নতুন প্রতিভা পেয়েছে বাংলাদেশ

>মাত্র ৯ বছর বয়সেই চট্টগ্রামের হয়ে জাতীয় দাবায় খেলে রেকর্ড গড়েছে মনোন নীড়। ভবিষ্যতে এই ছেলেকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে পারে বাংলাদেশ।
৯ বছর বয়সেই চমক মনোন রেজা নীড়ের। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
৯ বছর বয়সেই চমক মনোন রেজা নীড়ের। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

কতই–বা বয়স?
আন্দাজ করে কেউ বলাবলি করছিল ১০। পাশ থেকে মা শুধরে দিয়ে বলেন আরও কম—৯। কখনো দুই গালে হাত দিয়ে ভাবছে, মনঃপূত না হলে কখনো–বা অজান্তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে আলতো করে বলছে ‘ধুর’, খুব বেশি চাপে থাকলে একটু পায়চারিও করে নিচ্ছে। আবারও বয়স যে তার মাত্র ৯, সেটা মনে করে নিতে হচ্ছে, কারণ দাবা বোর্ডে দেখা গম্ভীর বালককে বয়সের সঙ্গে মেলানো যায় না। সাদাকালো বোর্ডে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকা বালকের নাম মনন রেজা নীড়।

গতকাল জাতীয় দাবার চতুর্থ রাউন্ডে বোর্ডের অপর প্রান্তে বসা বালকের প্রতিপক্ষ অভিজ্ঞ দাবাড়ু দেলোয়াড় হোসেন। কিন্তু ৯ বছরের বালকের বিপক্ষে ঘেমেনেয়ে ওঠার মতো অবস্থা। হাতি-ঘোড়া শুয়ে পড়ে, কিন্তু রাজা থাকে বহাল তবিয়তে। সাদাকালো ৬৪ খোপের এ প্রাণপণ মস্তিষ্কের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয় ৯ বছরের বালকেরই। ২০৩০ রেটিংধারী মনন হারিয়ে দিয়েছে ২০৯২ রেটিংধারী অভিজ্ঞ দাবাড়ুকে। বয়সের কথাটি প্রাসঙ্গিক কারণেই বারবার চলে আসছে লেখায়। কারণ মাত্র ৯ বছর বয়সে জাতীয় দাবায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করে রেকর্ড গড়েছে এই ক্যান্ডিডেট মাস্টার।

জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে ষষ্ঠ হয়ে এই সুযোগ পেয়েছে খুদে এই দাবাড়ু। সেখানে মনোন হারিয়ে দিয়েছিল দুবারের সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ফিদে মাস্টার রেজাউল হক ও সাবেক জাতীয় দলের ফিদে মাস্টার সাইফউদ্দিন লাভলুকে। এ যেন ৯ বছর বয়সেই সম্ভাবনার খনি। ফেডারেশন-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এর আগে এত কম বয়সে জাতীয় দাবার চূড়ান্ত পর্বে সুযোগ পায়নি আর কেউ। এর আগে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ সবচেয়ে কম বয়সে জাতীয় দাবায় খেলেছিলেন। অনেকের বক্তব্য অনুযায়ী তখন নিয়াজের বয়স ছিল ১০। সে হিসাবে নিয়াজকে পেছনে ফেলে দিয়েছে মনন।

নারায়ণগঞ্জ ফিলোসোফিয়া ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে মনন। অন্য সব বালকের মতোই তার প্রতিদিনের জীবন। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে টেবিলে কলম খেলা, জুতোর ফিতে ধরে টানাটানি। ফুটবল দেখলে দৌড়ে গিয়ে লাথি মারা, ক্রিকেট ব্যাট হাতে গেলে আগে ব্যাটিং করার বায়না। কিন্তু এই ছেলেটিই দাবার বোর্ডে বসলে হয়ে ওঠে বিজ্ঞ যোদ্ধা। সব সময় পরের কয়েকটি চাল ভেবে রাখে। তূণের ভেতর থেকে তাই কোন সময় কোন অস্ত্র বের করবে, বোঝা মুশকিল।

গতকাল দাবা বোর্ডে মনোন। ছবি: প্রথম আলো
গতকাল দাবা বোর্ডে মনোন। ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবা নাজিম রেজা অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপে দাবা খেলতেন। পাঁচ বছর বয়স থেকেই পাশে বসে খেলা দেখত তাঁর বড় ছেলে মনোন। একদিন ক্রিকেট ব্যাট কিনবে বায়না ধরলে স্পোর্টস মার্কেটে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু বাসায় ফেরা দাবার বোর্ড নিয়ে। গল্পটা শোনালেন মা মৌমন রেজা, ‘ওর সব খেলার প্রতিই আগ্রহ। আগে ক্রিকেট ও ফুটবল বেশি পছন্দ করত। একদিন ক্রিকেট ব্যাট কিনতে গিয়ে মার্কেটে দাবা বোর্ড দেখে সেটা কিনে বাসায় ফিরে। এর পর থেকে দাবাটাই বেশি খেলে। লেখাপড়াও কমে গেছে। রোল নম্বর ১-২ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে দশে।’

তাঁর ছেলেকে যে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে, এই চাপ নেই। ছেলে বড় দাবাড়ু হয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করতে পারলেই মায়ের সুখ। এর মধ্যেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও তুলে এনেছে সাফল্য। কমনওয়েলথ জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ওয়েস্টার্ন এশিয়া ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে জিতেছে চারটি সোনা, তিনটি রুপা ও একটি ব্রোঞ্জ।

ভবিষ্যতে কী হতে চাও, গ্র্যান্ডমাস্টার না সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার? ৯ বছরের ছেলে এত কিছু বোঝে না। সে হতে চায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কার্লসেনের মতো, ‘আমি কার্লসেনের (ম্যাগনাস ওয়েন কার্লসেন) মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। ইউটিউবে তাঁর খেলা দেখি। বাংলাদেশের রাজীব স্যারের মতোও হতে চাই।’

বর্তমানে এলিগ্যান্টস চেস একাডেমিতে অনুশীলন করে মনোন। সেখানে তার শিক্ষক গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব ও গ্রান্ডমাস্টার আব্দুল্লাহ রাকিব। ছাত্রকে বড় সার্টিফিকেট দিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার রাজীব, ‘ওর ভবিষ্যৎ অনেক ভালো। এই বয়সের দাবাড়ুদের মধ্যে আমরা যেই আক্রমণাত্মক বিষয়টা দেখতে চাই, তা ওর মধ্যে আছে। সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে ওকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখা যায়।’

সেই বড় স্বপ্নটা কি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মতো কিছু! এখনই এত বড় প্রশ্নে যাওয়া বোকামি। তবে যে স্বপ্নের পেছনে ছুটছে মনোন, ভবিষ্যতে তার নামের পাশে লেখা হোক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, এ স্বপ্নটা আমরাও তো দেখতে পারি।