেই অবশ্য বাংলাদেশের ইনিংসে একটা ঝড় বয়ে গেছে। ১০ বল ও ১২ রানের মধ্যে বাজেভাবে বিদায় নিয়েছেন তামিম (৪৮) ও মুশফিক (১)। ৩ উইকেটে ১৩৩ রান বাংলাদেশের। সাকিবের সামনে তখনো বহু পথ বাকি, তাঁর সঙ্গী বিশ্বকাপে আজই অভিষিক্ত লিটন দাস। বাংলাদেশ কি পারবে? সাকিব কি পারবেন?

সাকিব যে পেরেছেন সেটা তো এরই মাঝে জানা হয়ে গেছে। কিন্তু যেভাবে সে পথে এগিয়েছেন, সেটাই বেশি আলোচ্য। বাংলাদেশকে গতিতে উড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল উইন্ডিজদের। তা বাউন্সার দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি তাঁরা, কিন্তু হুক, পুল বা কাট করতে সাকিবও তো কখনো আলস্য দেখাননি। উইন্ডিজ ফিল্ডারদের চোখের সামনে দিয়ে বল সীমানা পেরোতে লাগল, হা হুতাশ বাড়তে বাড়তে পরাজিত এক দলের দেখা মিলল ইনিংসের মাঝপথেই। ফিফটিটা সেঞ্চুরি হলো। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড এক ইনিংস পরেই ১২ বল কমিয়ে আনলেন সাকিব। ততক্ষণে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তবুও কাজ শেষ হয়নি বুঝে কোনো বুনো উল্লাস নেই, শুধু একটু ব্যাট তুলে অভিবাদন বুঝে নেওয়া।

সাকিব গত ম্যাচেও এভাবে বোলারদের শাসন করেছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ড ম্যাচে বড্ড একা পড়ে গিয়েছিলেন। আজ আর তাঁকে একা লড়তে হয়নি। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে প্রথমবারের মতো খেলতে নেমে প্রথম দুই তিনটি বলে একটু অস্বস্তি দেখা গিয়েছিলে। দুই তিনবার ব্যাটের কানা লেগে বল যে পেছন দিয়ে চার হয়েছে তাতেও লিটনের কোনো অবদান ছিল না। কিন্তু সে সব শটেই আত্মবিশ্বাস এসেছে। আর সে আত্মবিশ্বাসের ফলটা টের পেলেন শ্যানন গ্যাব্রিয়েল। ৩৮তম ওভারের প্রথম তিন বল সীমানার এপারে পড়তে দেননি লিটন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম ছক্কার হ্যাটট্রিকের রেকর্ডটা লিটন বুঝে নিলেন কী অবলীলায়! কী অনায়াসে! ওই ওভারেই এল ২৪ রান, এবারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ওভার!

দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিবের চেয়ে আগ্রাসী ব্যাটসম্যান বাংলাদেশের ক্রিকেটেই কম এসেছে। তবু ফিফটি পেরিয়ে যাওয়া সাকিবকেই একটু পরে দ্রুত রান তোলায় টপকে গেলেন লিটন। ১৩৫ বলে ১৮৯ রানের চতুর্থ উইকেট জুটিতে সাকিবের অবদান ৮০। আর সাকিবের চেয়ে মাত্র ৩ বল বেশি খেলা লিটনের অবদান ৯৪। একটাই অতৃপ্তি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান একটু কম হয়ে যাওয়ায় সেঞ্চুরিটা পেলেন না লিটন।

প্রতিপক্ষ ৩২২ রান করার পরও লেখা যাচ্ছে, ‘রানটা একটু কম হয়ে যাওয়ায়।’ না, এমন দাপুটে জয় আসলেই দেখেনি বাংলাদেশ। এই জয় সামনের কঠিন পথ চলায় আরও বেশি আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি জোগাবে নিশ্চিত। আপাতত পরের পরীক্ষাটাই কঠিন। ২০ জুন বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। তবে অতীতের মতো এই ম্যাচটা এবার আর একতরফা হবে না, এই কথা এখন জোর দিয়ে বলাই যায়!