আজ রাত আটটায় কোনো কাজ আছে?

ভারতের বিপক্ষে লড়তে সবার সহযোগিতাই দরকার হবে জামালদের। ছবি: এএফপি
ভারতের বিপক্ষে লড়তে সবার সহযোগিতাই দরকার হবে জামালদের। ছবি: এএফপি
>আজ রাত আটটায় কলকাতায় মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ ও ভারত। বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে এই ম্যাচ সরাসরি উপভোগ করা যাবে বাংলা টিভি ও স্টার স্পোর্টস ১ এবং ২-এ

আজ রাত আটটায় কোনো কাজ আছে?

জরুরি কাজ থাকলে বাকিটা পড়ার দরকার নেই। কিন্তু রোজনামচার জীবন হলে দুটো কথা আছে। জীবনে কখনো ফুটবলে লাথি মেরেছেন? যাহ, প্রশ্নটাই কেমন বোকা বোকা। বাঙালি ফুটবলে লাথি মারেনি, এ হয় নাকি!

শেষ প্রশ্ন, টিভিতে ইউরোপিয়ান লিগ তো দেখা হয়? পছন্দের খেলোয়াড় বল পায়ে টান দিলে, কিংবা ডজ দিলে কেমন লাগে? কিংবা তার উল্টোটা। অদ্ভুত সেই অনুভূতি কি এখনো জাগে? ছোটবেলার খেলায় দু-চারজনকে কাটালে কিংবা গোল খেয়ে যেমন লাগত আরকি।

প্রশ্নটা তাই লজ্জার মাথা খেয়েই করছি, বাংলাদেশের ফুটবল খেলা দেখা হয়? লাজের কারণ, পরম্পরা ধরে রাখতে না পারলে সিনা টান করে কিছু বলা যায় না। দেশের ফুটবল তো অনেকটাই ‘তিন পুরুষ’ গানটির মতো—‘এক পুরুষে গড়ে ধন/ এক পুরুষে খায়/ আর এক পুরুষ এসে দেখে খাওয়ার কিছু নাই।’ খাওয়া নয়, খাওয়ানো হলে বেশি মানানসই হতো, আর তা দর্শকদের।

আর তাই ধুর, ওদের খেলা দেখার কি আছে? সাফের বাইরে তো কিছু হলো না। ফিফা র‍্যাঙ্কিংটা একবার দেখো! কী দরকার এসব বোর্ড-ফোর্ড রাখার, টাকা ঢালার? সত্যিই এসব কথার জবাব নেই। কর্মের ফল ভোগ করতেই হয়। ঠিক আছে।

কিন্তু দিনকে দিন একটা পার্থক্য যে বেরিয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে দেশের ফুটবলে এখন নানা রকম সমর্থক গোষ্ঠী। আগের মতো পাগলাটে, উন্মাদ আর জমজমাট না হলেও একবারে খারাপও না। নামকাওয়াস্তে তো নয়ই।

বাইরে জাতীয় দলের খেলা থাকলে বেশ ভালোই যাচ্ছে সবাই। টিভির সামনে তো থাকছেই। এদের বেশির ভাগই তরুণ। বেশির ভাগই হয়তো এনায়েত, আসলাম, মুন্না, রুমীদের গল্প শোনেনি। কিন্তু ব্যর্থতার ধারাবাহিক গল্পটা মুখে মুখে সবাই জানে। তবু সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সংগত কারণে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াদের সঙ্গে স্রেফ আবেগের বশে মুখ চেয়ে থাকাদের মধ্যে এটুকুই যা পার্থক্য। আর বলতে বাধা নেই, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুখ ফিরিয়ে রাখাদের মধ্যে বয়সীরা যৌবনে এই তরুণদের মতোই ছিলেন।

তাঁদের বাস্তবসম্মত আশা ছিল। এই তরুণদের কতটুকু আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। সাম্প্রতিককালে জামাল ভূঁইয়াদের খেলা দেখে থাকলে প্রশ্নের ধারটুকু অন্তত কমার কথা। সবশেষ কাতার ম্যাচের কথাই ধরুন। স্কোরলাইন বলছে, বাংলাদেশ ২-০ গোলে হেরেছে। কিন্তু লড়াইটুকু দেখলে আশা জাগবেই।

পছন্দের ভিনদেশি দলের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন ঘটে। দেশের আর্জেন্টিনা কিংবা আর্সেনাল সমর্থকদের কথাই ধরুন। ’৮৬ বিশ্বকাপ দেখা এই দেশের মুরব্বি ফুটবলপ্রেমীরা মনের তাগিদেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার গল্প বলেন কিংবা বলে গেছেন তাদের উত্তরসূরিদের কাছে। সমর্থনের শিকড়ে যেহেতু পরিবারের বিশেষ ভূমিকা থাকে, তাই এভাবে গড়ে ওঠে একজন আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিল-ভক্ত। কিন্তু আমরা কজন ‘বাংলার ম্যারাডোনা’র গল্প শুনিয়েছি ছোটদের? কজন আসলামের হেড, রুমির ড্রিবলিং, স্কুটার গফুরের উইং ধরে ছোটা আর মুন্নার রক্ষণের গল্প শুনিয়েছি ছোটদের?

এখন জামাল ভূঁইয়াদের সমর্থন করা বেশির ভাগ তরুণকে তাই ‘ওপরওয়ালার আর্শীবাদ’ বলাই ভালো। ওদের মন কিন্তু আজ রাত আটটায় যুবভারতীতে পড়ে থাকবে। কিছু সৌভাগ্যবান মাঠে বসেই দেখবেন, বাকিদের চোখ থাকবে টিভি পর্দায়। তখন বড়রা হয়তো কাজকর্ম থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছেন, জিবের তলে তেতো স্বাদ। সব হিসেব-নিকেশ করে বুঝে উঠতে পারছেন না, সন্তানের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাবেন কীভাবে?

কথায় আছে, আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও। অর্থাৎ যা নিজে মানো না তা অপরকে শেখাবে না। কিন্তু ওরা শিখছে। সভ্যতার নির্মলতম বিনোদন খেলাধুলা, তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও জীবনের-রুপক ফুটবলকে পুঁজি করে ওরা নিজেদের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার চেষ্টা করছে। সেখানে হয়তো জয় আসে কালেভদ্রে কিন্তু ভালোবাসাটুকু আছে। আর তাই আশা থাকে। দর্শক না থাকলে খেলার যে কোনো অর্থ নেই।

একসময় দর্শক জায়গা পেত না। পারিবারিক আড্ডা থেকে চা স্টলে সাব্বির-মুন্নাদের গল্প হতো। এখন মেসি-রোনালদোদের। এই দৃশ্য পাল্টাতে যাঁদের ভূমিকা রাখা বেশি জরুরি, খামতি তাদের আছে, গাফিলতিও। কিন্তু ফুটবলের সুদিনে যাঁদের কোনো দায় ছিল না, যা খুশি বলতে পারত এবং খেলার ‘প্রাণ’ তকমা নিয়ে গ্যালারি বসত, সেই প্রজন্মের ভূমিকা রাখার সময় কি ফুরিয়েছে?

সবার আগে ঘরে পরম্পরার প্রদীপ কি জ্বলেছে? না জ্বললে আজ রাত আটটায় সবাইকে নিয়ে টিভিটা অন করে যুবভারতীতে চোখ রাখুন। এক সুজলা-সুফলা ভূমি কীভাবে ঊষর হয়ে উঠল, আর এখন তার কী উপায়, সেসব কথা বলতে বলতে দেখবেন আপনিও হুট করে বলে ফেলবেন, ‘গোওওল! যাহ, হলো না!’

একদিন হবে। হবেই।