টেস্ট ইতিহাসের কয়েকটি 'মহাকাব্য'

লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের সেই দুই ইনিংস টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ঘুরে দাঁড়ানো! ছবি : টুইটার
লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের সেই দুই ইনিংস টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ঘুরে দাঁড়ানো! ছবি : টুইটার
>টেস্ট ক্রিকেট তাঁর ১৪৩ বছরের ইতিহাসে অনেক ধ্রুপদি ঘটনারই জন্ম দিয়েছে। টেস্টের বেশ কিছু ইনিংস ইতিহাস লিখেছে নতুন করেই। ভিভিএস লক্ষ্মণ থেকে রাহুল দ্রাবিড়, ইয়ান বোথাম থেকে ব্রায়ান লারা কিংবা গ্রায়েম স্মিথ, বেন স্টোকসদের এক একটি ইনিংস যেন টেস্ট ক্রিকেটকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

ইংল্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান জিওফ বয়কটের একটা টুইট দিয়ে শুরু করা যাক। বেন স্টোকসের বীরত্বপূর্ণ ইনিংস দেখে তিনি রীতিমতো মুগ্ধ, ‘আমি আমার জীবনে অনেক অসাধারণ ক্রিকেটীয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছি। কিন্তু স্টোকসের এই ইনিংসটির মতো কিছু গত পঞ্চাশ বছরে দেখিনি! অ্যাশেজটাও বাঁচাল, জাদুকরী এক ইনিংস খেলল। ওর বিশ্বকাপের ইনিংসটার চেয়েও এগিয়ে থাকবে এটি।’

শুধু বয়কট না, অনেকের চোখেই টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস স্টোকসেরটা। অবিস্মরণীয় ‘কামব্যাক’ ইনিংস। হেডিংলির এই ম্যাচজয়ী ইনিংসটি তাঁকে নিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। এ ইনিংসে তিনি ব্রাকেটবন্দী হয়ে গেছেন, ব্রায়ান লারা, শচীন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষ্মণ, রাহুল দ্রাবিড়, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, গ্রায়েম স্মিথদের সঙ্গে।

ভিভিএস লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড়, কলকাতা, ২০০১
টেস্টে ‘কামব্যাক’ শব্দটা শুনলেই এই দুজনের নাম মনে পড়ে যেন। ২০০১ সালের মার্চে কলকাতা টেস্টে মহাকাব্য রচনা করেছিলেন লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ৪৪৫ রান তুলে চাপে ফেলেছিল ভারতকে। জবাবে সৌরভ গাঙ্গুলীর দল গুটিয়ে গিয়েছিল ১৭১ রানেই। ফলোঅনে নেমে সবার সব হিসাব পালটে দেওয়া শুরু করল লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের সেই জুটি। ৬৩১ মিনিট ক্রিজে ছিলেন লক্ষণ, খেলেছিলেন ৪৫২টি বল। ৪৪টি চারের মারে খেলেছিলেন জীবনের সেরা ইনিংস— ২৮১। ওদিকে লক্ষ্মণের সঙ্গে রেকর্ড জুটিতে ১৮০ রান করেছিলেন দ্রাবিড়। ৩৫৩ বল খেলেছিলেন ৪৪৬ মিনিটের ইনিংসে। দ্রাবিড়ের ব্যাট থেকে এসেছিল ২০টি চার। সাত উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে ৬৫৭ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। পরে হরভজন সিংয়ের তাণ্ডবে ২১২ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। হারের মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অসাধারণ এক ইতিহাসের জন্ম দেয় ভারত।

ব্রায়ান লারা, বার্বাডোজ, ১৯৯৯
১৯৯৯ সালের মার্চে বার্বাডোজ দেখেছিল এক লারা-মহাকাব্য। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩০৮ রানের লক্ষ্যমাত্রায় দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে একাই ১৫৩ রানের ইনিংস খেলেন ব্রায়ান লারা। দলীয় ২৪৮ রানে ৮ উইকেট হারানোর পর দুই পেসার কার্টলি অ্যামব্রোস আর কোর্টনি ওয়ালশকে সঙ্গে নিয়ে আস্তে আস্তে জয়ের দিকে দলকে নিয়ে যান ক্যারিবীয় কিংবদন্তি। ৩৫৫ মিনিট ধরে বুক চিতিয়ে লড়ে যান গ্লেন ম্যাকগ্রা, শেন ওয়ার্ন, জেসন গিলেস্পি ও স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলদের। 

লারার এই ইনিংসটা অনেকের চোখেই টেস্ট ইতিহাসের সেরা। ছবি : টুইটার
লারার এই ইনিংসটা অনেকের চোখেই টেস্ট ইতিহাসের সেরা। ছবি : টুইটার

ওমারি বাঙ্কস, রামনরেশ সারওয়ান ও শিবনারায়ন চন্দরপল, অ্যান্টিগা, ২০০৩
এবারও শ্বাসরুদ্ধকর পরিসমাপ্তির কারিগর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবারও হৃদয় ভেঙেছিল অস্ট্রেলিয়ানদের। অ্যান্টিগা টেস্টে দুই ওপেনার ম্যাথু হেইডেন আর জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ব্যাটে চড়ে উইন্ডিজের সামনে ৪১৮ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল অসিরা। ম্যাচ জিততে হলে ক্যারিবীয়দের বিশ্ব রেকর্ড গড়ে জেতা লাগত। সে লক্ষ্যে ক্রিস গেইল বা ব্রায়ান লারা, কেউই সফল হতে পারেননি। কিন্তু শিবনারায়ন চন্দরপল আর রামনরেশ সারওয়ান, কিংবা আট নম্বরে ব্যাট করতে নামা ওমারি বাঙ্কসের পরিকল্পনার মধ্যে আর যাই হোক, ম্যাচ হারা ছিল না! চন্দরপল-সারওয়ানের দুই সেঞ্চুরির ওপর ভর করে ৩৭২ রান পর্যন্ত যেতে পারলেও, ম্যাচ জেতার জন্য আরও কিছু করা লাগত উইন্ডিজের। আর সেটাই করেছিলেন বাঙ্কস। ভ্যাসবার্ট ড্রেকসকে সঙ্গে নিয়ে শতাধিক বল খেলে ৪৭ রান করে উইন্ডিজকে জিতিয়েই ছেড়েছিলেন এই ডানহাতি অফ স্পিনার!

শচীন টেন্ডুলকার, চেন্নাই, ২০০৮
২০০৮ সালে চেন্নাই টেস্টের শেষ দিনে ভারতের দিকে ৩৮৭ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েছিল কেভিন পিটারসেনের ইংল্যান্ড। শেষ দিনে মন্টি পানেসার আর গ্রায়েম সোয়ানের ঘূর্ণি সামলে ১০৬ রানের এক অপরাজিত অনবদ্য ইনিংস খেলেছিলেন 'লিটল জিনিয়াস' শচীন টেন্ডুলকার। তাতেই ম্যাচ জিতে যায় ভারত।

গ্রায়েম স্মিথ, বার্মিংহাম, ২০০৮
বার্মিংহাম টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে জেতার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার লাগত ২৮৩ রান। প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের অন্য কেউই যেখানে তিরিশ পেরোতে পারেননি, সেখানে অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ একাই দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্দান্তভাবে মোকাবিলা করা শুরু করলেন জেমস অ্যান্ডারসন, মন্টি পানেসার ও অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফদের। ২৪৬ বলে অপরাজিত ১৫৪ করে দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন স্মিথ। আর তাতেই ৪৩ বছর পর ইংল্যান্ডে সিরিজ জেতে দক্ষিণ আফ্রিকা।

ইয়ান বোথাম, হেডিংলি, ১৯৮১
১৯৮১ সালের অ্যাশেজের হেডিংলি টেস্ট। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার চারশ' ছাড়ানো স্কোর করতে সমস্যা হলো না। নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড করল ১৭৪। ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিলে শুধু অলরাউন্ডার ইয়ান বোথামই ছিলেন সফল, ৫৪ বলে ৫০ রান করেছিলেন তিনি। ফলোঅনে পড়ল ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ইনিংসেও একই দশা, ১৩৫ রান তুলতে গিয়ে ৭ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড তখন রীতিমতো ধুঁকছে। কিন্তু বোথাম যে এই ম্যাচকেই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠার উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন!

দ্বিতীয় ইনিংসে দুই বোলার গ্রাহাম ডিলি আর ক্রিস ওল্ডকে সঙ্গী করে খেললেন ১৪৯ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। যে ম্যাচে ইংল্যান্ডের ইনিংসে হারার কথা ছিল, উল্টো দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে ১৩০ রানের টার্গেট দিলেন বোথামরা। বোথামের মতো পেসার বব উইলিসও দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের ছন্দ খুঁজে পেলেন। উইলিসের গতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা। ১১১ রানে গুটিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া, অবিশ্বাস্যভাবে টেস্ট জিতল ইংল্যান্ড।

বোথামের ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা ইনিংস হয়ে আছে এটা। ছবি : টুইটার
বোথামের ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা ইনিংস হয়ে আছে এটা। ছবি : টুইটার

অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, হোবার্ট, ১৯৯৯
৩৬৯ রান তাড়া করতে গিয়ে ১২৬ রানে অস্ট্রেলিয়া হারিয়ে বসে ৫ উইকেট। সে‌ পরিস্থিতিতে মাঠে নেমে অবিশ্বাস্য প্রতি আক্রমণ শুরু করলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ল্যাঙ্গারের সঙ্গে গড়লেন ২৩৮ রানের জুটি। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতার, সাকলাইন মুশতাক ও আজহার মেহমুদরা কিছুক্ষণ আগেই যে হোবার্টের পিচে ত্রাস ছড়াচ্ছিলেন, গিলক্রিস্ট আসার পর সবাই হয়ে গেলেন নির্বিষ। ল্যাঙ্গার ১২৭ রানে আউট হলেও ১৬৩ বলে ১৪৯ করে দলকে জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছিলেন গিলি।

কুশল পেরেরা, ডারবান, ২০১৯
কিছুদিন আগের ঘটনা এটা। ডারবান টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ৩০৪ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে বসা শ্রীলঙ্কা একপর্যায়ে ২২৬ রানে হারায় ৯ উইকেট। তখনই অনুমেয় ছিল লঙ্কানদের পরাজয় নিশ্চিত। দলের এমন কঠিন মুহূর্তে বিশ্ব ফার্নান্দোকে সঙ্গে নিয়ে শেষ উইকেটে রেকর্ড ৭৮ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন পেরেরা। পেরেরা অপরাজিত থাকেন ১৫৩ রানে। 

মহাকাব্য রচনা করেছিলেন কুশল পেরেরাও। ছবি : টুইটার
মহাকাব্য রচনা করেছিলেন কুশল পেরেরাও। ছবি : টুইটার