কর্দমাক্ত মাঠে ফুটবল নামের 'কুস্তি'র সুখ!

আরামবাগের গোলরক্ষক মাজহারুল ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গোলরক্ষক আরিফুজ্জামান হিমেলকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কেমন মাঠে হচ্ছে প্রিমিয়ার লিগ। সংগৃহীত ছবি
আরামবাগের গোলরক্ষক মাজহারুল ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গোলরক্ষক আরিফুজ্জামান হিমেলকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কেমন মাঠে হচ্ছে প্রিমিয়ার লিগ। সংগৃহীত ছবি
>

বর্ষা এড়ানোর জন্য এবারের ঘরোয়া লিগ পিছিয়ে এনেছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভরা বর্ষাতেই কর্দমাক্ত মাঠে চলছে জবরদস্তি প্রিমিয়ার লিগ।

পাস দিলে আটকে যাচ্ছে বল, তার মধ্যে চলছে ফুটবল...থুড়ি ‘লাত্থালাত্থি’। খেলা শেষে প্রায় সবার প্যান্টের রং কালো, পেছন থেকে জার্সি দেখে চেনারও উপায় নেই কে সোহেল রানা আর কে জুয়েল রানা!

দেশের কিছু অঞ্চলে বিয়ের আগে কাদামাটি মেখে উৎসবের রেওয়াজ ছিল। সে উৎসবে অংশ নিতে বাফুফেরও অনেক শখ। যেন কাদামাটিতে গড়াগড়ি করে জবরদস্তি ফুটবলের বিজ্ঞাপন করতে চান সবাই। বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের দৃশ্য দেখে ফুটবল নয়, অন্য কিছু মনে হচ্ছিল।

একই দিনে নোয়াখালীর শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে টিম বিজেএমসির বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। জয়-পরাজয় ছাপিয়ে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গোলরক্ষক আরিফুজ্জামান হিমেলের একটি ছবি। তাঁর সারা শরীরে থকথকে কাদা। ছবিটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সাড়া ফেলেছে বেশ। একই দিনে প্রবল বৃষ্টি ও বজ্রপাতের কারণে তো বাতিলই হয়ে যায় ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামের আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও বসুন্ধরা কিংসের ম্যাচ।

তিনটি ঘটনা বা দৃশ্য জোড়া লাগালে সবার আগে যে প্রশ্নটি উঠছে, এমন ভরা বর্ষার মৌসুমে ফুটবল কেন? যেহেতু বর্ষাকে উপেক্ষা করে ভালো ফুটবলের জন্যই বারবার ঘরোয়া ফুটবলের সূচি ওলট–পালট করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। কিন্তু ঘুরেফিরে সে আবার বর্ষাতেই গা জোয়ারি ফুটবলে ‘সুখ’ খুঁজে নিয়েছে তারা। অবশ্য এতে দায় এড়াতে পারবে না ক্লাবগুলোও।

কয়েক বছর আগেই বেশ ঘটা করে ঘোষণা এসেছিল বর্ষা মৌসুমে আর ফুটবল নয়। এরপর বেশ কয়েক বছর শীতের মৌসুমেই গড়িয়েছে ঘরোয়া ফুটবল। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলের যেন সুখ সয় না। তাই গত মৌসুমে আবার বর্ষাকেই ভালোবেসে গ্রহণ করা। তুমুল বর্ষার ফাঁদে পড়ে জেরবার হয়েছিল গত মৌসুমের লিগ। খেলা তো হয় না, হয়েছে তামাশা। এরপরও প্রথমে কর্দমাক্ত মাঠে জোর করে কয়েক দিন খেলানোর পর শেষ পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হয়েছিল লিগ।

এবার সেই বিপদ এড়াতে মৌসুম সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল বাফুফে। সেই হাওয়ায় ফুটবল মৌসুম শীতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। এতে এএফসি কাপের একটি স্লটও হারায় বাংলাদেশ। তবু বর্ষা এড়িয়ে ভালো ফুটবলের স্বার্থে মেনে নেওয়া। বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ এবারের মৌসুমের শুরুর আগে বলেছিলেন, ‘আমরা ফুটবল মৌসুম ঠিক করছি, যেন বর্ষা এড়ানো যায়। যেন আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথার সঙ্গে বাস্তবতার মিল পাওয়া গেল কোথায়?

বারবার খেলা পিছিয়ে দেওয়ার কারণেই কথা রাখতে পারেনি বাফুফে। খেলা পেছানোর কায়দাকানুনে জুড়ি নেই তাদের। ঝড়-রোদ–বৃষ্টি বা ক্লাবের যেকোনো অজুহাতে বিভিন্ন সময়ে যেকোনো কারণেই খেলা পিছিয়ে দেওয়ার নজির আছে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থাটির। এবারের মৌসুমের লিগ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১৮–এর নভেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে। সেই লিগ শুরু হয় ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে। দুই মৌসুমের মধ্যবর্তী লিগের সময়ের পার্থক্যের বিবেচনায় বাংলাদেশের নাম হয়তো রেকর্ড বুকেও উঠতে পারে। গত লিগ শেষ হয়েছিল ২০১৮–এর জানুয়ারির ১৩ তারিখে। এক বছরের অধিক পেরিয়ে এসে ১৮ জানুয়ারি ২০১৯-এ নতুন লিগ। ভাবা যায়!

ফিরে আসা যাক বর্ষার গল্পে। এবারের মৌসুমে সাড়া জাগানো দল গড়ে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জয়ের পথে নবাগত বসুন্ধরা কিংস। রাশিয়া বিশ্বকাপে কোস্টারিকার জার্সিতে খেলা দানিয়েল কলিনদ্রেসকে উড়িয়ে এনেছে। এশিয়ান কোটায় খেলছেন কিরগিজস্তান জাতীয় দলের মিডফিল্ডার বখতিয়ার দুশবেকভ। স্বাভাবিকভাবে ভালো মানের ফুটবলাররা কর্দমাক্ত মাঠে খেলতে রাজি নন। ফলে বৃহস্পতিবার তো ময়মনসিংহে তাঁরা মাঠেই নামতে চাননি বলে জানিয়েছেন বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসান, ‘এবার তো কাদার মৌসুমে খেলারই কথা ছিল না। শেষ পর্যন্ত খেলতেই হচ্ছে। আমাদের কলিনদ্রেস ও বখতিয়ার তো বৃহস্পতিবার মাঠেই নামতে চাননি। পরে তো ৮ মিনিট খেলা হওয়ার পরই পরিত্যক্ত। এবার যা হওয়ার হয়ে গেছে। সামনের মৌসুমে যেন আর কর্দমাক্ত মাঠে না খেলতে হয়, সেই প্রত্যাশা করছি।’

কর্দমাক্ত মাঠে ভালো ফুটবল সম্ভব নয়, তা সবারই জানা। সঙ্গে আশঙ্কা থাকে খেলোয়াড়দের চোটও। গুরুতর না হলেও আরামবাগের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ের ম্যাচে চোট পেয়েছেন বসুন্ধরার ইমন বাবু ও মাহবুবুর রহমান সুফিল। আর বড় চোটের আশঙ্কা দেখছেন আরামবাগের গোলরক্ষক হিমেল, ‘এমন কর্দমাক্ত মাঠে খেলা খুবই ভয়ংকর। আমাদের খেলোয়াড়দের জন্য এটা বড় হুমকি। যেকোনো বড় চোটে পড়লে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।’

এ ছাড়া এমনিতেই ঘরোয়া ফুটবলে গ্যালারিতে দর্শক দেখা যায় না। যাঁরা আসেনও, কর্দমাক্ত মাঠে ভালো খেলা না দেখতে পারলে তাঁরাও তো মুখ ফিরিয়ে নেবেন।