এই ড্র তো ভারতীয় ফুটবলের আভিজাত্যে আঘাতও

সাদের গোল করার এ দৃশ্যটা আনন্দের সঙ্গে কষ্টও দেবে বাংলাদেশের সমর্থকদের। জয়টা যে মেলেনি! ছবি: এএফপি
সাদের গোল করার এ দৃশ্যটা আনন্দের সঙ্গে কষ্টও দেবে বাংলাদেশের সমর্থকদের। জয়টা যে মেলেনি! ছবি: এএফপি

পুরো যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন যেন কাঁদছে! প্রেস বক্সে বসে খুব সহজেই পড়ে নেওয়া গেল, গ্যালারির ভারতীয় সমর্থকদের মনে ঝরছে বেদনার বৃষ্টি। রংধনুর রং মেখে স্বাগতিকদের উৎসবের প্রস্তুতি ছিল পুরো মাত্রায়। বাংলাদেশকে হারিয়ে দেওয়া যেন সময়ের ব্যাপার! ড্রতে কি আর তাঁদের মন ভরে? কলকাতার ফুটবল-তীর্থ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের সঙ্গে ড্র করে শোকে স্তব্ধ ভারতের সমর্থকেরা। শেষ মুহূর্তে এসে হার এড়ানো গেছে, তাঁদের স্বস্তি বলতে এই যা!

র‌্যাঙ্কিংয়ে ভারতের চেয়ে ৮৩ ধাপ পিছিয়ে থেকে শুরু করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু গাণিতিক এ সংখ্যাকে যুবভারতীর নন্দনকাননে গড়াগড়ি খাইয়েছেন জামাল ভূঁইয়ারা। বলের নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিগত দক্ষতা—কোনো কিছুতেই জামালদের চোখে চোখ রেখে খেলতে পারেননি সুনীল ছেত্রীরা। অথচ সত্যি করে বলুন তো, কলকাতার মাঠে বাংলাদেশের পক্ষে বাজি ধরার লোক কি কেউ ছিল! কলকাতায় দিন কাটিয়েও কারও মুখ থেকেও তো শোনা যায়নি বাংলাদেশ ড্রয়ের কোনো আশাবাদ। গতকাল ম্যাচ –পূর্ববর্তী আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনেও আলোচনায়, সুনীল বাংলাদেশের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করতে পারবেন কি না! অথচ ম্যাচ শেষে দেখা যাচ্ছে, জিততে জিততে ড্র করা দলটির নাম বাংলাদেশ।

আর এতেই ভারতীয় ফুটবলের নব্য আভিজাত্যের ওপর বেশ শক্ত আঘাত হানতে পেরেছেন জামাল ভূঁইয়ারা। এখন ঢাকায় ঘরের মাঠে প্রতিবেশীদের হারাতে পারলে মোটামুটি ষোলোকলা পূর্ণ হয়। সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ভারত আর এখন তাদের মূল দল পাঠায় না। নিজেরা টুর্নামেন্ট আয়োজন করলে নিমন্ত্রণ পায় না বাংলাদেশ। অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের নব্য ফুটবল আভিজাত্য পৌঁছে গিয়েছিল অহমিকায়। সে অহমিকায় আঘাত হানতে আজকের ড্রটাই যথেষ্ট।

প্রথমার্ধের ৪২ মিনিটে সাদ উদ্দিনের হেডটা যখন ভারতীয় গোল পোস্টে জড়াল, থেমে গেল প্রায় ৫৫ হাজার দর্শকের ‘লেটস গো ইন্ডিয়া’ গর্জন। শুধু গোলটাই দেখলেন, রক্ষণের অন্যতম সেনানী ডিফেন্ডার ইয়াসিনের দিকে তাকান, মাথায় দুটি ব্যান্ডেজ নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেলেন শেষ বাঁশি পর্যন্ত। ওটাই বাংলাদেশের ফুটবলের এখন প্রতীকী রূপ। লড়াই, লড়াই ও লড়াই। ব্রিটিশ কোচ জেমি ডের এক দল তরুণ তা প্রতিনিয়তই করে যাচ্ছে। এ দেশের ফুটবল পতাকাটাকে জাগিয়ে তোলার মিশনে নেমেছে তারা। শেষ মুহূর্তে আদিলের গোলে ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ায় সেই সাহসিকতার মিশনে মোটেও চিড় ধরেছে বলে মনে হয় না।

৩৪ বছর পর কলকাতায় মুখোমুখি হয়েছিল প্রতিবেশী দুটি দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটে দুই দেশ মুখোমুখি হলে উত্তেজনার পারদ যেমন আকাশ ছুঁয়ে যায়। ফুটবলে তেমনটা না হলেও উত্তেজনা ছড়িয়েছিল দুই প্রান্তেই। একটি ফুটবল ম্যাচকে ঘিরে একটি রাজ্য কীভাবে জেগে উঠতে পারে তা কলকাতায় পা না রাখলে বোঝা যেত না। স্টেডিয়ামের রাস্তায় মানুষের ওই ঢল দেখলে মনে হবে, এই জনসমুদ্রের সামনেই বোধ হয় হ্যামিলিনের সেই বাঁশিওয়ালা! কিন্তু এখানকার সেই ‘বাঁশিওয়ালা’ না হ্যামিলিনের, না কোনো অস্থি চর্মের মানুষ—এই বাঁশিওয়ালা ফুটবল।

‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া...জিতে গা...গা...’ কলকাতার যুবভারতীতে পা রাখার সঙ্গেই স্লোগানটা কানে বাজছিল। তবে একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে পাওয়া যায় লাল জার্সি পরা বাংলাদেশি দর্শকদেরও। স্বাগতিক দর্শকদের ভিড়ে লাল-সবুজের পতাকা উঁচিয়ে ধরতে স্টেডিয়ামে ছিল বাংলাদেশ থেকে আসা কয়েকটি বহর। শেষ পর্যন্ত তাঁরাই তো বিজয়ী। এই দর্শকেরা আগেভাগেই অনলাইনে ম্যাচের টিকিট কেটে চলে এসেছেন কলকাতায়। তাঁদেরই একজন মোহাম্মদ সেলিম ঢাকা থেকে কালই কলকাতায় পা রেখেছেন। ভারতের বিপক্ষে জামাল ভূঁইয়ারা হতাশা করবেন না, এটিই তাঁর আশা, ‘শুধু ফুটবল ম্যাচটি দেখার জন্যই কলকাতায় আসা। ভারত স্বাগতিক হলেও বাংলাদেশও খারাপ করবে না। আমরা খুবই আশাবাদী।’

এই ছোট ছোট আশাই ছিল আজকের বাংলাদেশের অনুপ্রেরণা। এখন এ মানুষগুলোই দেশে ফিরবেন জিততে জিততে ড্রয়ের আনন্দ নিয়ে। হয়তো সারা জীবন গল্প করতে পারবেন, সেদিনের সেই লড়াকু ড্রয়ের ম্যাচে আমিও ছিলাম।