এমন বাজে ফিল্ডিং নিয়ে এগোনো কঠিন

এজবাস্টনে রোহিত শর্মার ক্যাচ পড়ে গেল তামিমের হাত গলে, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটাও শেষ পর্যন্ত জেতা হয়নি বাংলাদেশের। ছবি: এএফপি
এজবাস্টনে রোহিত শর্মার ক্যাচ পড়ে গেল তামিমের হাত গলে, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটাও শেষ পর্যন্ত জেতা হয়নি বাংলাদেশের। ছবি: এএফপি
>

২০২৩ বিশ্বকাপ প্রতিবেশী দেশ ভারতে। অনেকটা চেনা কন্ডিশনে ভালো করতে বাংলাদেশকে কী করতে হবে? চার পর্বের ধারাবাহিকের তৃতীয়টি আজ। কোচ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন রানা আব্বাস

মুশফিকুর রহিম যদি কেন উইলিয়ামসনের রানআউটটায় অমন ভজকট না পাকিয়ে ফেলতেন! তামিম ইকবাল যদি ডিপ মিড উইকেটে রোহিত শর্মার ক্যাচটা নিতে পারতেন! ওভাল কিংবা এজবাস্টনের এই দুই ‘ইশ্‌’ অনেক দিন পিছু ছাড়বে না বাংলাদেশকে। মুশফিক উইলিয়ামসনের রানআউট করতে পারলে, তামিম রোহিতের ক্যাচটা নিতে পারলে দুটি ম্যাচের গল্পই হতে পারত অন্য রকম। আর এ দুটি ম্যাচের গল্প অন্য রকম হলে বাংলাদেশকে হয়তো টুর্নামেন্টের ৮ নম্বর দল হয়ে ফিরতে হতো না।

ক্যাচ নিতে না পারা, রানআউট হাতছাড়া খেলারই অংশ। কিন্তু একই ঘটনা বারবার ঘটলে সেটি অবশ্যই চিন্তার বিষয়। এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পেল না, বাংলাদেশ যে সেমিফাইনালে উঠতে পারল না, এটির পেছনে অন্যতম কারণ অবশ্যই জঘন্য ফিল্ডিং। বাংলাদেশ টুর্নামেন্টেরই সবচেয়ে বাজে ফিল্ডিং দল ছিল। এই প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।

এমন কোনো ম্যাচ নেই, যে ম্যাচে বলা যাবে বাংলাদেশের ফিল্ডিংটা দুর্দান্ত হয়েছে। গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে শিশুতোষ সব ভুল! একজন ফিল্ডারের দুই পায়ের ফাঁক গলে বাউন্ডারি হয়ে যাচ্ছে, এক সুযোগে বল ধরতে পারছেন না, দৌড়ে মাঠ কাভার করতে পারছেন না, ওভার থ্রোয়ে রান হচ্ছে—কতবার যে দেখা গেল এমন ছবি! বাজে ফিল্ডিংয়ের ধারাটা কার্ডিফে ২৮ মে ভারতের বিপক্ষে সেই প্রস্তুতি ম্যাচ থেকে শুরু, যেটি পুরো টুর্নামেন্টে বজায় থেকেছে।

এ বিশ্বকাপে ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দেওয়া বড় দুটি ভুল করছেন দলের দুজন সিনিয়র ক্রিকেটার। উইলিয়ামসনের সুযোগ নষ্ট করার পর মুশফিক নিজেকে ‌‌‘অপরাধী’ ভেবে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। তামিমও কুঁকড়ে গিয়েছিলেন ভেতরে-ভেতরে। বাংলাদেশ বাজে ফিল্ডিংয়ের চড়া মূল্য দিয়েছে। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ড ফাইনালে উঠেছে এ বিভাগে দুর্দান্ত করেই। সেমিফাইনালে মার্টিন গাপটিল যে রানআউট করলেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে, সেটিই তো ফাইনালে তুলে দিল কিউইদের।

বোলিং-ব্যাটিং তো আছেই, ফিল্ডিংও শিরোপা জিততে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এই বিশ্বকাপ যেন সেটি আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সবাইকে। এই বিশ্বকাপে প্রত্যেক খেলোয়াড় ফিল্ডিংয়ে কত রান বাঁচিয়েছেন, সেই পরিসংখ্যানও দেখানো হচ্ছিল বারবার। দুর্দান্ত ফিল্ডিং বোলাররাও দারুণ উজ্জীবিত করে। মাঠে খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষায় একধরনের ঝাঁজ থাকে। বাজে ফিল্ডিং দলের সাহসের কলারটাই শুধু নামিয়ে দেয় না, বারবার ক্যাচ পড়লে বোলারদের বোলিং মার্কে ফিরে যাওয়ার সময় ভীষণ ক্লান্ত দেখায়।

বাংলাদেশের ফিল্ডারদের কাছ থেকে কেন এমন চোখধাঁধানো ফিল্ডিং দেখা যায় না? হ্যাঁ, বাংলাদেশের ফিল্ডাররাও কখনো কখনো চোখে লেগে থাকার মতো ক্যাচ ধরেন। বাউন্ডারি বাঁচান। যে তামিম ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন রোহিতের, তাঁর কত দুর্দান্ত ক্যাচ খুঁজে পাওয়া যাবে আর্কাইভে। সমস্যাটা হচ্ছে, ধারাবাহিকতার অভাব। ধারাবাহিকভাবে অসাধারণ ফিল্ডিং বাংলাদেশ করতে পারে না। রোগটা নতুন নয়, পুরোনোই। কিন্তু এবার বিশ্বকাপে এই বাজে ফিল্ডিংয়ের এত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে, বিষয়টি ভীষণ চিন্তার।

বাংলাদেশ কেন ভালো ফিল্ডিং করতে পারে না, সেটির কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন বাংলাদেশ দলের সাবেক সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দীন, ‘প্রথমত আমরা সহজাত অ্যাথলেট না। ভালো অ্যাথলেট না হলে ভালো ফিল্ডিং করা কঠিন। মাঠ ছোট থাকলে কিছুটা ভালো করি। বড় হলে কঠিন হয়ে যায়। আমরা জায়গা কাভার করতে পারি কম।’ সালাউদ্দীন যে মাঠ বড়-ছোটর বিষয়টি বললেন, এ কারণটি কার্ডিফে ইংল্যান্ডের কাছে হারের পর বলেছিলেন সাকিব আল হাসানও। কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনের চৌকোনা মাঠের দুদিকে নাকি বাংলাদেশের ফিল্ডারদের ফিল্ডিং করতে অসুবিধা হচ্ছিল সেদিন।

পৃথিবীর সব জায়গায় তো আর মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম কিংবা জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের মতো মাঠ হবে না। সাকিব-মুশফিকদের গুরু সালাউদ্দীন তাই মনে করেন, ভালো ফিল্ডার হওয়ার প্রস্তুতিটা বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই নেওয়া উচিত, ‘এই অনুশীলনটা বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে করতে হবে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। ভালো অ্যাথলেট হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। তখন থেকে ভালো হলে জাতীয় দলে সমস্যা হয় না। ভালো অ্যাথলেট না হলে তখন মনস্তাত্ত্বিক কিংবা শারীরিক দুটোই বাজে ফিল্ডিংয়ের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’

ফিল্ডিংয়ে ভালো করতে সাকিব-মুশফিকদের আরেক গুরু নাজমুল আবেদীন সালাউদ্দীনের কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘সবাই মনে করি বাইরে থেকে খুব ভালো ফিল্ডিং কোচ এসে ট্রেনিং দিলেই আমরা একেকজন জন্টি রোডস হয়ে যাব! ভালো ফিল্ডিং ইউনিট পেতে হলে অনূর্ধ্ব-১৫ দল থেকে শুরু করতে হবে। তারা যেন নিশ্চিন্তে ডাইভ দিতে পারে, শরীরটা যতভাবে ব্যবহার করা যায়, সেভাবে ব্যবহার করতে হবে। ভবিষ্যতে যারা জাতীয় দলে খেলবে, তাদের উঠে আসার পথটা আরও মসৃণ করতে হবে। ভালো সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সুযোগ-সুবিধা বলতে টাকাপয়সার কথা বলছি না। আধুনিক ফিল্ডিং ট্রেনিং, কোচিং সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়াতে হবে আরও নিচের দিকে। এটা আমরা উপেক্ষা করে আসছি।’

আগামী বিশ্বকাপ মাথায় রেখে এখনই ফিল্ডিংয়ে বিশেষ নজর দিতে বলেছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞেরা। বাজে ফিল্ডিং নিয়ে এই যুগে, আর যা-ই হোক, বিশ্বকাপে ভালো কিছুর আশা না করাই ভালো।