টেস্ট ক্রিকেট তো জীবনেরই আয়না

শুধু একটি ম্যাচ জেতানোই নয়, স্টোকস যেন জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার বার্তাই দিলেন হেডিংলিতে। ছবি: রয়টার্স
শুধু একটি ম্যাচ জেতানোই নয়, স্টোকস যেন জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার বার্তাই দিলেন হেডিংলিতে। ছবি: রয়টার্স
>বেন স্টোকস নামের এক অতিমানব কাল আরও একবার প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন, টেস্ট ক্রিকেট কেবল ব্যাট-বলের লড়াইয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটি এমন এক পরীক্ষা, জীবন নামের কঠিন পরীক্ষার সঙ্গে যার বড্ড বেশি মিল।

টি-টোয়েন্টির এই যুগে টেস্ট ক্রিকেট না কি আর চলে না। দিনভর ব্যস্ততার মাঝে পাঁচদিন ধরে ‘বিরক্তিকর’ ক্রিকেট দেখার ধৈর্য হয় না অনেকেরই। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট তো শুধু নিছক একটি খেলাই নয়! বেন স্টোকস নামের এক ‘অতিমানব’ কাল আরও একবার প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন, টেস্ট ক্রিকেট ব্যাট-বলের লড়াইয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটি এমন এক পরীক্ষা, জীবন নামের কঠিন পরীক্ষার সঙ্গে যার অনেক অনেক মিল।

জীবন মাঝে মাঝে মানুষকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, লক্ষ্যপূরণের আগেই হতাশা ঘিরে ধরে প্রবলভাবে। তাড়া করতে থাকা স্বপ্নটা দেখায় বড্ড ফিকে, সফল হওয়ার সম্ভাবনা চলে যায় শূন্যের কোটায়। দুর্বল চিত্তের মানুষেরা তখন আশা হারিয়ে আত্মসমর্পণ করেন নিয়তির কাছে। তবে জীবন সবাইকেই দ্বিতীয় সুযোগ দেয়। কিন্তু সে সুযোগ নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি যে সবার থাকে না! রুপালি পর্দার জগতে যেমন সুপারহিরো আছে, বাস্তব জীবনেও তেমনি রক্ত-মাংসের সুপারহিরো আছেন। সেই সুপারহিরোরা ভাগ্যে বিশ্বাস করেন না, বরং সামর্থ্য দিয়ে ভাগ্যকে টেনে নেন নিজের দিকে।

কয়েক মাস আগে ডারবানে কুশল পেরেরা দেখিয়েছিলেন, লক্ষ্যে অবিচল থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারে না। কাল যেন সেটিকে অন্য মাত্রা দিলেন স্টোকস। মরিয়া হয়ে রিভিউ নিয়েও যখন আউট হওয়া থেকে বাঁচতে পারলেন না স্টুয়ার্ট ব্রড, ৩৫৯ রানের লক্ষ্য থেকে ইংল্যান্ড তখনো ৭৩ রান দূরে। হেডিংলির গ্যালারিতে প্রাণোচ্ছল ইংলিশ সমর্থকদের উচ্ছ্বাসে তখন ভাটা পড়েছে। চরম আশাবাদী ইংলিশ সমর্থকও হয়তো তখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলে দিন শেষে স্টোকস পাল্টে দিয়েছেন সব হিসাব। পরিস্থিতি কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে, সঙ্গীহারা হয়েছেন বারবার। কিন্তু স্টোকসের চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না কখনোই। জীবনের সব অধ্যায়ের পাঠ যে এরই মধ্যে মোটামুটি নেওয়া হয়ে গেছে তাঁর!

কলকাতায় ২০১৬ টি-টোয়েন্টি ফাইনালের শেষ ওভারে কার্লোস ব্রাফেটের হাতে টানা চার ছক্কা খেয়ে শিরোপাটাই হাত থেকে ফেলে দিয়েছিলেন স্টোকস। বছর দু-এক পর পানশালার বাইরে মারামারি করে দল থেকে নিষিদ্ধও হলেন। জীবন স্টোকসকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে ২০১৯-এ এসে। লর্ডসে বিশ্বকাপ ফাইনালে স্নায়ুচাপ ধরে রেখে ইংল্যান্ডকে জেতালেন প্রথম শিরোপা। আর এবার অ্যাশেজ ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ইনিংস খেলে স্টোকস যেন সাধারণ মানুষদের উদ্দেশ্যেই বার্তা দিলেন, ‘দেখো, জীবন কখনো খালি হাতে ফেরায় না!’

ইংলিশ ক্রিকেটে নিজের নামটা অমর করে রাখলেন বেন স্টোকস? ছবি: রয়টার্স
ইংলিশ ক্রিকেটে নিজের নামটা অমর করে রাখলেন বেন স্টোকস? ছবি: রয়টার্স

চার দিনের হেডিংলি টেস্ট যেন মানুষের জীবনেরই ‘বনসাই ভার্শন’। জীবনের প্রতিটি উত্থান-পতনের সঙ্গে যেন আশ্চর্য মিল হেডিংলি টেস্টের! জফরা আর্চারের আগুনে পুড়ে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া যখন অলআউট হলো মাত্র ১৭৯ রানে, ইংল্যান্ড তখন সুবিধাজনক অবস্থানে। কিন্তু সেই সুবিধা নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো নিজেদের প্রথম ইনিংসে জো রুটের দল অলআউট হলো ৬৭ রানে। মানুষের জীবনেও কি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় না? নিজেদের ভুলে সহজ সুযোগ হাতছাড়া করে হাপিত্যেশ করতে হয় অনেক সময়, সুযোগ হারানোর যন্ত্রণাতেও পুড়তে হয়।

প্রথম ইনিংসের অমন ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর ইংল্যান্ড এই টেস্ট জিততে পারে, এমনটা বিশ্বাস করার লোক খুব বেশি ছিল না। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৪৬ রান করে অস্ট্রেলিয়া যখন ৩৫৯ রানের লক্ষ্য দিল, তখন তো ইংলিশদের জয়ের স্বপ্ন আরও ধূসর। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসেই চতুর্থ ইনিংসে এত রান তাড়া করে কখনো জেতেনি ক্রিকেটের জনকেরা। ৭৩ রান বাকি থাকতেই যখন নয় উইকেট হারিয়ে ফেলল ইংল্যান্ড, জয় তখন একপ্রকার অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই হয়তো হতাশ হয়ে পড়া মানুষের মতো হাল ছেড়ে দিত মাঝপথেই। কিন্তু সব মানুষ তো আর হাল ছেড়ে দেয় না। কেউ কেউ আছেন, যারা হতাশাকে জয় করতে জানেন। নিজের শৌর্য দিয়ে অন্যের জন্য উদাহরণ তৈরি করেন। আশা হারিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া মানুষের জন্য বার্তা দেন, নিজের ওপর বিশ্বাস থাকলে যেকোনো প্রতিকূলতাই জয় করা সম্ভব।

জীবনে অনেক পরিস্থিতির সঙ্গেই মানিয়ে নিতে হয় মানুষকে। কখনো মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়, আবার কখনো বা বুক চিতিয়ে নিজের জাতটা চেনাতে হয়। স্টোকস কাল করেছেন দুটি কাজই। ইনিংসের প্রথম ভাগে মাটি কামড়ে উইকেটে পড়ে ছিলেন। চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর সময় ৫০ বল শেষে তাঁর রান ছিল মাত্র ২। জো রুট যখন আউট হলেন, স্টোকসের রান তখন ৬৭ বলে ৩! সেই স্টোকসই নিজের শেষ ৪৫ বলে করেছেন ৭৪ রান, আট ছক্কার মধ্যে সাতটিই মেরেছেন জ্যাক লিচের সঙ্গে শেষ উইকেট জুটিতে। জীবনে কীভাবে পরিস্থিতির দাবি মেটাতে নিজেকে ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে হয়, স্টোকসের ইনিংস যেন সেটিই দেখাল।

বীরপুরুষদের না কি ভাগ্যও কিছুটা সঙ্গ দেয়। ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছেন স্টোকসও। ৩৩ রানের মাথায় স্লিপে তাঁর ক্যাচ হাতে রাখতে পারেননি ওয়ার্নার। জয়ের জন্য দুই রান বাকি থাকতে নিশ্চিত এলবিডব্লু থেকে বেঁচে গেছেন অস্ট্রেলিয়ার রিভিউ না থাকায়। ভাগ্য অনেককেই হয়তো সহায়তার হাত বাড়ায়, কিন্তু সেটির ফায়দা নিতে জানেন কয়জন! পরাজয়ই যার একমাত্র ভবিতব্য বলে মনে হয়, সেই মানুষও মুষ্টিবদ্ধ উদ্‌যাপন করে জয়ের সুখ উপভোগ করতে পারে। দরকার কেবল তিনটি জিনিস- ধৈর্য, সাহস ও আত্মবিশ্বাস। নিজের ওপর আস্থা হারাননি বলেই স্টোকসের নাম উঠল বিজয়ীর দলে।

টি-টেন, টি-টোয়েন্টির যুগে টেস্ট ক্রিকেট হয়তো জৌলুস হারিয়েছে অনেকটা। কিন্তু জীবনের বাঁকে বাঁকে যে নাটকীয়তা ও অনিশ্চয়তা, সেটি কেবল টেস্ট ক্রিকেটেই মেলে। দিন শেষে টেস্ট ক্রিকেট যে জীবনেরই আয়না!