'ক্যাসিনো পাড়া' থেকেই এল মন ভালো করা খবর

মোহামেডান ক্লাবে শিমুল। সংগৃহীত ছবি
মোহামেডান ক্লাবে শিমুল। সংগৃহীত ছবি

ক্যাসিনো, মদ, জুয়া...

ক্লাবপাড়া মানেই গত কিছুদিন শুধু নেতিবাচক খবর। খেলা মানে উচ্ছ্বাস, প্রাণের সঞ্চার—তা পেছনে ফেলে খবরের শিরোনাম অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দখলে। ক্লাবপাড়া থেকে সাগর সেচে মুক্তো পাওয়ার মতো খুঁজে পাওয়া গেল মন ভালো হওয়ার মতো একটি খবর। অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় ফুটবল দলে জায়গা করে নিয়েছেন মোহামেডান স্পোর্টিং লিমিটেডের বল বয় শিমুল।

মোশাররফ হোসেন শিমুল ২০১২ সাল থেকে মোহামেডান ফুটবল দলের বল বয়। খেলোয়াড়দের জার্সি-প্যান্ট ধোয়া, মাঠের অনুশীলন সরঞ্জাম বহন করাসহ খেলোয়াড়দের বিভিন্ন ফরমাশ খাটাই তাঁর কাজ। নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেছেন সে দায়িত্ব। সঙ্গে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে ধীরে ধীরে তৈরি করেছেন নিজেকে। মোহামেডানের বল বয়ের সে রঙিন স্বপ্নটাই কল্পনার সব রং ছড়িয়ে ডানা মেলেছে আকাশে। ভুল হলো, এখন আর বল বয় নন, জাতীয় যুব দলের ফুটবলার শিমুল। অনেক ত্যাগ, পরিশ্রম ও সাধনার বিনিময়েই অর্জন করে নিয়েছেন এই পরিচয়।

সদ্য সমাপ্ত অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ দলে নাম ছিল শিমুলের। কিছুটা দুর্ভাগ্যের শিকারই বলতে হবে, ২৩ সদস্যের চূড়ান্ত দলে জায়গা না পেয়ে ২৪তম সদস্য হয়ে ছিলেন একমাত্র স্ট্যান্ডবাই হিসেবে। তবে মূল দলে ঢোকার সুযোগটা এখনো খোলা। সাফ শেষে যুব দলটি এখন প্রস্তুতি শুরু করবে বাহরাইনে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের জন্য। ছুটি কাটিয়ে আবার ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার পালা তাঁর।

ছোটবেলা থেকেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, পারিবারিক অভাব-অনটনের জন্য থেমে যাওয়ার শঙ্কা। হয়তো থামতে হতো শিমুলকেও! সেই বাধা দূর হয়েছিল এলাকার বড় ভাই ফুটবলার বাবলু মিয়ার (বর্তমানে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের খেলোয়াড়) সৌজন্যে। এলাকার ছোট ভাই হিসেবে শিমুলের প্রতিভা ও স্বপ্নের কথা জানা ছিল বাবলুর। ২০১২ সালে তাঁর হাত ধরেই কুমিল্লা থেকে এসে মোহামেডান ক্লাবে ওঠা। কিন্তু খেলোয়াড় নয়, ভাগ্যের পাকে পড়ে স্বপ্নপূরণের আশায় বল বয় হিসেবে।

বাড্ডার বেরাইদে বাফুফের ফর্টিজ একাডেমিতে কোচ টার্নারের সঙ্গে মোশাররফ হোসেন শিমুল। ছবি: রাশেদুল ইসলাম
বাড্ডার বেরাইদে বাফুফের ফর্টিজ একাডেমিতে কোচ টার্নারের সঙ্গে মোশাররফ হোসেন শিমুল। ছবি: রাশেদুল ইসলাম

শিমুলকে বলা হয়েছিল, ‘ঢাকায় এসে প্র্যাকটিস করতে চাস। কিন্তু সে সুযোগ তো নেই। মোহামেডান একজন বল বয় খুঁজছে। তুই চাইলে আসতে পারিস। কাজকর্ম শেষ করে সুযোগ পেলে প্র্যাকটিস করবি।’ এ প্রস্তাবে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা শিমুলের। ২০১২ সালে কুমিল্লা থেকে এসে মোহামেডানের স্টাফ রুমে ওঠা। শুরু হলো রঙিন স্বপ্নযাত্রা।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুরু হয় কাজ। অনুশীলনের আগে সরঞ্জামাদি প্রস্তুত করা, অনুশীলন শেষে খেলোয়াড়দের জার্সি-প্যান্ট ধোয়াসহ বিভিন্ন ফুট ফরমাশ খাটা। এর মধ্যে যখনই সুযোগ পেয়েছেন, নেমে পড়েছেন বল নিয়ে। এ ছাড়া দলের অনুশীলনের সময়ে খেলোয়াড়ের ঘাটতি পড়লেই ডাক পড়ে শিমুলের। এভাবেই ছয় বছর ধরে বল বয় পরিচয়ের আড়ালে বেড়ে উঠেছে একটি স্বপ্ন, একটি আশা, একটি ভালোবাসা।

সেই স্বপ্নের পালে বাতাস দিয়েছেন মোহামেডানের অস্ট্রেলিয়ান কোচ সন লেন। শিমুলের প্রতিভা ও পরিশ্রম চোখ এড়ায়নি এই অস্ট্রেলিয়ানের। চলতি বছর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ট্রায়ালের সময় শিমুলকে ডেকে বললেন, বুট ও জার্সি-প্যান্ট নিয়ে তৈরি থেকো। পরের দিন মোহামেডানের তরুণ স্ট্রাইকার আমির হাকিম বাপ্পী ও শিমুলকে সঙ্গে নিয়ে বাড্ডার বেরাইদে ফর্টিজ গ্রাউন্ডে হাজির হন লেন। ট্রায়ালে বাপ্পীর সঙ্গে শিমুলও যুব দলের ব্রিটিশ কোচ অ্যান্ড্রু পিটার টার্নারের মন জয় করে জায়গা করে নেন যুব দলে।

ব্রিটিশ কোচ টার্নার শিমুলকে দিয়েছেন বড় এক সার্টিফিকেট, ‘ট্রায়ালে তাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েই দলে নিয়েছি। সে আমার কাছে অন্য খেলোয়াড়দের মতোই একজন। দলের অন্য খেলোয়াড়দের চেয়ে কেবল ওর একটু অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। তবে ছেলেটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’

শিমুলের কানেও বাজছে কোচের প্রশংসাবৃষ্টি। ইতিমধ্যে ক্লাব খুঁজতে শুরু করে দিয়েছেন। যদি সুযোগ হয়, ফিরতে চান মোহামেডানেই। এবার আর বল বয় নয়, খেলোয়াড়ের তকমা নিয়ে, ‘মোহামেডান ক্লাব ও খেলোয়াড়দের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ক্যাম্প শেষ করে ক্লাবে ফিরে যাওয়ার আশা আছে। যদি ক্লাব আমাকে খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ দেয়। এ ছাড়া চেষ্টা করছি চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের কোনো দলে খেলার। আশা করি দল পাব।’

বর্তমান যুব দলে ২৪ সদস্যের দলে শিমুল ছাড়া বাকি ২৩ জনই প্রিমিয়ার লিগে বিভিন্ন ক্লাবের নিবন্ধনকৃত ফুটবলার। কারও নামের সঙ্গে সাইফ স্পোর্টিং, কারও আবাহনী লিমিটেড—শুধু শিমুলের গায়েই অদৃশ্য অক্ষরে লেখা ‘মোহামেডানের বল বয়।’ এই পরিচয়ের বলয়টা ভেঙে নতুন পরিচয়ের পেছনে ছুটছেন এক তরুণ।