বাংলাদেশের গ্র্যান্ডমাস্টারদের আড্ডা 'দাবাময়' নয়

এক ফ্রেমে পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব, নিয়াজ মোরশেদ, এনামুল হোসেন রাজীব ও জিয়াউর রহমান (বাঁ থেকে)
এক ফ্রেমে পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব, নিয়াজ মোরশেদ, এনামুল হোসেন রাজীব ও জিয়াউর রহমান (বাঁ থেকে)
>বাংলাদেশের দাবার পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারদের পরস্পরের সম্পর্ক দারুণ। স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় মোড়া এই পাঁচের নিজেদের মধ্যে আড্ডা কিন্তু সব সময়ই দাবাময় নয়। এতে গান, শিল্প, সাহিত্য সবই থাকে।

কেমন হয় তাঁদের পাঁচজনের আড্ডাটা? তাঁরা পাঁচজন মানে বাংলাদেশের দাবার পঞ্চপাণ্ডব। নিয়াজ মোরশেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব আর এনামুল হোসেন রাজীব-বাংলাদেশের দাবার পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার। তা তাঁরা আড্ডায় বসলে ঘোড়ার আড়াই চাল, সৈন্যের হাতে মন্ত্রী সাহেব খতম বা কিস্তি মাত নিয়েই কি কথা হয়? নাকি গান-বাজনা আর একটু খুনসুটির আড়ালে হারিয়ে যায় দাবার জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা!

এসব নিয়ে জানতে পাঁচজনের সঙ্গে আড্ডায় বসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু একেক জনের একেক ব্যস্ততায় জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেই একসঙ্গে খেলা হয়ে ওঠে না তাঁদের। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে সর্বশেষ এনামুল হোসেন গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর এই প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে একসঙ্গে খেলেছেন পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার। চ্যাম্পিয়নশিপ শেষ হতেই আবার শুরু নাগরিক ব্যস্ততা!

পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে তাই আড্ডা দিতে হয়েছে মুঠোফোনে। আচ্ছা, আপনাদের আড্ডাটা বুঝি খুব গুরুগম্ভীর হয়? জিয়াউর রহমান হেসে উত্তর দেন, ‘না, না; সেটা হবে কেন। আমরা দাবা খেলোয়াড় বলে কি আমাদের জীবনে হাসিঠাট্টা বলে কিছু নেই!’ গান কে করেন? জিয়া বলতে থাকেন, ‘রাজীব ছাড়া আমরা বাকি চারজনই গান করতে পারি। নিয়াজ ভাই ভালো গান করেন। রিফাত-রাকিবও। সব ধরনের গানই করি আমরা। সফরে গেলে টুর্নামেন্টে বিরতির সময় আমরা একসঙ্গে সিনেমা দেখতেও যাই।’

নিয়াজ সবার বড় বলেই কি গানে তাঁকে এগিয়ে রেখেছেন জিয়া? না, তা নয়। নিয়াজের গানের একটি অ্যালবামও বেরিয়েছে। কিন্তু আড্ডার গানে বাকিরা জিয়াকেই সেরার তকমা দিয়েছেন। আবদুল্লাহ আল রাকিব যেমন বললেন, ‘জিয়া ভাই-ই সবচেয়ে ভালো গান।’ রাজীবের কথা, ‘আমি তো জিয়া ভাইকেই সেরার ভোটটি দেব।’ রিফাতও বাকি দুই সতীর্থের কথায় সায় দিয়েছেন। নিয়াজ অবশ্য একটু টেকনিক্যাল, ‘আমি যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শিখেছি। তাই বলব, টেকনিক্যালি আমি ভালো। আর কণ্ঠের কথা বললে জিয়া অসাধারণ।’

আড্ডার কথা উঠলে রিফাত যেন চলে গেলেন অতীতের কোনো এক আড্ডায়, ‘এখন আর সেভাবে আড্ডা দেওয়া হয় না। আর সবাই ব্যস্ত বলে সময়ও পাই না আসলে। কিন্তু আমরা একসঙ্গে হলে খুব মজা করি। কেউ গান করে, কেউ গল্প বলে।’ কোনো কফিহাউস বা চায়ের দোকান অথবা কোনো রেস্তোরাঁয় নয়, বাংলাদেশের পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের আড্ডা বেশি হয় বাইরে একসঙ্গে কোনো টুর্নামেন্ট খেলতে গেলে। তা আড্ডা যেখানেই হোক, কফিহাউস গানের নির্বাক শ্রোতা ডি সুজার ভূমিকাটা সেখানে নেন রাজীব। রিফাতের কথা, ‘রাজীব খুব ভালো শ্রোতা। খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের গান শোনে ও।’

এত দিনের চেনা সতীর্থদের কে কেমন, সেটাও বলে দিলেন রিফাত, ‘নিয়াজ ভাই সব বিষয়েই খুব ভালো জ্ঞান রাখেন। জিয়া ভালো গান করে। রাকিব পড়তে খুব ভালোবাসে।’ কার লেখা ভালো লাগে? রাকিবের উত্তর, ‘কাহলিল জিবরান, দস্তয়ভস্কি ভালো লাগে। আসলে আমি ছোট থেকেই একটু নিরিবিলি আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতে ভালোবাসি। তাই দর্শনবিষয়ক লেখাই আমার পছন্দ।’

খেলা হিসেবেও রাকিব বেছে নিয়েছেন নিরিবিলি আর চিন্তার খোরাক জোগানো দাবার বোর্ড। তা এমন খেলায় এসেছেন কার অনুপ্রেরণায়? ‘বাবা দাবা খেলতেন, তাঁর কাছেই শিখেছি। তিনিই আমার দাবা খেলার প্রেরণা।’ জিয়ার দাবার প্রেরণা দুজন-বাবা ফয়জাম উদ্দিন আহমেদ ও মা জেরিনা আহমেদ। রাজীবেরও তা-ই, দাবার হাতেখড়ি বাবা বেলায়েত হোসেনের কাছে। রাকিবকে দাবা শিখিয়েছেন তাঁর বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ। নিয়াজের বাড়ির নিচতলায় একজন চিকিৎসক থাকতেন। সেই চিকিৎসক ফরহাদের কাছে শিখেই ১৯৮৭ সালে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন।

রাকিব, জিয়া আর রাজীবের দাবার বাইরে আর কোনো জগৎ নেই। নিয়াজ অবশ্য কিছু না কিছু করেন। রিফাত করছেন চাকরি। যে যা-ই করুন, যত দিন পারেন খেলে যেতে চান দাবা। যার মানে দাঁড়ায়, পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের জীবনটা এখনো দাবাময়। একটা সময় ছিল আরও বেশি। তখন তাঁদের শয়নে-স্বপনে ছিল শুধুই দাবা।