ওয়াসিমের পরামর্শেই বদলে যাওয়া শাহিন আফ্রিদি

নিউজিল্যান্ড টপ অর্ডারকে কাল গুঁড়িয়ে দিয়েছেন শাহিন আফ্রিদি। ছবি: এএফপি
নিউজিল্যান্ড টপ অর্ডারকে কাল গুঁড়িয়ে দিয়েছেন শাহিন আফ্রিদি। ছবি: এএফপি
>নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কাল অসাধারণ বল করেছেন শাহিন আফ্রিদি। ম্যাচ শুরুর আগে পাকিস্তানি পেসারকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরাম। কি পরামর্শ দিয়েছিলেন আকরাম?

এজবাস্টনে কাল ম্যাচ শুরুর আগে দৃশ্যটা অনেকেরই চোখে পড়েছে। সীমানার এক কোণে বাধ্য ছাত্রের মতো দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ আমির ও শাহিন আফ্রিদি। তাঁদের কী যেন বলছেন ওয়াসিম আকরাম। ক্রিকেটপ্রেমীরা দৃশ্যটি দেখলে আন্দাজ করে নেবেন, কুশল বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলছে ‘ওয়াসিম আকরামের বোলিং ক্লাস’। হালের দুই বাঁ হাতি পেসারকে টোটকা বাতলে দিচ্ছিলেন ক্রিকেটের সর্বকালেরই সেরা বাঁ হাতি ফাস্ট বোলার। নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের সময় দেখা গেল আকরামের ক্লাসে গিয়ে ভালোই হয়েছে শাহিন ও আমিরের। কিউই টপ অর্ডারের প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যে চারজনই যে আমির-শাহিনের শিকার!

শাহিনের কথা কথা আলাদা করে বলতেই হয়। পঞ্চম ওভার থেকে তাঁকে আক্রমণে এনেছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। প্রথম বলটাই ছিল অফ স্টাম্পের বাইরে ইয়র্কার লেংথের। তখনো বোঝা যায়নি, কিউই টপ অর্ডারের সামনে কী অপেক্ষা করছে। নিজের প্রথম স্পেলে তা ধীরে ধীরে বুঝিয়েছেন ১৯ বছর বয়সী এ পেসার। প্রথম স্পেলে তাঁর বোলিং পরিসংখ্যান ৭-৩-১১-৩। যে উইকেটে স্পিনাররা বাঁক পাচ্ছিলেন আর বলও ব্যাটে আসছিল থেমে থেমে, সে উইকেটে কিউই টপ অর্ডারকে শাহিন স্রেফ গতি আর লেংথের মিশ্রণে ধাক্কা শেষ করেছেন। পাকিস্তানি পেসারদের মোজেজা ঠিক এখানেই। পাটা উইকেটেও তাঁদের বোলিং দেখলে মনে ভ্রম জাগে, আরে এ তো পেসবান্ধব উইকেট!

১৩তম ওভারের মধ্যে ৪৬ রান তুলতে ৪ উইকেট হারিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। এর মধ্যে শুধু মার্টিন গাপটিলকে ফুল লেংথ ডেলিভারিতে তুলে নিয়েছেন মোহাম্মদ আমির। বাকি ৩ উইকেট শাহিনের। ফুল লেংথ মানে একটু সামনে বেশ কয়েকটি ডেলিভারি করার পর আবার পেছনে মাপা লেংথে টানা বল করে গেছেন এ বাঁ হাতি পেসার। লেংথের দুর্দান্ত মিশ্রণের সঙ্গে সামনে থেকে বলও তুলেছেন ভালোই। শাহিন যে ৩ উইকেট নিয়েছেন এর মধ্যে রস টেলর ও কলিন মানরো শাহিনের লেংথ থেকে একটু ওঠা বল সামলাতে না পেরে ক্যাচ দিয়েছেন উইকেটের পেছনে। আর টম লাথাম স্রেফ গতির কাছে হার মেনে ক্যাচ দিয়েছেন একই জায়গায়।

শাহিনের প্রথম স্পেল শেষ হওয়ার পর তাই কৌতূহল জেগেছিল সবার মনেই—ম্যাচের আগে কী কথা তাহার সনে! মানে, ওয়াসিম আকরাম কী এমন টোটকা দিলেন যে দুই পেসার বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন? ক্রিকেটপ্রেমী মাত্রই জানেন, খেলোয়াড়ি জীবনে বলকে দিয়ে ‘কথা’ বলাতে পারতেন ওয়াসিম। উইকেটের দু-পাশেই ভেতরে-বাইরে নিয়ন্ত্রিত সুইংয়ের সঙ্গে ১৪০-এর ওপরে গতি দিয়ে ঘোল খাইয়েছেন ব্যাটসম্যানদের। আর বল একটু পুরোনো হলে রির্ভাস সুইংয়ের পসরা তো ছিলই। সেটা কী উপমহাদেশের উইকেট কী ইংলিশ উইকেট। বাঁচা-মরার লড়াইয়ে নামার আগে এমন কারও কাছ থেকে বোলিংয়ের টোটকা পাওয়া মানে তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!

ম্যাচ শুরুর আগে ওয়াসিমের ক্লাসে আফ্রিদি-আমির। ছবি: এএফপি
ম্যাচ শুরুর আগে ওয়াসিমের ক্লাসে আফ্রিদি-আমির। ছবি: এএফপি

ম্যাচ চলাকালীন ধারাভাষ্যকক্ষে তাই বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েছিলেন ওয়াসিম। ভুল ভাবছেন। অপরাধীদের যেমন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তেমনটি নয়। ধারাভাষ্যকক্ষে বাকিদের কৌতূহল ছিল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা বাঁ হাতি পেসার তাঁর উত্তরসূরিদের কি পরামর্শ দিয়েছেন? মাইক্রোফোন হাতে ধারাভাষ্যকক্ষেই রহস্য ভেঙেছেন ওয়াসিম, শাহিনকে একটু সামনে মানে ফুল লেংথে বল করার কথা বলেছিলেন তিনি। ‘আমি তাঁকে লেংথ পাল্টানোর কথা বলেছিলাম। সে একটু বেশি শর্ট লেংথে (পেছনে) বল করছিল। তাই ব্যাটসম্যানকে আক্রমণ করতে তাঁকে আরও সামনে বল করতে বলেছি। মনে হচ্ছে সে আমার পরামর্শ শুনেছে’—ধারাভাষ্যকক্ষে জবাব দেন পাকিস্তানি পেস কিংবদন্তি।

নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডারে সবচেয়ে বড় হুমকি ছিলেন কেন উইলিয়ামসন। আমির-শাহিনকে তাঁকে সামলানোর পরামর্শও দিয়েছিলেন ওয়াসিম। যদিও কিউই অধিনায়ক ফিরেছেন লেগ স্পিনার শাদাব খানের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে। কিন্তু ওয়াসিমের টোটকার ঝড় গেছে বাকি ব্যাটসম্যানদের ওপর দিয়ে। সে সম্পর্কে ওয়াসিম বলেছেন, ‘উইলিয়ামসনকে সামলাতে তাঁদের বোলিংয়ের লেংথ ও ফিল্ড সাজানোয় মনোযোগ দেওয়ার কথা বলেছিলাম।আর শহিনকে বলেছি আরও সামনে (ফুল লেংথ) বল করতে। এ পর্যায়ের ক্রিকেটে সামান্য একটু অদল-বদলই পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।’

কিউইদের ইনিংসের সময়ই শাহিনের প্রশংসায় ভেসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশ্লেষক থেকে ক্রিকেটপ্রেমীরা পর্যন্ত এক সুরে বলেছেন, শাহিনের বোলিংয়ে ওয়াসিমের স্মৃতি ফিরে আসছে। শাহিনও কিন্তু কাল তাঁর পূর্বসুরিকে মোটেও হতাশ করেননি। শেষ পর্যন্ত তাঁর বোলিং পরিসংখ্যান ১০-৩-২৮-৩। ইকোনমি রেট ২.৮০। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ম্যানচেস্টারে ভারতের বিপক্ষে এমনই আগুনঝরা বল (১০-০-২৭-২) করেছিলেন ওয়াসিম। পরিসংখ্যান বলছে ওয়াসিমের সেই বোলিংয়ের পর বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কোনো পেসারের সবচেয়ে কিপটে বোলিংয়ের নজির দেখা গেছে কাল শাহিনকে সৌজন্যে!