জিম্বাবুয়ের কেনিয়া হওয়া আটকাতে পারবে আইসিসি?

এভাবে মাঠে আবার কবে নামতে পারবে সেটা জানেন না জিম্বাবুয়ে। ছবি: ক্রিকেট আয়ারল্যান্ড
এভাবে মাঠে আবার কবে নামতে পারবে সেটা জানেন না জিম্বাবুয়ে। ছবি: ক্রিকেট আয়ারল্যান্ড
একসময়ের দুর্দান্ত দল জিম্বাবুয়েকে এবারের বিশ্বকাপে দর্শক হয়ে থাকতে হলো। সেখানেই শেষ নয়; আইসিসি কাল সদস্যপদই স্থগিত করে দিয়েছে দেশটির। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট কি হারিয়েই যাবে?

২০০১ সালের এপ্রিল মাস বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে। সেবারই প্রথম কোনো ত্রিদেশীয় সিরিজ বা বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের অংশ না হয়েও আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলার আমন্ত্রণ পেয়েছিল বাংলাদেশ দল। ইতিহাসে যদিও সে জিম্বাবুয়ে সিরিজ বিখ্যাত হয়ে আছে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সফর হিসেবে। কিন্তু পাদটীকা হিসেবে এ কথাটাও যোগ করা উচিত, সেবারই প্রথম কোনো দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ।

টেস্ট সিরিজ নিয়ে বেশি আগ্রহ থাকলেও ওয়ানডে সিরিজ দিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের সফর। সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচেই ‘বড়দের ক্লাবে’ পা রাখা কত কঠিন হবে, সেটাই হাতে-কলমে বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর কতটা কঠিন পথে হাঁটতে হবে বাংলাদেশকে সেটা সে সিরিজেই বোঝা গিয়েছিল। প্রতিপক্ষের মাটি, কন্ডিশন বোঝা ও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ সে শিক্ষা প্রথম দ্বিপাক্ষিক সিরিজেই পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব মানচিত্রে অনেক পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়েও বাংলাদেশের জন্য তখন ছিল ভয়ংকর কঠিন এক দল।

ক্রিকেটের কুলীন পরিবারের যোগ দেওয়ার পর এই জিম্বাবুয়েই ছিল বাংলাদেশের উদাহরণ। মাত্র দশ বছরের মধ্যে সমীহ করার মতো এক দল হয়ে উঠেছিল জিম্বাবুয়ে। দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়, দারুণ রসায়ন মিলিয়ে দারণ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল তারা। হিথ স্ট্রিক, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, হেনরি ওলোঙ্গা, নিল জনসন, অ্যান্ডি ব্লিগনট কিংবা অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলরা ছিলেন বাংলাদেশের জন্য অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশ ক্রিকেট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হামাগুড়ি থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টার সময় বেশির ভাগ দল বাংলাদেশের সঙ্গে খেলতে অনাগ্রহী ছিল। সে সময়ে জিম্বাবুয়ে বাড়িয়ে দিয়েছিল সহযোগিতার হাত।

টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর বাংলাদেশকে আতিথ্য দেওয়া কিংবা সঙ্গ দেওয়ার সবটুকু কাজই করেছে জিম্বাবুয়ে। শ্রীলঙ্কা ছাড়া অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশকে জিম্বাবুয়ের মতো আতিথ্য দেয়নি। নিজ থেকে টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের টেস্ট খেলার নিশ্চয়তা ছিল তারা।

এটাই কী ক্রেইগ আরভিনের শেষ ইনিংস হয়ে থাকবে না তো? ছবি: ক্রিকেট আয়ারল্যান্ড
এটাই কী ক্রেইগ আরভিনের শেষ ইনিংস হয়ে থাকবে না তো? ছবি: ক্রিকেট আয়ারল্যান্ড

বাংলাদেশের এক সময়ের অনুপ্রেরণা এবারের বিশ্বকাপে সুযোগই পায়নি। নিজেদের মাঠে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব আয়োজন করেও বিশ্বকাপে আসতে পারেনি তারা। টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের এক সময়ের শীর্ষ ব্যাটসম্যান (অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার) উপহার দিয়েছিল যে দল, সে দলের গত সেরা তারকা এখন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। এই ওপেনারের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না, কিংবা অবজ্ঞা করা হচ্ছে না; হাজার হলেও বাংলাদেশের সেই ঐতিহাসিক সফরের পরই নাম কামিয়ে নিয়েছিলেন কিশোর মাসাকাদজা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছিলেন। অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়া মাসাকাদজা কদিন পরই অবশ্য মোহাম্মদ আশরাফুলের কাছে খুঁইয়েছেন সে রেকর্ড।

সেদিনের বিস্ময় বালক মাসাকাদজার ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা অন্যরকমও হতে পারত। অভিষেকে অমন কীর্তির পরও পড়াশোনায় মন দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স শেষ করে তবেই ক্রিকেটে ফেরার ইচ্ছে জানিয়েছিলেন সেদিনের মাসাকাদজা। সে পড়াশোনার গুরুত্বটা হয়তো এবার নতুন করে অনুধাবন করতে হবে মাসাকাদজাকে। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে যা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন ভেবেছিলেন, সেটা নিয়ে এখনই ব্যস্ত হয়ে ওঠার সময় এসে গেছে তাঁর এখনই।

মাসাকাদজা পড়াশোনা শেষ করে দলে ফিরতে ফিরতেই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট পতনের ডাক শুনে ফেলেছে। স্বৈরাচার শাসনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিশ্বকাপের মাঝপথেই প্রায় পুরো এক প্রজন্ম হারিয়ে ফেলেছে জিম্বাবুয়ে। দলে ফিরে থিতু হতে না হতেই সোনালি প্রজন্মের বাকিরাও বিদায় নিয়ে নিয়েছেন সে ঘটনারই বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ায়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের বাকি গল্পটা মাসাকাদজার মতোই। মাঝে মাঝেই আশার ঝলক দেখা গেছে, কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সব সময় দলটিকে আটকে ফেলেছে ছোট একটি গণ্ডির মাঝে। পতন হতে হতে ১৯৮৩ সালের পর প্রথম কোনো বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার ঘটনাও ঘটে গেছে ২০১৯ সালে। কিন্তু এর চেয়ে বড় সর্বনাশ হয়েছে এ সপ্তাহে। জিম্বাবুয়ের সদস্যপদ স্থগিত করেছে আইসিসি।

দেশটির নির্বাচিত ক্রিকেট বোর্ডকে নিষিদ্ধ করায় ও দেশের ক্রিকেটে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ আটকানোর কোনো উপায় না দেখে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে আইসিসি। এর আগে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের খুব বাজে সময়ে একবার সতর্ক করেছিল আইসিসি, নেপালের সদস্যপদও স্থগিত করেছিল তারা। কিন্তু কোনোবারই দলগুলোর খেলা আটকানো হয়নি। কিন্তু এবার আইসিসির নিষেধাজ্ঞা ক্রিকেট মাঠেও প্রভাব ফেলেছে। অক্টোবরের আগে নির্বাচিত বোর্ডকে দায়িত্ব দেওয়া না হলেও আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে এই নিষেধাজ্ঞা আরও দীর্ঘ হবে।

এর ফলে জিম্বাবুয়ে দলের অনেক খেলোয়াড়েরই হয়তো ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। রাগে ক্ষোভে সিকান্দার রাজা তো প্রশ্নই তুলেছেন, ‘আমরা কি খেলার সরঞ্জাম পুড়িয়ে চাকরিতে আবেদন করব? এখন ঠিক কী করা উচিত তা আমি জানি না।’ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাজার হয়তো নতুন ক্যারিয়ার খুঁজে নিতে কষ্ট হবে না, চাইলেই স্মৃতির অংশ হওয়ার যোগ্য নয় এমন সরঞ্জাম ফেলেও দিতে পারবেন। ক্যারিয়ারের প্রায় শেষ প্রান্তে থাকা মাসাকাদজারও হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কাজে লাগানোর সময় হয়ে গেছে, কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ হচ্ছে না। ২০০৩ বিশ্বকাপ পরবর্তী ধাক্কাই এতগুলো বছরেও কাটিয়ে নিতে পারেনি জিম্বাবুয়ে। সেখানে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার ধাক্কা সামলে জিম্বাবুয়ে কি আর কখনো ফিরতে পারবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে?

চাতারাদের প্রজন্ম এখানেই শেষ হয়ে যাবে? ছবি: ক্রিকেট আয়ারল্যান্ড
চাতারাদের প্রজন্ম এখানেই শেষ হয়ে যাবে? ছবি: ক্রিকেট আয়ারল্যান্ড

ক্রিকেটের বিশ্বায়ন চলছে। কদিন আগেই ৮০টি দেশের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা জানিয়েছে আইসিসি। এর মাঝে কেনিয়ার নামও আছে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সৌদি আরব, ইতালি বা কাতারেরও পেছনে কেনিয়া। অথচ বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের সম্পর্কের আলোচনার ফাঁকেই অবধারিতভাবে চলে আসে কেনিয়ার নাম। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর জিম্বাবুয়ে যা করেছে, ওয়ানডে স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর বাংলাদেশ ও কেনিয়া একে অপরকে সে সহযোগিতা করেছিল। ২০০৩ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলা কেনিয়াকে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কবে দেখা গেছে মনে করাই কঠিন। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির আশায় থাকা একটি দেশ শুধু ওয়ানডে স্ট্যাটাসই হারিয়ে বসেনি, নিয়মিত টি-টোয়েন্টি খেলারও সুযোগ পাচ্ছে না আর। আইসিসি যখন ক্রিকেটকে সবদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা করছে এর মাঝেই সেই ১৯৭৫ বিশ্বকাপ থেকে ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ কেনিয়া হারিয়ে গেছে দুনিয়ার আলোকিত অঞ্চল থেকে।

দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে কুলীন সম্প্রদায়ের নবম সদস্য জিম্বাবুয়েও কি সে পথেই হাঁটছে? ফেরার পথ কি খোলা রাখবে আইসিসি? নাকি ভবিষ্যতে আইসিসির ওয়েবসাইটে স্ক্রল করেই তলানিতে খুঁজে নিতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধুকে!