এ বলে আমায় রাখো, ও বলে আমায়

কার ইনিংসটি সেরা? পেরেরা নাকি স্টোকসের? ফাইল ছবি
কার ইনিংসটি সেরা? পেরেরা নাকি স্টোকসের? ফাইল ছবি
>প্রায় একই পরিস্থিতিতে একই ধরনের ইনিংস খেলেছেন দুজন। অ্যাশেজ বলে পাদপ্রদীপের আলোতে ঠাঁই পেয়েছে স্টোকসের ইনিংসটি। কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় পিছিয়ে নেই পেরেরার ইনিংসটিও

ইতিহাসের সেরা ইনিংস কি না—সে আলোচনা চলছে। গতকাল অ্যাশেজে এমনই এক ইনিংস খেলেছেন বেন স্টোকস যে নিকট অতীত বাদ দিয়ে সর্বকালের সেরা ইনিংসগুলোর হিসাব নিকাশ চলছে এখন। বয়কট পর্যন্ত বলছেন, গত পঞ্চাশ বছরে এমন ইনিংস দেখেননি। বয়কট নাও দেখতে পারেন, কারণ কালই বিশ্বের তিন প্রান্তে তিনটি টেস্ট হয়েছে। সবার পক্ষে সব জায়গায় নজর দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ক্রীড়া বিশ্লেষকেরা যেভাবে কুশল পেরেরার কথা ভুলে গেলেন সেটা বিস্ময়করই। কারণ বেন স্টোকস যা করে দেখিয়েছেন, বিশ্বকাপের আগেই সেটা করে দেখিয়েছেন শ্রীলঙ্কার এই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান।

প্রায় একই পরিস্থিতিতে একই ধরনের ইনিংস খেলেছেন দুজন। অ্যাশেজ বলে পাদপ্রদীপের আলোতে ঠাঁই পেয়েছে স্টোকসের ইনিংসটি। কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় পিছিয়ে নেই কোনোটিই। স্বাভাবিকভাবেই দুটি ইনিংসের মাঝে তুলনা এসে যায়। প্রশ্নও জাগে কার ইনিংসটি সেরা? সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে চলুন দেখে দুই ইনিংসের প্রেক্ষাপট—

ম্যাচ পরিস্থিতি:

কুশল পেরেরা
ডারবান টেস্ট, ফেব্রুয়ারি ২০১৯
৩০৪ রানের লক্ষ্যে নেমে ২২৬ রানেই ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয় টেস্ট জিততে ৭৮ রান দরকার ছিল লঙ্কানদের। অন্য প্রান্তে থাকা বিশ্ব ফার্নান্দোর ব্যাটিং দক্ষতা নিয়ে কখনো প্রশংসনীয় কিছু শোনা যায়নি। ডেল স্টেইন, কাগিসো রাবাদা, ভারনন ফিল্যান্ডার ও ডোয়াইন অলিভারের সামনে সফরকারীরা কখন গুটিয়ে যায় সে অপেক্ষায় ছিল সবাই।

বেন স্টোকস
হেডিংলি টেস্ট, আগস্ট ২০১৯
৩৫৯ রানের লক্ষ্য। ১৪২ বছরের ইতিহাসে এত বড় লক্ষ্য কখনো তাড়া করেনি ইংল্যান্ড। সে লক্ষ্যে ২৮৬ রানে নবম উইকেট হারায় ইংল্যান্ড, লক্ষ্য তখনো ৭৩ রান দূরে। এগারোতে নামা জ্যাক লিচের ব্যাটিং দক্ষতা খারাপ নয়, নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে নেমে ৯২ রানের ইনিংস খেলেছেন টেস্টে। তবু প্যাট কামিন্স, জশ হ্যাজলউড, প্যাটিনসন ও লায়নের সামনে ইংল্যান্ডের আরেকটি হারই ছিল স্বাভাবিক ফল।

অবিশ্বাস্য এক মুহূর্তের জন্ম দিয়েছিলেন পেরেরা। ফাইল ছবি
অবিশ্বাস্য এক মুহূর্তের জন্ম দিয়েছিলেন পেরেরা। ফাইল ছবি

ম্যাচের পারিপার্শ্বিক অবস্থা:

পেরেরা
নিজেদের ইতিহাসেরই সবচেয়ে দুর্বল দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। রঙ্গনা হেরাথ বিদায় বলেছেন বহু আগেই। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস ও দিনেশ চান্ডিমালদের মতো অভিজ্ঞরাও ছিলেন না সে সিরিজে। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে কদিন আগেই নাকানিচুবানি খেয়ে গেছে উপমহাদেশের আরেক দল। এমন অবস্থায় জয়ের স্বপ্ন দেখাটাই বাড়াবাড়ি। ৭৮ রান দূরে থাকা অবস্থায় ৯ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর তো প্রায় অসম্ভবই।

স্টোকস
বিশ্বকাপ জয়ের পর আত্মবিশ্বাসী ইংল্যান্ড অ্যাশেজের প্রথম দুই টেস্টেই ধাক্কা খেয়েছে। হেডিংলি টেস্টও হারার পথে। আর হারলেই দুই ম্যাচ হাতে রেখেই অ্যাশেজ পেয়ে যাবে অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ইনিংসে ৬৭ রানে গুটিয়ে যাওয়া ইংল্যান্ড ৩৫৯ রানের লক্ষ্য ছোঁবে এটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কেউই। ঘরের মাঠে খেলা হলেও ২৮৬ রানে ৯ উইকেট পড়ার পর অ্যাশেজের মতো মঞ্চে, ভয়ংকর চাপের মুখে তো সেটা আরও বেশি কল্পনাতীত।

ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত অবস্থা:

পেরেরা
প্রথম ইনিংসে ৫১ রান করে দলের সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন পেরেরা। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম ইনিংসের মতোই বাজে পরিস্থিতিতে নেমেছিলেন। ৩০৪ রানের লক্ষ্যে নামা দল ৫২ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল। ব্যাটিং লাইনআপের অর্ধেক বিদায় নিয়েছে দলকে ১১০ রানে রেখেই। শেষ আশা ধনঞ্জয়াও বিদায় নিয়েছিলেন ২০৬ রানে। এমন অবস্থাতেও মাঠ ছেড়েছেন ম্যাচ জিতেই। পাক্কা ৫ ঘণ্টার বেশি মাঠে ছিলেন। ২০০ বল খেলে ১২ চার ও ৫ ছক্কায় ক্যারিয়ার সেরা ১৫৩ রানে অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দিয়েছেন পেরেরা।

স্টোকস
প্রথম ইনিংসে মাত্র ৮ রান করেছেন। দলের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের মাঝে চোখের জন্য সবচেয়ে অপ্রীতিকর ছিল তাঁর আউটই। যখন নেমেছেন তখন দলের অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। ৩ উইকেটে ১৪১ রানে নেমেছেন। তবে নামার কিছুক্ষণ পরেই দল পথ হারিয়েছিল। একে একে অন্য প্রান্ত থেকে ছিটকে গেছেন যোগ্য সঙ্গীরা। শেষ উইকেটে স্মরণীয় এক জুটি গড়ে যখন ফিরছেন ততক্ষণে নামের পাশে ১৩৫ রান। ১১ চার ও ৮ ছক্কার ইনিংসটি গড়েছেন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায়।

ইনিংস গড়ার ধরন:

পেরেরা
ইনিংসের শুরু থেকেই তুলনামূলক আক্রমণাত্মক ছিলেন পেরেরা। দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে প্রতি আক্রমণকে পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ৭ চারে প্রথম ফিফটিটা এসেছে ৭৫ বলে। এর পর একটু সাবধানী হয়েছিলেন। মাঝে ২৪ ওভারে মাত্র দুটি চার ছিল তাঁর কিন্তু নবম উইকেট পড়ার পর আবার আক্রমণাত্মক হতে হয়েছে তাঁকে। এগারো নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ফার্নান্দো যখন নেমেছেন, তখন পেরেরার রান ৮৬। পরের ৬৮ বলে ৬৭ রান তুলেছেন। তিনটি চার মেরেছেন, ইনিংসের সবগুলো ছক্কাই (৫টি) ছিল এ সময়ে।

স্টোকস
প্রথম ইনিংসে তাঁর আউটের শট নিয়ে প্রশ্ন ছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে তাই জবাব দিতেই নেমেছিলেন। তৃতীয় দিনে শেষ করেছিলেন ২ রানে, ৫০ বল খেলে। কালও শুরুর প্রথম ১৬ বলে কোনো রান করেননি। ৬৭তম বলে নামের পাশে ৩ রান লেখা গেল। প্রথম চার মেরেছেন ৭৪তম বলে। ৮০ বল খেলার পরও তাঁর নামের পাশে ছিল ৭! পঞ্চাশ পাওয়ার আগেই বিদায় নিয়েছেন বেয়ারস্টো-বাটলার। ১৫২ বলে ফিফটি ছোঁয়ার একটু পরেই সঙ্গী ওকসকে হারিয়েছেন। এরপরও আগ্রাসী হননি খুব একটা। মাত্র এক চারে ২২ বলে ১১ রান যোগ করতেই দেখলেন শেষ সঙ্গী নেমেছেন মাঠে! গিয়ার চেঞ্জ করতে হলো, পরের ২৫ বলে নিলেন ৩৯ রান। শেষ জুটির ৭৬ রানের ৭৪ রানই তাঁর। এর ৫৮ রানই (৭ ছক্কা ও ৪ চার) এসেছে বাউন্ডারি থেকে। ইতিহাসে নাম লেখানো এ সময়টুকুতে ৪৫ বল খেলেছেন স্টোকস।

পেরেরার কীর্তি করে দেখালেন স্টোকসও। ফাইল ছবি
পেরেরার কীর্তি করে দেখালেন স্টোকসও। ফাইল ছবি

জুটি ও সঙ্গী:

পেরেরা
বিশ্ব ফার্নান্দো সেদিনের আগে টেস্টে যে সাতবার নেমেছেন তাতে সর্বোচ্চ ৪ রান করেছিলেন একবার। পাঁচবারই নামের পাশে ছিল শূন্য! এমন এক ব্যাটসম্যান নিয়েই ১৫ ওভার ৫ বলের জুটি গড়েছেন পেরেরা। টেল এন্ডারদের নিয়ে যেভাবে খেলতে হয় সেভাবেই খেলেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওভারের শেষ দুই বা এক বল খেলতে দিয়েছেন ফার্নান্দোকে। শুধু মহারাজের এক ওভারে চার বল খেলতে হয়েছিল ফার্নান্দোকে। শুধু রাবাদার বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে দুই বার শেষ দুই বলে পেরেরা স্ট্রাইক বদলাতে না পারায় পরের ওভারের শুরুতে খেলতে হয়েছে ফার্নান্দোকে। টানা দুই ওভারে ডেল স্টেইনের বল সামলে পেরেরাকে যোগ্য সঙ্গই দিয়েছেন পেরেরা। ৯৫ বলের জুটিতে এসেছিল সেই মহামূল্যবান ৭৮ রান।

স্টোকস
জ্যাক লিচ হয়তো এগারোতে নেমেছেন কিন্তু তাঁর টেস্টে ৯২ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ড আছে। তবু কোনো ঝুঁকি নেননি স্টোকস। নামার সময় প্যাটিনসনের চারটি বল বাকি ছিল বলে লিচকে টানা চার বল খেলতে হয়েছিল। এর পর আরও একবার প্যাটিনসনের টানা চার বল খেলতে হয়েছে তাঁকে। এ ছাড়া অধিকাংশ ওভারেই শেষ বলটাই শুধু খেলার দায়িত্ব পেয়েছেন লিচ। মাঝে মাঝে তো ষষ্ঠ বলেও এক রান নিয়েছেন স্টোকস। শুধু শেষ ওভারেই ওভারের প্রথমেই খেলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন লিচ। ওভারের তৃতীয় ও নিজের ১৭তম বলে প্রথম রান নিয়ে দুই দলের স্কোরের সমতা টেনে সে দায়িত্ব সেরেছেন লিচ। ৭৬ রানের এই স্মরণীয় জুটির মেয়াদ ছিল ৬২ বলের।

পাঠক, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আপনার কাঁধেই!