কাদির যেভাবে 'পুবের জাদুকর' হয়ে উঠলেন

ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে আবদুল কাদির। পাশে ইমরান খান। ছবি: পাকপ্যাশন.নেট
ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে আবদুল কাদির। পাশে ইমরান খান। ছবি: পাকপ্যাশন.নেট
>

ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার আবদুল কাদির কাল পাড়ি জমিয়েছেন না–ফেরার দেশে। ক্রিকেট মহলে কাদিরের জাদুকরি স্পিন নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত। তবে একটি ঘটনা আছে তাঁর দাড়ি রাখা নিয়ে। সেবার ওই দাড়ির জন্য তকমা পেয়েছিলেন ‘উইজার্ড অব ইস্ট’। নাকানি-চুবানি খাইয়েছিলেন ইংলিশদের

আবদুল কাদির সমন্ধে কথাটা বলেছিলেন ইমরান খান। তখনকার দিনে রিভিউ নেওয়ার নিয়ম থাকলে কাদিরের পরিসংখ্যান আরও সমৃদ্ধ হতো। কারণ, তখন স্পিনারদের বিপক্ষে ব্যাটসম্যানেরা নির্ভয়ে সামনে পা বাড়িয়ে খেলতে পারতেন প্যাডে! কাদির ‘জাদুকর’ ছিলেন বলেই আশির দশকে পেসারদের রাজত্বে আলাদা করে নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। আর জাতীয় দলে কাদিরকে তুলে এনে সে পথটুকু করে দেওয়ার পেছনে অধিনায়ক ইমরানের ভূমিকা ছিল অসামান্য। পাকিস্তানের এ দুই কিংবদন্তি ক্রিকেটারের একটি ঘটনা এখনো ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে—কাদিরের দাড়ি ও ইংল্যান্ড!

পাকিস্তানের হয়ে ৬৭ টেস্ট ও ১০৪ ওয়ানডে খেলেছেন কাদির। কাল তিনি না–ফেরার দেশে পাড়ি জমানোয় ১৯৮২ সালের সে গল্পটা আবারও উঠে এসেছে আশির দশকের ক্রিকেটপ্রেমীদের আলোচনায়। সে বছর পাকিস্তানের নেতৃত্বভার পান ইমরান। তাঁর প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ইংল্যান্ড সফর। সে জন্য স্কোয়াডে জায়গা পাওয়া ১৬ ক্রিকেটার নিয়ে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে অনুশীলন শুরু করেন ইমরান। একদিন খেয়াল করলেন, সাধারণ জামা-কাপড় পরা খুব সাধারণ এক ক্রিকেটার দাড়িয়ে আছেন নেটের পাশে। ব্যাটসম্যানদের নেট অনুশীলন দেখছিলেন। সাদা চোখে সেই সাধারণ ক্রিকেটারটি আর কেউ নন, আবদুল কাদির।

ইমরান যে কাদিরকে সেবারই প্রথম দেখেছিলেন তা নয়; কিন্তু ১৯৭৭ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত কাদির পরের চার-পাঁচ বছরে প্রায় বিস্মৃত হতে বসেছিলেন। ইমরান তাঁর বই ‘অ্যান অল রাউন্ড ভিউ’-তে লিখেছেন, তিনি নিজেই কাদিরকে প্রথমে চিনতে পারেননি! সেদিন নেটে কাদির বল করার পর বুঝতে পারেন। ইমরান কুশলাদি জানতে চাইলে কাদির ‘কিছু না, এমনি এসেছি’ এমন কিছু বোঝানোর মতো করে জবাব দেন। তখন পাকিস্তানের ঘরোয়া দলে সুযোগ পেতেই ঘাম ঝরছিল কাদিরের।

কিন্তু নেটে কাদিরের বোলিং দেখে মুগ্ধ হন ইমরান। পাকিস্তান দলে তখন পেসারদের জয়জয়কার। ইমরান খান, সরফরাজ নওয়াজ, সিকান্দার বখত ও তাহির নকশ ছাড়াও স্পিন বিভাগে ছিলেন ইকবাল কাশিম ও তাউসিফ আহমেদ। ইমরান তারপরও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। ইংল্যান্ডের পেসবান্ধব উইকেটে কাদিরের বৈচিত্র্য কাজে লাগবেই—এমন দৃঢ় বিশ্বাস পেয়ে বসেছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে সেরা এ অধিনায়ককে। ইমরান গিয়ে নির্বাচকদের গিয়ে ধরলেন।

কিন্তু নির্বাচকেরা কাদিরকে ‘বাতিল মাল’ বলে প্রত্যাখ্যান করলেন অধিনায়কের দাবি। ওদিকে ইমরানও একেবারেই নাছোড়। কাদিরকে নিতে সফরে না যাওয়ার হুমকি দিয়ে বসলেন। জুয়ায় কাজ হলো। কাদিরকে ফেরানো হলো পাকিস্তান দলে। ইমরান তাঁর সেই বইতে জানিয়েছেন, কাদিরকে পেয়ে তাঁকে প্রস্তুত করতে চাইলেন তিনি। সবার আগে অবশ্যই মানসিকভাবে। আর ইংল্যান্ডের সামনে তাঁকে ‘রহস্যময়’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন ইমরান। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকেও কাদিরকে দিয়ে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। আর তাই বুদ্ধিটা এল মাথায়।

কাদিরকে পরামর্শ দিলেন ইমরান, দাড়িটা নিয়ে একটু কারুকাজ করো। ‘গোটি’ দাড়ি রাখতে বললেন তিনি। অনেকটাই ‘ফ্রেঞ্চকাট’ দাড়ি। ইমরান ভেবেছিলেন, ব্রিটিশদের কাছে কাদির এমনিতেই অচেনা। এ অবস্থায় ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি তাঁকে ভীতিকর করে তোলার পাশাপাশি জাদুকর-জাদুকর ভাবও এনে দেবে। ব্রিটিশরা এতে প্রভাবিত হবেই। ইমরানের কথামতো ঠিক সেভাবেই দাড়ি রেখে সেবার ইংল্যান্ড সফরে কাদির তকমা পেয়ে গেলেন ‘উইজার্ড অব ইস্ট’—পুবের জাদুকর।

সে সফরে ১৫টি ট্যুর ম্যাচ, দুটি ওয়ানডে আর তিনটি টেস্ট খেলেছিল পাকিস্তান। কাদির ট্যুর ম্যাচ আর টেস্ট খেলেছিলেন। সব মিলিয়ে ১২ ম্যাচে ৫৭ উইকেট নিয়েছিলেন কাদির। এর মধ্যে ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন চারবার, ইনিংসে ১০ উইকেট একবার। সেবারের ইংল্যান্ড সফর দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের জায়গা পোক্ত করার প্রথম ভিত গড়েছিলেন কাদির। আর এ ভিত গড়ায় ইমরান এবং তাঁর পরামর্শমতো রাখা দাড়ির ভূমিকা ছিল অসামান্য।