টেস্ট এখন চার দিনের!

টেস্ট ম্যাচ ড্র হওয়ার হার আগের চেয়ে কমেছে। টি-টোয়েন্টি মেজাজের বড় ভূমিকা রয়েছে এখানে। ছবি: এএফপি
টেস্ট ম্যাচ ড্র হওয়ার হার আগের চেয়ে কমেছে। টি-টোয়েন্টি মেজাজের বড় ভূমিকা রয়েছে এখানে। ছবি: এএফপি
>টেস্ট ক্রিকেটে ম্যাচ ড্র হওয়ার হার আগের চেয়ে কমেছে। এখন বেশির ভাগ ম্যাচেই ফল দেখা যায় এবং বেশির ভাগ ম্যাচই পঞ্চম দিনে গড়াচ্ছে না। ক্রিকইনফোর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এসব তথ্য

গত সপ্তাহে শুরু হওয়া তিন টেস্টই এক পথে হেঁটেছে। বাজে আবহাওয়ার মধ্যেও ফল দেখা গেছে প্রতিটি ম্যাচের। এর মধ্যে হেডিংলি (ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া) ও অ্যান্টিগা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ভারত) টেস্ট পাঁচ দিন পর্যন্ত গড়ায়নি। কলম্বো টেস্ট (শ্রীলঙ্কা-নিউজিল্যান্ড) পাঁচ দিন পর্যন্ত গড়ালেও অন্য দুটি ম্যাচের তুলনায় খেলা হয়েছে সবচেয়ে কম সময় (২৭৫.৪ ওভার)। সেটি অবশ্যই বাজে আবহাওয়ার জন্য। হেডিংলিতে ম্যাচের দৈর্ঘ্য ছিল ২৮০.২ ওভার আর অ্যান্টিগায় ৩১০.২ ওভার। অথচ এ দুটি ম্যাচ ফল দেখেছে চার দিনের মধ্যেই।

টেস্ট ক্রিকেটের ‘শরীর’ থেকে এক দিন কেটে চার দিন করা যায় কি না, তা নিয়ে বেশ আগে থেকেই যুক্তি-তর্ক চলছে। অনেকের যুক্তি, এতে টেস্ট ক্রিকেটের ‘শরীর’টা আরও আঁটসাঁট হয়। সর্বশেষ এই তিন ম্যাচের দৈর্ঘ্য কিন্তু যুক্তিটির পক্ষে। টেস্ট ক্রিকেট যেন আপনা থেকেই মেদ ঝরিয়ে ফেলছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে এর পক্ষে প্রমাণও আছে। ক্রিকইনফো এ নিয়ে এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, ২০১৮ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৬৭টি পাঁচ দিনের টেস্ট মাঠে গড়িয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি ম্যাচ শেষ হয়েছে চার দিনের মধ্যে কিংবা তারও কম সময়ে—যা মোট ম্যাচের প্রায় ৬০ শতাংশ (৫৯.৭০%)।

শুধু এ বছর যে ১৯টি পাঁচ দিনের টেস্ট মাঠে গড়িয়েছে তার মধ্যে ১৩টি টেস্ট শেষ হয়েছে চার দিনের মধ্যে। শতকরা হিসেবে যা মোট ম্যাচের ৬৮.৪২ শতাংশ। ন্যূনতম ১০ টেস্ট খেলা হয়েছে এমন পঞ্জিকাবর্ষ হিসেবে নিলে চার দিনের মধ্যে শেষ হওয়া ম্যাচের হার এবারই সর্বোচ্চ। পরিসংখ্যান বলছে, টানা দুই বছর একদিন কিংবা তার বেশি সময় বাকি রেখে এত বেশিসংখ্যক ম্যাচ শেষ হওয়ার অনুপাত টেস্ট ক্রিকেটে এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

চার দিনের মধ্যে শেষ হয়েছে এ হিসেব বিচারে টেস্ট ইতিহাসের শীর্ষ পাঁচে থাকবে সবশেষ তিন পঞ্জিকাবর্ষ। গত বছর এ হার ছিল ৫৬.২৫ শতাংশ (৪৮টি পাঁচ দিনের টেস্টে ২৭ ম্যাচ) আর ২০১৭ সালে ৪৭.৮৩ শতাংশ (৪৬টি পাঁচ দিনের টেস্টে ২২ ম্যাচ)। আর শেষ দুই পঞ্জিকাবর্ষে নির্ধারিত পাঁচ দিনের আগেই টেস্ট শেষ হওয়ার হার বেড়েছে শতকরা ২৫ শতাংশ। গত ১৯ বছর মানে ২০০০ সালের শুরু থেকে শতকরা ৪৩ শতাংশ ম্যাচ শেষ হয়েছে চার দিনের মধ্যে। আশি ও নব্বই দশকের মেজাজে টেস্ট ক্রিকেট এখন আর খেলা হয় না। ১৯৮০-১৯৯৯ এ দুই দশকে প্রতি ৩.৬ টেস্টের মধ্যে ১টি করে টেস্ট শেষ হয়েছে চার দিনের মধ্যে।

গত বছরের শুরু থেকে পাঁচ দিনে গড়ানো ম্যাচগুলোর এক-তৃতীয়াংশতেই বড় ভূমিকা রেখেছে বাজে আবহাওয়া। গত পাঁচ বছর হিসেব করলে টেস্টে গড়ে প্রতিদিন খেলা হয়েছে ৮৮ ওভার করে। অর্থাৎ এ সময় কোনো ম্যাচে ৩৫২ ওভার খেলা হলেই কেবল তা পঞ্চম দিনে গড়াবে বলে মনে করা হয়। এ বছর ১৯ টেস্টের মধ্যে মাত্র দুটি ম্যাচ সত্যিকার অর্থেই পঞ্চম দিনে যাওয়ার মতো ছিল। এজবাস্টনে অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্ট আর এ মাসে শ্রীলঙ্কা-নিউজিল্যান্ডের মধ্যে গল টেস্ট। আর বছরের এ পথ পর্যন্ত ড্র হয়েছে মাত্র দুই টেস্ট—ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সিডনি টেস্ট (৩-৭ জানুয়ারি) এবং লর্ডসে অ্যাশেজ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট। এর মধ্যে লর্ডস টেস্টে আর এক সেশন খেলা হলে সম্ভবত ফল পাওয়া যেত আর এ টেস্টে প্রথম দিনটা ভেসে গেছে বৃষ্টিতে।

২০১৮ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত খেলা ৬৭টি টেস্টের মধ্যে ৪৯ ম্যাচে খেলা ৩৫২ ওভারের বেশি গড়ায়নি। এ সময় পঞ্চম দিনে না গড়ানো ম্যাচের সংখ্যা শতকরা তিন-চতুর্থাংশ। আর ২০০০ সালের শুরু থেকে হিসেব কষলে সেই হার শতকরা ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। সবশেষ ১৯ বছর তুলনায় গত কয়েক বছরে চার দিনে শেষ হওয়া ম্যাচের সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ৪৬ শতাংশ। আর গত পাঁচ বছর তুলনা করলে তা বেড়েছে শতকরা ২৬ শতাংশ।

চার দিনের মধ্যে টেস্টের ফল হয়ে যাওয়ার এ প্রবণতা বিশ্বের প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া কিছুটা ব্যতিক্রম। আর এর পেছনে রয়েছে পাটা ‘ড্রপ-ইন’ উইকেটের ভূমিকা। ২০১৮ সাল থেকে সেখানে এ পর্যন্ত ৬ টেস্টের মধ্যে ২টি ম্যাচের খেলা পাঁচ দিনে গড়ানোর আগেই ফল দেখেছে। বাকি যে চারটি টেস্ট পঞ্চম দিনে পৌঁছেছে তার মধ্যে শুধু সিডনি টেস্টের (২০১৮ অ্যাশেজ) উইকেট ‘ড্রপ ইন’ ছিল না। ঠিক একই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ন্যূনতম অর্ধেকসংখ্যক ম্যাচই শেষ হয়েছে চার দিনের মধ্যে। আরব আমিরাতে অবশ্য চার দিনের মধ্যে শেষ হয়েছে দুই তৃতীয়াংশেরও কম ম্যাচ। বাংলাদেশের মাটিতে টেস্টে ৬ ম্যাচের মধ্যে ৫টিতেই ফল দেখা গেছে আর ৪টি ম্যাচ গড়ায়নি পঞ্চম দিনে।

২০১৮ আর এ বছরে ম্যাচের ফল হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এ বছর ২০ ম্যাচের মধ্যে ১৮টি আর গত বছর মিলিয়ে মোট ৬৮ ম্যাচের মধ্যে ৬১ ম্যাচে হার-জিত দেখা গেছে। ন্যূনতম ১০ ম্যাচ খেলা হয়েছে এমন পঞ্জিকাবর্ষ হিসেবে টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ম্যাচে ফল দেখা যাওয়ার হারে শীর্ষে রয়েছে এ দুটি বছর। এদিকে টেস্ট ক্রিকেটকে আরও অর্থবহ করতে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করেছে আইসিসি। সে অনুযায়ী প্রতিটি দল ছয়টি করে সিরিজ খেলবে। টেস্ট ম্যাচের দৈর্ঘ্য ছেঁটে চার দিনে নামিয়ে আনলে তুলনামূলক অল্প সময়ের মধ্যে এসব সিরিজ খেলতে পারবে দলগুলো। আর সময়ের দাবি মেনে খেলাটির ‘শরীর’ থেকেও ঝরে পড়বে অতিরিক্ত মেদ, দেখতে হবে আরও আঁট সাট, আকর্ষণীয়!