সাকিবকে আটকাবে কে!

ম্যাচ জেতানোর পর ক্যামেরার মধ্যমণি সাকিব। ছবি: শামসুল হক
ম্যাচ জেতানোর পর ক্যামেরার মধ্যমণি সাকিব। ছবি: শামসুল হক
বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন সাকিব আল হাসান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাঁর সেঞ্চুরিতে জিতেছে বাংলাদেশ। এবার বিশ্বকাপে ব্যাটসম্যান সাকিব এমন গতিতে ছুটছেন যেন তাঁকে থামানোর কেউ নেই!

সাকিব আল হাসান স্ট্রাইকে এলেই জেসন হোল্ডার পয়েন্টে ফিল্ডার আনছেন। একবার অধিনায়ক বলতে ভুলে গেলেন, ক্রিস গেইল নিজ গরজেই পয়েন্টে এলেন। ‘প্রিয়’ স্কয়ার কাটে সাকিব যেভাবে ‘কেটেছেন’ ক্যারিবীয় বোলারদের, পয়েন্টে ফিল্ডার রাখা অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তাতেও কি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে আটকানো গেল?

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে এমন গতিতে ছুটছেন, সাকিব যেন বলতে চাইছেন, ‘আমাকে আটকাবে কে!’ যে কাভার ড্রাইভে ওসান টমাসকে বাউন্ডারি মারলেন, সমারসেট ক্রিকেট গ্রাউন্ডের পুরো গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল বাংলাদেশ অলরাউন্ডারকে—মনকাড়া এক শট খেলেছেন বলেই নয়, সাকিব টানা দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি পেলেন। কার্ডিফে ইংল্যান্ডের রান পাহাড়ের জবাবে সেঞ্চুরি করেছিলেন। সেটিও ঊরুতে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে। তাঁর মনোবল এতটাই চাঙা, আত্মবিশ্বাস এতটাই উঁচুতে—এই সাকিবকে রুখে দেওয়া কঠিন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলাররা প্রচুর শর্ট বল করবে জেনে সাকিব সেভাবেই তৈরি হয়েছেন। শর্ট বলে কখনো পেছনের পায়ে পুল, কখনো সামনের পায়ে স্কয়ার কাট—আজ টন্টনে সাকিবের রাজত্বই শুধু দেখা গেছে। তাঁর অপরাজিত মহাকাব্যিক ১২৪ আর লিটন দাসের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন চতুর্থ উইকেটে ১৮৯ রানের জুটির সৌজন্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া ৩২২ রানের বড় লক্ষ্যটা লক্ষ্যই মনে হয়নি বাংলাদেশের কাছে! শুধু টন্টনে? দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৪ আর কার্ডিফে অনবদ্য ১২১—টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের তালিকায় সাকিব আবারও সবার ওপরে। ব্রিস্টলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটা ঠিকঠাক হলে কিংবা নিজে খেলতে পারলে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যারন ফিঞ্চ, রোহিত শর্মা কিংবা জো রুটের চেয়ে ব্যবধানটা আরও বাড়িয়ে নিতে পারতেন। তবে যে চার ম্যাচ খেললেন, তাতেই সাকিবের গড় ১০০-এর ওপরে!

ব্যাটিংয়ে সাকিবের এই অবিশ্বাস্য ফর্মের পেছনে রয়েছে বিশ্বকাপের আগে তাঁর নিজেকে তৈরি করার নিষ্ঠা, একাগ্রতা। ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে সে কথাই জানালেন সাকিব, ‘দারুণ লাগছে। শেষ পর্যন্ত উইকেটে থাকতে পারাটা ছিল সবচেয়ে সন্তুষ্টির। ব্যাটিং নিয়ে অনেক কাজ করেছি এবং এখন তার ফল পাচ্ছি।’

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হতেও বেশি সময় লাগেনি। অলরাউন্ডার র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে তিনি থাকেন ব্যাটিং-বোলিং দুটিতে ভালো করেই। তবে সাকিব মানবেন, গত দেড় বছরে ব্যাটিংয়ে যেভাবে ধারাবাহিক দ্যুতি ছড়াচ্ছেন, এমন দুর্দান্ত সময় তিনি আগে কখনো কাটাননি। ব্যাটিংয়ে এই ভালো করার বড় রহস্য—তাঁর তিনে পদোন্নতি। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে সেই যে তাঁকে দিয়ে নাম্বার থ্রি পজিশনের সমাধান পেল বাংলাদেশ, এখনো চলছে।

তিনে ব্যাট করতে পেরে সাকিব নিজেও সন্তুষ্ট। ম্যাচ শেষে বললেন, ‘আমি জানি তিনে ব্যাট করতে নামলে বেশি সুযোগ পাব, বেশিক্ষণ ব্যাট করতে পারব। অনেক সময় পাঁচে ব্যাট করতে নেমেছি ৩০তম কিংবা ৪০তম ওভারে। যেটা আমি মনে করি নিজের জন্য আদর্শ নয়।’

ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বর জায়গাটা সাধারণত দলের সেরা ব্যাটসম্যানের জন্য বরাদ্দ থাকে। চলতি সময়ে বিরাট কোহলি, স্টিভেন স্মিথ, জো রুট, কেন উইলিয়ামসন ব্যাটিং করেন তিনে। একটা সময় জায়গাটা ছিল ভিভ রিচার্ডস, ব্রায়ান লারা, কুমার সাঙ্গাকারা, রিকি পন্টিং, জ্যাক ক্যালিস, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানদের। যাঁদের কথা বলা হলো, তাঁদের বেশির ভাগকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ বোলার হিসেবে ভূমিকা রাখতে হয়নি, যেটি সাকিবকে করতে হয়। ১০ ওভার বোলিংয়ের পাশাপাশি তিনে নেমে ব্যাটিং—কঠিন কাজটা কীভাবে সাফল্যের সঙ্গে করে চলেছেন, কার্ডিফে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব বলেছিলেন, ‘একটু ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ নেওয়া দরকার। এই মুহূর্তে আমি উপভোগ করছি। তবে এটাও বলতে হবে মাত্রই শুরু, ব্যাটে-বলে যতটা সম্ভব অবদান রাখতে হবে। ভেবেছিলাম ব্যাটিংয়ে আরও বেশি অবদান রাখতে এটা আমার জন্য দারুণ এক সুযোগ। আমি উপভোগ করছি।’

তবে এই পজিশনে তাঁকে নামতে কেউ বাধ্য করেনি বা কেউ অনুরোধ করেনি। সিদ্ধান্তটা ছিল সাকিবের নিজেরই। তিনে নামার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন মোটেও সহজ ছিল না। কার্ডিফেই রসিকতা করে বলছিলেন, ‘যদি রান না করতাম, তারা হয়তো ভাবত পাঁচেই আমার নামা উচিত।’

গত দেড় বছরে তিনে নামা যে ব্যাটসম্যানের গড় প্রায় ৬০-এর কাছাকাছি, তাঁকে পাঁচে নামতে বলবে কে! বরং বলতে হবে, ‘এভাবেই চালিয়ে যান সাকিব’!