ক্রিকেটে ভূতের ভয়

ভূত আছে কি নেই, তা রহস্যময় হলেও ভূতে ভয় পাওয়াটা রহস্যময় নয়। অমন যে ক্রিকেট মাঠে শত বাধা কঠোর লড়াই করে দলকে জেতানো মহান খেলোয়াড়, দেশের পতাকা তুলে ধরে দেশকে গৌববের আসনে নিয়ে যান, তাঁরাও ভূতের ভয় পান! ভাবছেন, এ কীভাবে সম্ভব? অনেক ক্রিকেটারই স্বীকার করেছেন, তাঁরা খেলোয়াড়ি জীবনে কয়েকবার আধিভৌতিক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন, খেলতে গিয়েই হয়েছেন। আজ আমরা আলাপ করব বিখ্যাত সব ক্রিকেটারের জীবনে ভূত দেখার ঘটনা নিয়ে। যেহেতু বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে হচ্ছে, তাই ইংল্যান্ডের মাটিতে ক্রিকেটারদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুটি ভীতিকর ঘটনার গল্প দিয়ে এই ভূতের গল্প শুরু করা যাক।

লামলি ক্যাসেল: এখানে চৌদ্দ শতকে খুন হয়েছিলেন লেডি লামলি। পরে তাঁর নামে হোটেলটির নাম রাখা হয়েছে। ছবি: উইকি মিডিয়া কমনস
লামলি ক্যাসেল: এখানে চৌদ্দ শতকে খুন হয়েছিলেন লেডি লামলি। পরে তাঁর নামে হোটেলটির নাম রাখা হয়েছে। ছবি: উইকি মিডিয়া কমনস


লামলি ক্যাসেলের ভূত
২০০৫ সালের সেই বিখ্যাত অ্যাশেজ সফর। সিরিজ তখন ১-১–এ ড্র। একজন ভগ্নহৃদয় ব্রেট লি ব্যাট হাতে ক্রিজে বসে আছেন এবং অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ তাঁর কাঁধে সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, এটা মনে হয় সাম্প্রতিক সময়ে দ্য অ্যাশেজ এবং ক্রিকেটের স্পিরিটের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি। তবে মাঠে ও মাঠের বাইরে ক্রমাগত অত্যধিক শারীরিক ও মানসিক চাপে অজিরা সেবার বড়ই বিপর্যস্ত ছিল। অস্ট্রেলিয়া দল উঠেছিল চেস্টার লি স্ট্রিটের লামলি ক্যাসেল নামক বেশ ঐতিহ্যবাহী এবং পুরোনো একটি হোটেলে। ২২ জুন, শেন ওয়াটসন ওই হোটেলে কিছু একটা দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া ম্যানেজার ভদ্রমহিলাও এই কথা স্বীকার করেছেন, ‘আমি ভূত দেখেছি। আমি শপথ করছি, আমি সত্য বলছি।’ ঘটনার পরে ওয়াটসন এত ভয় পেয়েছিলেন যে তিনি ব্রেট লির ঘরে ঘুমাতে শুরু করেছিলেন।

প্রথমে সবাই মনে করেছিল, অ্যাশেজ হারের তীব্র মানসিক চাপ থেকে উল্টোপাল্টা দেখেছেন ওয়াটসনরা, কিন্তু স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে খোঁজখবর করতে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এই হোটেলে চৌদ্দ শতকের এক সম্ভ্রান্ত ইংরেজ নারীর ভূত ঘুরে বেড়ায় বলে জনশ্রুতি আছে। ওই নারীর নাম লেডি লামলি—যাঁর নামে হোটেলটির নাম রাখা হয়েছে লামলি ক্যাসেল। শোনা যায়, ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত না হতে চাওয়ায় তিনি খুন হয়েছিলেন ক্যাথলিক যাজকদের দ্বারা। শুধু শেন ওয়াটসনই নন, ২০০০ সালে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ইংল্যান্ড সফর করেছিল, তারাও প্রথমে এই হোটেলেই উঠেছিল। পরে একাধিক ক্রিকেটার, যাঁদের মধ্যে ছিলেন অধিনায়ক জিমি অ্যাডামস, কোন কিছু দেখে আতঙ্কিত হয়ে হোটেল পরিবর্তন করে অন্য হোটেলে উঠেছিলেন তিনি!

ল্যাংহাম হোটেল: এই হোটেলে ইংলিশ পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড আর তাঁর বান্ধবী বেইলি ভূতের ভয় পেয়েছিলেন। ছবি: উইকি মিডিয়া কমনস
ল্যাংহাম হোটেল: এই হোটেলে ইংলিশ পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড আর তাঁর বান্ধবী বেইলি ভূতের ভয় পেয়েছিলেন। ছবি: উইকি মিডিয়া কমনস


ল্যাংহাম হোটেলের অশরীরী
লন্ডনের আর দশটা হোটেলের তুলনায় ল্যাংহাম হোটেলের ঠাটবাট একটু আলাদা। সেই ১৮৬৫ সালে চালু হওয়া ঐতিহ্যবাহী এই হোটেল সেকালের মার্ক টোয়েন থেকে শুরু করে একালের লেডি গাগার মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের আতিথ্য দিয়েছে। ক্রিকেটাররা বাদ যাবেন কেন? তবে আতিথ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই হোটেলের আবাসিক ভূতেরা অতিথিদের জ্বালাতনও কম করে না। ভৌতিক হোটেল হিসেবে এটা রীতিমতো বিশ্ববিখ্যাত এবং অনেকে তো স্রেফ ভূত দেখতেই আসেন এই হোটেলে।
যা হোক, এই হোটেলের ভূতেরা আবার কিছুটা দেশদ্রোহী ধরনের। এরা ভয় দেখিয়েছিল নিজের দেশের ক্রিকেটারদেরই! ২০১৪ সালে ভারত দলের ইংল্যান্ড সফরে দুই দলই এই হোটেলে উঠেছিল। ইংলিশ পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড আর তাঁর বান্ধবী বেইলিকে ভূতেরা ভয় দেখিয়ে কক্ষছাড়া করেছিল! তাঁরা শুয়ে আছেন, হঠাৎ নাকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে গরম বাড়তে শুরু করেছিল, এরপর দুম করে বাথরুমে ট্যাপের পানি পড়া শুরু হয়েছিল। ব্রড রুমের বাতি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে পানির শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। আবার লাইট বন্ধ করলে পানি পড়া শুরু হয়। ভয় পেয়ে কক্ষ পরিবর্তন করেন এই যুগল। পরে জানা যায়, মঈন আলীর স্ত্রীও নাকি একবার ভয়ে ঘুমাতে পারেননি সারা রাত! ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিও নাকি দেখেছিলেন ‘কিছু একটা’।

এই ল্যাংহামেই আরেক দফা থেকেছিলেন ইংলিশরা, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোম সিরিজে। সেবারও ব্রড আর বেন স্টোকসকে জ্বালিয়েছেন এই ভূতেরা। মাঝরাত্তিরে নাকি তাঁরা দেখতে পেতেন ঘরের মধ্যে অশরীরী অবয়ব হাঁটাচলা করছে!

ব্যাপার হলো, এই হোটেলে শুধু অক্টোবর মাসেই এসব ভৌতিক কার্যকলাপ চলে। অক্টোবর মাসে এই হোটেলের ৩৩৩ কক্ষে ভিক্টোরিয়ান পোশাক পরা এক পুরুষের ছায়া দেখা যায়। অন্য আর কোনো মাসে এ রকম দেখা যায় না। আবার অনেকেই হোটেলের থার্ড ফ্লোরের জানালায় মিলিটারি পোশাক পরিহিত একজনকে দেখতে পান বলে জানা গেছে। ধারণা করা হয়, এটা একজন জার্মান রাজপুত্রের আত্মা, যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে জানালা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। তার আত্মাই এই হোটেলে ঘুরে বেড়ায় বলে কিংবদন্তি শোনা যায়।

বিশ্বকাপে লন্ডনে তো দুটি ম্যাচ খেলল বাংলাদেশ! চেস্টার লি স্ট্রিটের ডারহাম কাউন্টি মাঠেও এই বিশ্বকাপে তিনটা ম্যাচ হয়েছে। ভাগ্যিস অক্টোবর মাস নয়, তাই সাকিব-তামিমরা হয়তো লন্ডনে ভূতের আছর থেকে বেঁচে গিয়েছেন।

রিজেস লাটিমার হোটেলের বিছানা ঝাঁকানো ভূত
বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া ক্রিকেটারদের দেশের বাইরে আর কোথায় কোথায় ভূতের খপ্পরে পড়তে হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এ ঘটনা নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ২০১৫ সালের। পাকিস্তানের বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হারিস সোহেলকে ক্রাইস্টচার্চের রিজেস লাটিমার হোটেলের ভূতেরা কাবু করে ফেলেছিল! ২০১৫ সফরের একপর্যায়ে হারিস নাকি নিজের রুম থেকে কোচিং স্টাফদের ফোন করে বলেন, তাঁর বিছানা কে নাকি ঝাঁকাচ্ছে! কোচিং স্টাফ তাঁর রুমে ঢুকে দেখেন হারিস ভয়ে নিজেই কাঁপছেন আর জ্বর উঠিয়ে ফেলেছেন গায়ে!

শুধু হোটেলই নয়, ক্রিকেটের স্টেডিয়ামগুলোতেও অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে কানাঘুষা আছে!

ফিরোজ শাহ কোটলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম: এর কাছাকাছি রয়েছে ফিরোজাবাদ দুর্গ। ছবি: উইকি মিডিয়া কমনস
ফিরোজ শাহ কোটলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম: এর কাছাকাছি রয়েছে ফিরোজাবাদ দুর্গ। ছবি: উইকি মিডিয়া কমনস


ফিরোজ শাহ কোটলার জিন
মুঘল সাম্রাজ্যের শানশওকতের রাজধানী দিল্লি, যার অলিগলিতে ইতিহাসের নানান বাঁকের নানা রহস্য লুকিয়ে আছে! সেই দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলার গায়ের সঙ্গে লাগানো ফিরোজাবাদ দুর্গ! স্টেডিয়ামে ঢুকতে গেলে এর পাশ দিয়েই আসতে হয়! কথিত আছে, এই দুর্গে প্রতি বৃহস্পতিবার নাকি জিনরা একত্র হয়ে সম্মেলনের মতো করে! অনেক মানুষ নাকি এই জিনদের দেখতেও আসে, ভাবে যে জিনেরা তাদের ইচ্ছা পূরণ করবে! কে জানে সেই জিনেরা ইন্ডিয়ান ক্রিকেটেরও ভক্ত কি না? সুনীল গাভাস্কার এই মাঠে যখন ডন ব্র্যাডম্যানের ২৯ সেঞ্চুরির রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন, আবার শচীন টেন্ডুলকার এই মাঠেই যখন গাভাস্কারেরই ৩৫ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙেছিলেন বা অনিল কুম্বলে নিয়েছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত ৭৪ রানে ইনিংসে ১০ উইকেট, জিনদের কোন ‘আছর’ তাদের ওপর ছিল কি না, সেটা এখনো ভেবে দেখাই যায়।