আবর্জনা পরিষ্কার করে অ্যাশেজে

অস্ট্রেলিয়া দলের বাসে কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের সঙ্গে ম্যাক্স ওয়েট ও তার ভাই। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়া দলের বাসে কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের সঙ্গে ম্যাক্স ওয়েট ও তার ভাই। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
>অস্ট্রেলিয়ার ১২ বছর বয়সী কিশোর ম্যাক্স ওয়েট চার বছর ধরে টাকা জমিয়ে মা–বাবার সঙ্গে অ্যাশেজ দেখতে এসেছে ইংল্যান্ডে। তার গল্পটা অবিশ্বাস্য।

সুকান্ত লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ...বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’ ম্যাক্স ওয়েটের বয়স আঠারো হতে এখনো ছয় বছর বাকি। কিন্তু এ বয়সেই সেই দূরদেশ অস্ট্রেলিয়া থেকেই ওয়েট বুঝিয়ে দিয়েছে, কবি মিথ্যা লেখেননি। কিশোর বয়সটা যে নতুন কিছু করার, বাধার কাছে মাথা নোয়ানোর নয়—ম্যাক্স ওয়েটের ইচ্ছাশক্তি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই অ্যাশেজে।

সত্যি বলতে, ক্রিকেটের প্রতি, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া দলের প্রতি ভালোবাসা থেকে কী করা যায়, ১২ বছর বয়সী ম্যাক্স ওয়েট তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। নিজ আঙিনায় ২০১৫ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয় দেখে ওয়েট ঘোষণা করেছিল, ২০১৯ অ্যাশেজ সে ইংল্যান্ডের মাটিতে বসে দেখবে। নিজের নায়কদের লড়াই প্রতিপক্ষ দেশের গ্যালারিতে বসে দেখতেই হবে তাকে। কিন্তু একরত্তি ছেলের এ দাবি মা–বাবা সহজে মানবেন কেন? চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন তাঁরা।

অস্ট্রেলিয়ান পেসার জেমস প্যাটিনসনের সঙ্গে ম্যাক্স ওয়েট। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ান পেসার জেমস প্যাটিনসনের সঙ্গে ম্যাক্স ওয়েট। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া

‘পারলে এ চার বছরে ১ হাজার ৫০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার কামাই করে দেখাও। তাহলে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাব’—ওয়েটকে এ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন তার বাবা ড্যামিয়েন। ছেলেকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন তার মা। বুদ্ধি দিলেন, ‘প্রতিবেশীদের বাড়ির সামনে আবর্জনার যে পাত্র থাকে, প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কার করে দাও আর তার বিনিময়ে প্রতিটি বাসা থেকে ১ ডলার করে নাও।’ মায়ের বুদ্ধি পছন্দ হলো ছেলের। দেরি না করে সে তাই চিঠি লিখল ভিক্টোরিয়া অঞ্চলের পয়েন্ট লোনসডালের প্রতিবেশীদের। আবর্জনা পরিষ্কারের বিষয়টি জানাল চিঠিতে। ১০ জন গ্রাহক সে পেয়ে গেল তাৎক্ষণিকভাবে। ব্যস, শুরু হলো ‘অপারেশন অ্যাশেজ ২০১৯’।

চার বছর ধরে ম্যাক্স ওয়েট ঠিক এ কাজই করেছে। প্রতি রোববার ছুটির দিন সন্ধ্যায় সে আবর্জনার পাত্রগুলো নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে পরদিন ফিরিয়ে দিত। অসুস্থ কিংবা জরুরি কাজ না থাকলে এ কাজ করতে তার কখনো ভুল হয়নি। যেদিন থাকতে পারত না, সেদিন তার হয়ে কাজটা করে দিতেন মা–বাবা অথবা ভাইয়েরা। প্রতিবেশীরা আবর্জনার পাত্রে টেপ দিয়ে ১ ডলার পেঁচিয়ে দিতেন। কেউ কেউ আবার গোটা বছরের জন্য দিয়েছেন ৫০ ডলার। এভাবে ধীরে ধীরে ম্যাক্স ওয়েটের লক্ষ্যপূরণ হয়ে গেল। খোলাসা করে বললে, ১ হাজার ৫০০ ডলারের বেশি জমিয়ে ফেলেছিল এ কিশোর।

ওল্ড ট্রাফোর্ডে বাবা-মায়ের সঙ্গে ম্যাক্স ওয়েট। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
ওল্ড ট্রাফোর্ডে বাবা-মায়ের সঙ্গে ম্যাক্স ওয়েট। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া

এবার তার বাবার কথা রাখার পালা। ড্যামিয়েন ওয়েট তা রাখলেনও। ওল্ড ট্রাফোর্ডে চলতি টেস্টের আগে গোটা পরিবার পা রাখল ম্যানচেস্টারে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাক্স ওয়েটের বাবা ড্যামিয়েন বলেন, ‘বলেছিলাম সে টাকা জমাতে পারলে ইচ্ছাটা পূরণ করব। এটা আসলে দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। এখানে আসতে পেরে ভালোই লাগছে।’ অস্ট্রেলিয়া দলের প্রতি এ কিশোরের ভালোবাসার প্রাপ্য দামটাই দিয়েছেন জাস্টিন ল্যাঙ্গারের শিষ্যরা। অস্ট্রেলিয়া দলের বাসে করে ওল্ড ট্রাফোর্ড ঘুরেছে ম্যাক্স এবং তার দুই ভাই। তার ভাষায়, ‘স্টিভ ওয়াহ, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, নাথান লায়নদের পাশে বসে ঘুরেছি। জাস্টিন আমাকে খেলা নিয়ে পরিকল্পনার বইটা দেখিয়েছে। এটা ছিল দুর্দান্ত আর স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে কথা বলাও ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা।’

অস্ট্রেলিয়া দলে ম্যাক্সের সবচেয়ে পছন্দের খেলোয়াড় হলেন স্টিভ স্মিথ ও প্যাট কামিন্স। তাঁদের সঙ্গেও সময় কেটেছে ম্যাক্স ওয়েটের। জেনেছে খেলার আগে তাঁদের প্রস্তুতি সম্বন্ধে। ম্যাক্স ওয়েটের মা তাঁর ছেলেকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত। ‘পরিশ্রম করে কোনো লক্ষ্যপূরণ করা সত্যিই অসাধারণ ব্যাপার। চার বছর ধরে সে ভীষণ নিবেদিত ছিল নিজের লক্ষ্যের প্রতি। প্রতিবেশীরা জানতে চাইত, “ছেলেরা কি বাগানে পানি দিতে পারবে? মাসে ২০ ডলার করে দেব।” আসলে ম্যাক্সের এ কাজ সমাজে আমাদের সবাইকে এক করেছে।’

ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে দ্বিতীয় দিনে লাঞ্চ বিরতির সময় অস্ট্রেলিয়ার পেসার জেমস প্যাটিনসন একটি জার্সি উপহার দিয়েছেন ম্যাক্স ওয়েটকে। সে জার্সিতে সই করেছেন অস্ট্রেলিয়া দলের সব খেলোয়াড়। প্যাটিনসনের আশা, ম্যাক্সের এ অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে একদিন অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে তুলে আনতে পারে। বলা বাহুল্য, এটাই ম্যাক্স ওয়েটের পরবর্তী লক্ষ্য, ‘আশা করি পারব। আমি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসি।’

এ ছেলে কোনো কিছু নিশানা করলে কেমন লক্ষ্যভেদ করতে পারে, সে প্রমাণ তো দেখাই গেল। বাকিটা সময়ের হাতে।