এ তো বিশ্বকাপই!

বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর দায়িত্বে আছেন তাঁরাও। ছবি: প্রথম আলো
বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর দায়িত্বে আছেন তাঁরাও। ছবি: প্রথম আলো
ইংল্যান্ডের উস্টারশায়ারে আজ শুরু হচ্ছে ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটি ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট। খেলছে স্বাগতিক ইংল্যান্ডসহ ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ। শুরুর দিনই আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলবে বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল।


টুর্নামেন্টটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ’। এক সময় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তিন জাতির ওয়ানডে টুর্নামেন্টকে বলা হতো ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ টুর্নামেন্ট’। বৈশ্বিক আবহটা সেখানে তেমনভাবে না থাকার পরেও। কিন্তু আজ থেকে ইংল্যান্ডের উস্টারশায়ারে যে ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ’ শুরু হতে যাচ্ছে, সেটি এক অর্থে বৈশ্বিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতাই—শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বৈশ্বিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতা।


প্রশ্ন উঠতে পারে, টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা নিয়ে। স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সঙ্গে উপমহাদেশের তিন দল—ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সঙ্গে আফগানিস্তান। এটি বৈশ্বিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতা হয় কীভাবে! খুবই যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। আসলে প্রতিভাবান অথচ কোনো দুর্ভাগ্যজনক কারণে অঙ্গহানি ঘটায় স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত—এমন ক্রিকেটারদের নিয়ে আলাদা করে জাতীয় দল গড়ার উদ্যোগটাই খুব বেশি দিনের পুরোনো নয়। এমন ক্রিকেটারদের নিয়ে জাতীয় দল গড়ায় উৎসাহী দেশগুলোর সংখ্যাও খুব বেশি নয়।

এ ব্যাপারে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর উৎসাহ তৈরি করতেই এমন ঝাঁজালো নামের উৎপত্তি। কিন্তু টুর্নামেন্টের উদ্বোধনটা যেভাবে গতকাল হয়ে গেল, তাতে নামটা ভালোই মানিয়ে যাচ্ছে। উস্টার শহরের ক্রিকেট কেন্দ্র উস্টারশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট দলের নিজস্ব মাঠ ব্ল্যাকফিঞ্চ নিউ রোডে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মার্চপাস্ট আর উপস্থিত দর্শকদের করতালি এই ওয়ার্ল্ড সিরিজ প্রতিযোগিতার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করে দিয়েছে।

ইংল্যান্ডে এই মুহূর্তে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গেছে। যেকোনো সাফল্যই মানুষকে কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহী করে তোলে—এটা যে কেবল কথার কথা নয়, সেটা বোঝা যাচ্ছে ইংল্যান্ডে এসে। বিশ্বকাপ জেতায় ক্রিকেট খেলাকে, ক্রিকেটারদের বাড়তি মর্যাদা করছেন ইংল্যান্ডের মানুষ। গতকাল উস্টারশায়ার কাউন্টি মাঠে ভ্যালিডিটি টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে দর্শক উপস্থিতি দেখে অবাক হতেই হয়। ঘরোয়া কোনো প্রতিযোগিতার কোনো ম্যাচ নিয়ে দর্শকদের যে এমন আগ্রহ থাকতে পারে, মানুষ যে এমন উৎসবের আবহ তৈরি করে মাঠে ছুটে আসতে পারে, সেটি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। খেলাটা ছিল উস্টারশায়ার কাউন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি উস্টারশায়ার র‍্যাপিডস ও লেস্টারশায়ার ফক্সের ম্যাচ। বড় তারকা বলতে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের ট্র্যাজিক হিরো (বিশ্বকাপ ফাইনালের কারণে) মার্টিন গাপটিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়েন পারনেল।

সব ছাপিয়ে একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি একটা এলাকার মানুষের কী ধরনের আবেগ থাকতে পারে, সেটা আজ বোঝা গেছে নিউ রোডে। এই ম্যাচটির মধ্য বিরতিতেই ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটি ওয়ার্ল্ড সিরিজে অংশগ্রহণকারী দলগুলো যখন জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে গোটা মাঠ প্রদক্ষিণ করল, তখন অন্যরকম আবেগ ছুঁয়ে গেল সবাইকে। মাঠের সব দর্শক দাঁড়িয়ে সংবর্ধনা দিল প্রতিটি দলকে। তাদের আবেগময় করতালি যেন জানিয়ে দিল শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে যারা ক্রিকেট খেলতে পারে, তাদের চেয়ে বড় বীর আর কে হতে পারে! এই বীরদের অংশগ্রহণে ক্রিকেট খেলাটার মর্যাদাই যেন বহুগুণে বেড়ে যায়।

টুর্নামেন্টের শুরুর দিনেই খেলা বাংলাদেশের। আফগানিস্তানের সঙ্গে উস্টার শহরের কাছেই কিডারমিনস্টার নামের একটা জায়গায়। বাংলাদেশের এই শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলটিকে গড়তে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের রয়েছে মহাগুরুত্বপূর্ণ অবদান। বিভিন্নভাবে প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তুলে আনা হয়েছে এই ক্রিকেট প্রতিভাদের। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) দিচ্ছে সব ধরনের সহযোগিতা। দলটার নাম তাই বিসিবি-ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটি ক্রিকেট দল। নাম যা-ই হোক, ইংল্যান্ডের মাটিতে এই টুর্নামেন্টে এ দলটা বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব করছে, এক দিক দিয়ে এটি শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের জাতীয় দলই।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি নিয়ে বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী দল আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। উস্টারেই একটি ক্রিকেট ক্লাবের মাঠে নেট অনুশীলন করেছে দলটি। দলের কোচ রাশেদ ইকবাল এ দলটিকে ফাইনালে তোলার স্বপ্ন দেখেন। তবে দলের খেলোয়াড়দের মনোবলের ঘাটতিটা কিছুটা শঙ্কা তৈরি করছে তাঁর মধ্যে, ‘আমার দল প্রতিভাবান। এই দলের খেলোয়াড়দের ফাইনালে খেলার সামর্থ্য আছে। ওরা প্রতিভাবান। তবে টেম্পারামেন্ট একটা বড় ব্যাপার। অন্য দলগুলোর সঙ্গে এই জায়গায় আমাদের কিছুটা পার্থক্য হতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস ওরা ফাইনালে খেলবে, এ স্বপ্নটা আমি দেখি।’

ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া যায় বেশি করে ম্যাচ খেলে। কিন্তু আমাদের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় না। অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলের খেলোয়াড়েরা ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ইংল্যান্ড, পাকিস্তানে আলাদা ঘরোয়া প্রতিযোগিতাও হয়। ভারতীয় দল এখানে এসেছ ৩০ জনের দল নিয়ে, দলের সঙ্গে কম্পিউটার অ্যানালিস্টও আছেন। দলটার ফিজিও হিসেবে কাজ করছেন এমন একজন যিনি রঞ্জি ট্রফিতে দীর্ঘদিন মুম্বাই দলের ফিজিও ছিলেন। প্রতিটি দলের প্রস্তুতিই ভালো। এর মধ্যে বাংলাদেশকে ভালো করতে বড় চ্যালেঞ্জই নিতে হবে।

ক্রিকেট খেলাটাই যাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, তারা তাদের সামনে আসা নতুন চ্যালেঞ্জগুলোকে সামলে নেবে—এটা আশা করাই যায়!

বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী দল: দ্রুপম পত্রনবিশ (অধিনায়ক), রাসেল শিকদার, মনির হোসেন, কাজল হোসেন, মনিরুজ্জামান, আলম খান, জাভেদ ভূঁইয়া, আকবল হোসেন, মোহাম্মদ ইমরান, মাহফুজুর রহমান, শাহরিয়া শামীম, শারীফুল ইসলাম, অপূর্ব কুমার পাল, তানভীরুল ইসলাম, জাহিদ হাসান, মাহবুবুল আলম, রাশেদ ইকবাল (কোচ) দেলোয়ার হোসেন (ফিজিও), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (কন্ডিশনিং কোচ)