আফগান ক্রিকেটে ঔদ্ধত্যই তো শক্তি

ভারতকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল আফগানরা। ছবি: রয়টার্স
ভারতকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল আফগানরা। ছবি: রয়টার্স
>

যুদ্ধবিগ্রহ আর রক্তের হোলি খেলার মধ্যে যে ক্রিকেটারদের শৈশব কেটেছে, শরণার্থী ক্যাম্পে খাবার নিয়ে যাদের কাড়াকাড়ি করতে হয়েছে অন্যদের সঙ্গে, তারা তো ভয়ডরহীন হবেই। ঔদ্ধত্য তাদের অলংকার। ক্রিকেটটা যে তাদের কাছে যুদ্ধই।

বিরাট কোহলি মাথা চুলকাচ্ছেন, বারবার ফিল্ডিং পরিবর্তন করছেন, বোলারদের পরামর্শ দিচ্ছেন। ব্যাট হাতে ক্রিজে আফগানিস্তানের মো. নবী নির্বিকার। ঠান্ডা মাথায় খেলে যাচ্ছেন, যেন তিনি জানেন, কী করলে ভারতকে হারানো সম্ভব। ধারাভাষ্যকার তো বলেই বসলেন, ‘নবীকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি জানেন কীভাবে ভারতের কাছ থেকে ম্যাচ বের করে নিতে হয়।’ সেই নবীই যখন ফিরলেন, ভারতীয় সমর্থক দিয়ে ঠাসা সাউদাম্পটনের রোজ বোলের গ্যালারি উল্লাসে ফেটে পড়ল। তারা এর আগে প্রার্থনা করছিলেন রীতিমতো মাথা গুঁজেই! উল্লাসে মত্ত তখন ভারতীয় ফিল্ডাররাও। কিন্তু নবী মাঠ ছাড়লেন মাথা উঁচু করেই। মোহাম্মদ শামি আফতাব আলমকে বোল্ড করার সঙ্গে সঙ্গে কোহলি শিশুর মতো লাফিয়ে উল্লাস করে উঠলেন। যেন বিশাল শক্ত কোনো দলের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি কোনো ম্যাচ জিতে গেছে ভারত!

অথচ আসল ঘটনা পুরো উল্টো! ভারত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দলগুলোর একটি। এই ক্রিকেট বিশ্বকাপে তারাই শিরোপা জিতবে—এমনটা মনে করার লোকের অভাব নেই। এখন পর্যন্ত অপরাজিত তারাই। আফগানিস্তান সদ্য টেস্ট মর্যাদা পাওয়া দল। ক্রিকেট ঐতিহ্যেও ভারতের সঙ্গে তাদের কোনো তুলনাই হয় না। অথচ কাল সারাটা দিন সেই ভারতকেই ধুঁকিয়ে মারল তারা। ভারতের মহাপরাক্রমশীল ব্যাটিং লাইনআপকে ২২৪ রানে থামিয়ে দিয়ে জয়ের সম্ভাবনাটা প্রবল করে তুলেছিল আফগানরা। লড়াইটাও দাঁতে দাঁত চেপেই করেছে নবী, গুলবাদিন নাইব, আসগর আফগানরা। শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি, কিন্তু ভারতীয় দলটা যে অজেয় নয়, তাদের ব্যাটসম্যানদেরও যে দুর্বলতা আছে, সেটি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ক্রিকেট দুনিয়ার অন্যতম নবীন এ দল।

ক্রিকেট দুনিয়ায় আফগান ক্রিকেটারা সাহসী হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু তাদের এই দুঃসাহস, লড়াকু মানসিকতা, কাউকে ছেড়ে কথা না বলার অহমিকা—অনেক ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের সমর্থকদের কাছেই অসহ্যকর। তারা অনেকেই আফগানদের এই মানসিকতাকে ‘বৃথা আস্ফালন’, ‘বেয়াদবি’, ‘ঔদ্ধত্য’, ‘মিথ্যা অহংকার’, ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ বলে মনে করেন। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, এই তথাকথিত অহংকার, আগ্রাসন, হারার আগে না হারা মনোভাবই আসলে আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের চালিকা শক্তি। আফগান ক্রিকেট এবং ক্রিকেটাররা আজ এ পর্যন্ত এসেছেনই এমন মানসিকতার জোরে! আফগান ক্রিকেট দলের এই মানসিকতা নিছকই বেয়াদবি বা ঔদ্ধত্য থেকে আসে এই ভাবনা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে তিনি ভুলই করবেন। এদের এই মানসিকতার উৎস জানতে হলে আপনাকে ইতিহাসে চোখ ফেরাতে হবে।

দুই দশকের বেশি আগে আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে পাহাড়ি সীমান্ত দিয়ে মা–বাবার সঙ্গে পাকিস্তানের পথে ছুটেছিলেন ছোট্ট মোহাম্মদ নবী, আসগর আফগানরা। একটু বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ নেই, থামা যাবে না। থামলেই হয়তো বোমা বা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি শরীর ঝাঁঝরা করে দেবে। তালেবানের কবল থেকে বাঁচতে পেশোয়ারের ধু ধু প্রান্তরে কত দিন–রাত কাটিয়ে দিয়েছেন শিশু হামিদ হাসান, গুলবাদিন নাইব কিংবা রশিদ খানরা, সেটিরও ইয়ত্তা নেই। এমন ভয়ংকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন আজকের আফগান ক্রিকেটারদের বেশির ভাগই। জীবনের পাঁচটি মৌলিক অধিকার তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। শিশু অবস্থায় তারা ভালো খাবার তো দূরের কথা, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সুযোগটুকুও পায়নি। আনন্দময় শৈশব, যেটিকে বলে, সেটির ধারেকাছেও ছিল না আজকের আফগান ক্রিকেটারদের জীবন। বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টার মধ্যে সামাজিক ভব্যতা শেখার সুযোগ কোথায় ছিল তাদের! ছোট থেকে তারা কেবল একটা জিনিসই শিখেছে, কোনো কিছু পেতে হলে লড়াই করতে হবে, চোখে চোখ রেখে তা আদায় করে নিতে হয় অন্যের কাছ থেকে। সে মানসিকতাটাই তাদের মধ্যে চলে আসে ক্রিকেট মাঠে।

২০১৫ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলছে বাংলাদেশ। সে ম্যাচটি টেলিভিশনে দেখছেন আফগানরা। ছবি: সংগৃহীত
২০১৫ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলছে বাংলাদেশ। সে ম্যাচটি টেলিভিশনে দেখছেন আফগানরা। ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেট তারা খেলতে শিখেছে বিষবাষ্পের পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্য। ক্রিকেটটা ছিল তাদের অন্ধকার জীবনে একটু আলোর ঝলকানি। অন্য টেস্ট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেটাররা যেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন, সেখানে আফগান ক্রিকেটাররা নিজেদের তৈরি করেছেন বিদেশি আগ্রাসন আর তালেবানি শাসনের অন্ধকার চিলেকোঠায়। বিন্দু বিন্দু পরিশ্রম আর ত্যাগ-তিতিক্ষায় তারা গড়ে তুলেছে ক্রিকেট সংস্কৃতি। যে দেশের প্রধান স্টেডিয়ামকে তালেবানরা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করত, সেখানেই তারা ক্রিকেট খেলেছে রক্ত জমাট বেঁধে থাকা মাঠে। সেই তারাই এখন দেশে দারুণ এক ক্রিকেট পরিবেশ গড়ে তুলেছে। আফগানিস্তানে এখন বয়সভিত্তিক ক্রিকেট হয়, স্কুল ক্রিকেট হয়, ঘরোয়া ক্রিকেট তো যথেষ্ট জমজমাট। মোটকথা, খেলোয়াড় উঠে আসার পাইপলাইনটা তৈরি হয়ে গেছে সেখানে। যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে তারা ক্রিকেটকে নিজেদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সে ইতিহাসটি পুরোপুরি জানলে আফগানিস্তান ক্রিকেটকে আপনার শ্রদ্ধা করতেই হবে।

হিলারি ক্লিনটন আমেরিকায় বসে গোল্ডম্যান স্যাকসের বক্তৃতায় আফগান ক্রিকেট দলের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতি কীভাবে একটা খেলাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারে, তার বিরল নজির এই আফগানিস্তান।’

এত কিছুর পরেও আফগানিস্তান ক্রিকেট দল এখনো দেশের মাটিতে খেলতে পারে না। ভারতের দেরাদুনে স্টেডিয়াম ভাড়া করে খেলতে হয় তাদের। আত্মঘাতী হামলাকারীরা আজও হামলা করার জন্য লক্ষ্যবস্তু বানায় কাবুল-কান্দাহারের ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলো। ২০১৭ সালেও আফগানিস্তানের কোনো এক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়!

এই ইতিহাসগুলোই জানিয়ে দেয়, আফগানরা কেন ক্রিকেট মাঠে ‘বিনয়ী’ নয়। আফগানদের কাছে ক্রিকেট একধরনের যুদ্ধই। যুদ্ধে বিনয়ী হতে হয়, এ শিক্ষা অন্তত আফগান ক্রিকেটাররা কোনো দিন শেখেনি। তারা মাঠে নামলেই জিততে চায়, জেতার জন্য তাই কোহলি-সাকিবদের চোখে চোখ রেখে চোখ রাঙাতেও তারা পিছপা হয় না।

আফগান ক্রিকেট যেন অর্ণবের কালজয়ী সে গান, ‘তুই গান গা, ইচ্ছেমতো বাতাসকে খুশি করে বাঁচ!’

গানের জায়গায় কেবল ‘ক্রিকেট’টাকে বসিয়ে নিন আরকি!