ইংল্যান্ডে শুরু হচ্ছে ক্রিকেটের আরেক 'বিশ্বকাপ'

>

আগামী ৫ আগস্ট ইংল্যান্ডের উস্টারশায়ারে শুরু হচ্ছে ন্যাটওয়েস্ট ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও স্বাগতিক ইংল্যান্ডের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটাররা এ প্রতিযোগিতায় মাঠে নামবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে।

চট্টগ্রামের টগবগে কিশোর শরীফুল। পুরো নাম শরীফুল ইসলাম।  চোখে কত স্বপ্ন। অষ্টম শ্রেণিতের পড়ার সময়  উচ্ছল, উদ্ভাসিত এ কিশোরের জীবনে হঠাৎই নেমে এল দুঃস্বপ্ন। স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রাকের ধাক্কায় পা হারাল সে। মুহূর্তেই হাসি-আনন্দে ভরা জীবনটা হয়ে গেল এলোমেলো। ২০১০ সালের ঘটনা এটি। তবে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের (আইসিআরসি) সহায়তায় চট্টগ্রাম শহরের একটি শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে নকল পা পেল সে। তার নতুন করে স্বপ্ন দেখার শুরু সেখান থেকেই।

ক্রিকেটটা প্রচণ্ড ভালোবাসত শরীফুল। নকল পা পেয়ে সে যখন নতুন করে জীবন শুরু করল, তার ইচ্ছে করল আগের মতো মাঠে গিয়ে ব্যাট-বলের সঙ্গে সখ্য গড়তে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল এই সমাজ। নকল পা লাগিয়ে কি আর ক্রিকেট খেলা যায়? সুস্থ অবস্থায় যারা ছিল শরীফুলের খেলার সঙ্গী, তারাই বাদ সাধল তার ক্রিকেট-আনন্দে। পাড়ার সবাই ক্রিকেট খেলছে আর শরীফুল মাঠের এক কোণে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছে—নিত্যদিনের দৃশ্যপট হয়ে উঠল এটি। কিন্তু শরীফুল বাধা মানবে কেন! সে নিজেই তৈরি করল নতুন এক ক্রিকেট দল। মানসিক শক্তিতে বলীয়ান এ কিশোরের দলটাও দিনে দিনে বড় হয়ে উঠতে লাগল।

নিজের ক্রিকেট-স্বপ্ন আজ পূর্ণতা পেয়েছে। শরীফুল এখন পুরোদস্তুর এক ক্রিকেটার। শারীরিক প্রতিবন্ধী অথচ প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া বিসিবি-শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের একজন সদস্য সে। এই কিশোরের মতোই গল্প বিসিবি-শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের বাকি খেলোয়াড়দেরও। কোনো না কোনো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার এই ছেলেগুলো নিজেদের জীবনের নতুন পথচলার সন্ধান পেয়েছে ক্রিকেট দিয়েই। মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মাহমুদউল্লাহ কিংবা মুশফিকদের মতোই শারীরিক প্রতিবন্ধী এই ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের এক একজন প্রতিনিধি।

লাল-সবুজ পতাকাকে বিদেশের মাটিতে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার দায়িত্ব সাকিব-তামিমদের মতো এই শরীফুল, দ্রুপম পত্রনবিশ, অপূর্ব, তানভীর, ইমরানদের। আগামী ৫ আগস্ট থেকে ইংল্যান্ডের উস্টারশায়ারে অগ্নিপরীক্ষায় নামবে তারা। ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে নিয়ে ইংলিশ ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) আয়োজনে সেখানে শুরু হতে যাচ্ছে ন্যাটওয়েস্ট ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ।

দারুণ মর্যাদাপূর্ণ এ টুর্নামেন্ট অবশ্য বাংলাদেশের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট নয়। এর আগেও দেশে এবং বিদেশের মাটিতে এ দলটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে। এবার বরং বাংলাদেশের লক্ষ্য নিজেদের অতীতের ভুলত্রুটি শুধরে ফাইনাল খেলা এবং শিরোপাটা জিতে নেওয়া।

দলটির অধিনায়কত্ব করছেন দ্রুপম পত্রনবিশ। তিনি নিজের আশাবাদের কথা জানিয়েছেন। দলের সাফল্যের ব্যাপারেও দারুণ আত্মবিশ্বাসী তিনি, ‘আমরা আগেও ইংল্যান্ড গিয়েছি। কয়েকটি ক্লোজ ম্যাচ হেরেছি। মূলত অভিজ্ঞতার অভাবের কারণেই হেরেছিলাম। এবার অনুশীলন ভালো হয়েছে। দলও অনেক ভালো। আশা করছি এবার ভালো কিছুই হবে।’

‘ভালো কিছু’ বলতে আপাতত ফাইনালে খেলার লক্ষ্যের কথা জানিয়েছেন দ্রুপম। তবে ফাইনালে কোনো দল উঠলে তাদের চোখ যে ট্রফিতে থাকে, সেটি না বললেও চলছে।

বিসিবি-শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডে সাফল্য পেতে চায়। ছবি: প্রথম আলো
বিসিবি-শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডে সাফল্য পেতে চায়। ছবি: প্রথম আলো

বিসিবি-শারীরিক প্রতিবন্ধী দলের কোচের দায়িত্ব পালন করছেন রাশেদ ইকবাল। তিনিও ফাইনালে খেলার কথাই বলেছেন, ‘আমরা ফাইনালে খেলতে চাই। এ টুর্নামেন্টে পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড দল খুব শক্তিশালী। তবে এটা ঠিক যে আমরা দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকে আগে হারিয়েছি। ভালো খেললে এবারও হারানো সম্ভব।’

এবার ভালো করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছে বাংলাদেশ। রাশেদ জানালেন এবার বিশেষ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন কোচিং স্টাফরা, ‘ফুডিং, নিউট্রিশন নিয়ে এবার কাজ করেছি। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টুর্নামেন্টকে সামনে রেখে প্রস্তুতিটা মোটামুটি ভালোই হয়েছে।’

দলের ম্যানেজার মাসুদ হাসান। বিকেএসপির কোচ হিসেবে এক সময় সাকিব আল হাসানের মতো তারকাকে ক্রিকেট শিখিয়েছেন। তিনি ইংল্যান্ডের টুর্নামেন্ট নিয়ে আশাবাদী হলেও তুলে ধরলেন বাংলাদেশের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের মূল চ্যালেঞ্জটা। তাঁর মতে, এই চ্যালেঞ্জটা মূলত সংস্কৃতিগত, ‘পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের সংস্কৃতিটা অন্যরকম। ওরা অনেক আগে থেকে প্রতিবন্ধী ক্রিকেট চালাচ্ছে। তাদের অবকাঠামো অন্যরকম। তাদের নিয়মিত ঘরোয়া টুর্নামেন্ট হয়। ক্লাবগুলোর শারীরিক প্রতিবন্ধীদের দল আছে। কিন্তু আমাদের এসব নেই। সারা বছর আমাদের প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের আমরা অনুশীলনেও রাখতে পারি না।’
৫ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় এ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ৫ আগস্ট, আফগানিস্তানের বিপক্ষে, কিডারমিনস্টারে। ৭ ও ৮ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ যথাক্রমে ওল্ড এলিজাবেথানস ও বার্নট গ্রিনে। ৯ আগস্ট স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ব্রমসগ্রোভে।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট শুরু হয়। এটি সম্ভব হয় আইসিআরসির সহায়তাতেই। তারাই সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজডকে (সিআরপি) এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। সে বছরই শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করে আইসিআরসি।

২০১৪ সাল থেকে এই উদ্যোগ গতি পায়। বাংলাদেশ ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডিজঅ্যাবলড অ্যাসোসিয়েশন ও ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) ও সিআরপি শারীরিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে। এর আগে অবশ্য সিআরপির একটি ক্রিকেট দল ভারতের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের একটি সংগঠন ডিসঅ্যাবলড স্পোর্টিং সোসাইটির (ডিএসএস) বিপক্ষে একটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল।

এর পরপরই এ উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), প্যারা অলিম্পিকস, স্পেশাল অলিম্পিকস, ব্রিটিশ হাইকমিশন ও ইংলিশ ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)।

আইসিআরসি প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিও সফলভাবে করেছে। ২০১৫ সালে ঢাকায় ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে নিয়ে একটি টুর্নামেন্টও আয়োজিত হয়। ২০১৬ সালে আইসিআরসির সহায়তায় বিসিবি শারীরিক প্রতিবন্ধী দল দুবাইয়ে একটি টুর্নামেন্টে অংশ নেয়। ২০১৬ ও ২০১৭ সালেও দুটি প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল আইসিআরসি। সম্প্রতি বিসিবি নিজেদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের জন্য একটি বিশেষ উইং খুলেছে। ভবিষ্যতে দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের প্রসার অন্য মাত্রা পাবে—এটা আশা করাই যায়।