দশকের সেরা দশ ফুটবল ম্যাচ

ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে ছবিটা! ছবি: এএফপি
ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে ছবিটা! ছবি: এএফপি
>শেষ হয়ে গেছে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক। ২০১০ থেকে সর্বশেষ এক দশকে কত কিছুই না ঘটেছে ক্রীড়াবিশ্বে। কত উত্থান-পতন, কত অঘটন, কত রূপকথার গল্প লেখা হয়েছে খেলার মাঠে, ট্র্যাকে কিংবা পুলে। গত এক দশকের সেই সব আলোচিত ঘটনা নিয়েই প্রথম আলোর এই ধারাবাহিক আয়োজন। আজকের পর্বে নিশাত আহমেদ তুলে এনেছেন গত এক দশকের আন্তর্জাতিক ও ক্লাব ফুটবলের রুদ্ধশ্বাস দশ ম্যাচকে

প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো দশটি ম্যাচ বেছে নেওয়ায় বেশ কিছু অসাধারণ ম্যাচ বাদ দিতে হয়েছে। শীর্ষ দশ ম্যাচ সম্পর্কে আলোচনা করার আগে সেসব ম্যাচ গুলো কী কী, একটু বলে রাখা ভালো।

প্রথমেই আসে ২০১৫-১৬ ইউরোপা লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগটার কথা। প্রথম লেগে ডর্টমুন্ডের মাঠে গিয়ে ১-১ গোলে ড্র করে এসেছিল লিভারপুল। লিভারপুলের মাঠে ৫৮ মিনিটে ৩-১ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল লিভারপুল। শেষ ৩৪ মিনিটে তিন গোল করে দলকে সেমিতে উঠিয়েই ছাড়েন ফিলিপ কুতিনহো, দেয়ান লভরেন ও মামাদু সাখোরা। ২০১০ বিশ্বকাপের মহানাটকীয় উরুগুয়ে-ঘানা কোয়ার্টার ফাইনালটার কথাও উল্লেখ করতে হয়। ১-১ সমতায় তখন ম্যাচ। ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে ডমিনিক আদিয়ার হেড প্রায় গোল হয়েই যাচ্ছিল, লুইস সুয়ারেজ গোললাইন থেকে হাত দিয়ে ঠেকিয়ে দিলেন বল। লালকার্ডও পেয়েছিলেন, ঘানা পেয়েছিল একটা পেনাল্টি। কিন্তু সে পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন ঘানার স্ট্রাইকার আসামোয়াহ জিয়ান। পেনাল্টি শুটআউটে শেষ হাসি সুয়ারেজদেরই!

আগুয়েরোর সেই বুনো দৌড় যেন ইতিহাসের অংশ। ছবি: রয়টার্স
আগুয়েরোর সেই বুনো দৌড় যেন ইতিহাসের অংশ। ছবি: রয়টার্স

২০১১-১২ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে হারতে হারতে একদম শেষ দিকে চেলসির হয়ে দিদিয়ের দ্রগবার সেই শক্তিশালী হেডে গোল, বা পরে পেনাল্টি শুটআউটে তাঁর পা থেকেই জয়সূচক গোল করার কথাটাই বা কীভাবে ভোলা যায়? কিংবা ২০১১-১২ প্রিমিয়ার লিগ মৌসুমের একদম শেষ রাউন্ডের কথাই ধরুন। সেবার শিরোপা কে জিতবে, সেটা নির্ধারিত হয়েছিল একদম শেষ দিনে এসে। এদিকে স্যান্ডারল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ওদিকে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সকে পেয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি। ওয়েইন রুনির গোলে ১-০ গোলে জয় নিয়েই ইউনাইটেডের খেলোয়াড়েরা অপেক্ষা করছিলেন সিটির পা হড়কানোর। সিটির পা হড়কাচ্ছিল বৈকি! যোগ করা সময়ের আগ পর্যন্ত স্কোরলাইন ২-১ ছিল। কিন্তু যোগ করা সময়ে ইউনাইটেডের আশায় পানি ঢেলে দেন সিটির দুই স্ট্রাইকার এডিন জেকো ও সার্জিও আগুয়েরো। ধারাভাষ্যকারের ‘অ্যাগুয়েরোওওওওওও...’ চিৎকারের সঙ্গে আর্জেন্টাইন তারকার জার্সি খুলে সেই বুনো দৌড়, কে ভুলতে পারে?

এ রকম অনেক ম্যাচকে চাইলে এই তালিকায় রাখা যায়। কিন্তু এর থেকেও আরও উত্তেজনাকর ও রোমাঞ্চকর ম্যাচ ছিল যে! সেগুলো কোন ম্যাচ? আসুন দেখে নেওয়া যাক!

ফন পার্সির সেই দুর্দান্ত হেড। ছবি: রয়টার্স
ফন পার্সির সেই দুর্দান্ত হেড। ছবি: রয়টার্স

১০. স্পেন ১-৫ নেদারল্যান্ডস (ফিফা বিশ্বকাপ, ২০১৪) 
এই ম্যাচের মাধ্যমেই মূলত নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, আন্তর্জাতিক ফুটবলে স্পেনের অর্ধযুগ ব্যাপী শাসন শেষ হচ্ছে অবশেষে। ২০০৮ ইউরো বা ২০১০ বিশ্বকাপের সেই উদ্যমী ক্যাসিয়াস, জাভি, ইনিয়েস্তা, ফ্যাব্রিগাসরা তখন বেশ বুড়িয়ে গেছেন। স্পেনের সে দিন যে আর নেই, সে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল আস্তে আস্তে। ম্যাচ শেষে সে গুঞ্জনটাই বাজখাঁই আওয়াজ হয়ে সবাইকে জানিয়ে দিল, স্পেনের রাজত্ব শেষ হয়েছে।

২৭ মিনিটে পেনাল্টিতে গোল করে জাবি আলোনসো এগিয়ে দিয়েছিলেন স্পেনকেই। ম্যাচের ৪৪ মিনিটে ডাচ স্ট্রাইকার রবিন ফন পার্সি যে গোল করে নেদারল্যান্ডসকে সমতায় ফেরালেন, নিশ্চিতভাবেই এই দশকের অন্যতম সেরা গোল হয়ে থাকবে সেটা। ১-১ সমতায় প্রথমার্ধ শেষ হয়। তবে আসল চমক অপেক্ষা করছিল দ্বিতীয়ার্ধে। জেরার্ড পিকেদের রক্ষণভাগের ভুলের পুরো সুবিধা তুলে নেন পার্সি-রোবেনরা। ৫-১ গোলে শেষ হয় ম্যাচ। ২০১০ সালের বিশ্বকাপজয়ী স্পেন চার বছর পর প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে যায়। আর চার বছর আগের বিশ্বকাপ ফাইনাল হারের সে দুঃখ না জুড়ালেও, একটু হলেও সান্ত্বনা পায় ডাচরা।

লুকাকু সেদিন করেছিলেন হ্যাটট্রিক। ছবি: এএফপি
লুকাকু সেদিন করেছিলেন হ্যাটট্রিক। ছবি: এএফপি

৯. ওয়েস্ট ব্রম ৫-৫ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ২০১২-১৩)
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার হিসেবে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের শেষ ম্যাচ ছিল এটি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে শিষ্যরা দুর্বল ওয়েস্ট ব্রমকে হেসেখেলেই হারাবে। কিন্তু ওয়েস্ট ব্রম যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, ইংলিশ লিগের শ্রেষ্ঠতম ম্যানেজারের শেষ লড়াইটা রোমাঞ্চকর করার জন্য।

শিনজি কাগাওয়া ও অ্যালেক্সান্ডার বাটনারের সঙ্গে এক আত্মঘাতী গোল মিলিয়ে সহজ জয়ের পথেই এগোচ্ছিল ইউনাইটেড। ৪০ মিনিটে জেমস মরিসন এক গোল করে ব্যবধান কমান, ৩-১ গোলে শেষ হয় প্রথমার্ধ। তখন চেলসি থেকে ধারে ওয়েস্ট ব্রমে খেলা রোমেলু লুকাকু ৫০ মিনিটে গোল করে আরেকটু ব্যবধান কমান। ৬৩ মিনিটের মধ্যে আরও দুই গোল করে স্কোরলাইন ৫-২ করেন ইউনাইটেডের দুই স্ট্রাইকার রবিন ফন পার্সি ও হাভিয়ের হার্নান্দেজ।

কিন্তু এর পরে যা হল, স্যার অ্যালেক্স কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন সেটা?

শেষ দশ মিনিটে গুনে গুনে তিন গোল দিল ওয়েস্ট ব্রম। লুকাকু পূর্ণ করলেন তাঁর হ্যাটট্রিক। ৫-৫ গোলে শেষ হয় ফার্গুসনের শেষ ম্যাচ।

দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন ওয়ালকট। ছবি: এএফপি
দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন ওয়ালকট। ছবি: এএফপি

৮. রিডিং ৫-৭ আর্সেনাল (ইংলিশ লিগ কাপ ২০১২-১৩)
লিগ কাপের এই ম্যাচে আর্সেনাল হেসেখেলে জিতবে বলে যারা ভেবেছিলেন, চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার কথা তাদের। মাত্র ৩৭ মিনিটে নিজেদের মাঠে চার-চারটি গোলে এগিয়ে গিয়েছিল রিডিং, ভাবা যায়! আন্দ্রে আরশাভিন, থিও ওয়ালকট বা অলিভিয়ের জিরুরা বুঝেই উঠতে পারছিলেন না কীভাবে এত গোল খাচ্ছেন তাঁরা!

তা যাই হোক, চার গোল খাওয়ার পর হুঁশ হলো আর্সেনালের। প্রথমার্ধের একদম শেষে গোল করে ব্যবধান কমান ইংলিশ উইঙ্গার থিও ওয়ালকট। ৬৩ মিনিটে ফরাসি স্ট্রাইকার অলিভিয়ের জিরুর গোল। ৮৯ মিনিটে ফরাসি ডিফেন্ডার লরাঁ কসিয়েলনি যখন গোল করলেন, আর্সেনাল শিবিরে তখন ‘কামব্যাক’ এর স্বপ্ন। ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে নিতে হলে আরও একটি গোল করতেই হবে, যোগ করা পাঁচ মিনিটের মধ্যে। ওয়ালকটের আরেক গোল সমতায় ফেরায় আর্সেনালকে। ১০৩ মিনিটে গোল করে ম্যাচে প্রথমবারের মতো আর্সেনালকে এগিয়ে দেন মরক্কোর স্ট্রাইকার মারুয়ান শামাখ। ম্যাচে প্রথমবারের মতো পিছিয়ে পড়ে আবার জেগে ওঠে রিডিং। ১১৬ মিনিটে গোল করে স্কোরলাইন ৫-৫ করে দেন রাশিয়ার স্ট্রাইকার পাভেল পোগরেবানিয়াক। বাকি চার মিনিট কোনো রকমে কাটাতে পারলেই পেনাল্টি শুটআউট, এ কথা রিডিং ঠিকমতো হয়তো ভাবা শুরুও করতে পারেনি, তার আগেই দুই গোল দিয়ে আর্সেনালকে ৭-৫ গোলের জয় এনে দেন ওয়ালকট আর শামাখ।

একটা সামান্য লিগ ম্যাচে এমন গোলবন্যা হবে, কে ভেবেছিল?

জাভিদের জবাব জানা ছিল না রিয়ালের কাছে। ছবি: এএফপি
জাভিদের জবাব জানা ছিল না রিয়ালের কাছে। ছবি: এএফপি

৭. বার্সেলোনা ৫-০ রিয়াল মাদ্রিদ (স্প্যানিশ লা লিগা, ২০১০-১১)
অনেকের মতে, এই ম্যাচের পরেই হোসে মরিনহো ঠিক করেন, স্প্যানিশ লিগে বার্সার আধিপত্য খর্ব করতে হলে নিজের কৌশল আরেকটু রক্ষণাত্মক করতে হবে। আর পরবর্তীতে ওই তুলনামূলক রক্ষণাত্মক কৌশল দিয়েই পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনার আধিপত্য একটু হলেও খর্ব করেন মরিনহো। আর এখানেই ম্যাচটার মাহাত্ম্য।

স্পেনে আসার পর এটাই ছিল মরিনহোর প্রথম এল ক্লাসিকো। এ ম্যাচে জাবি আলোনসো আর মেসুত ওজিলের মতো দুজন এমন মিডফিল্ডারকে নামিয়েছিলেন মরিনহো, বল পায়ে না থাকলে যাদের রক্ষণ করতে তেমন ইচ্ছে হয় না। বল পায়ে কুশলী বার্সার মিডফিল্ডারদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য নিজের বল পায়ে কুশলী এই দুই মিডফিল্ডারকে নামিয়ে দিয়েছিলেন মরিনহো। বার্সেলোনার বিপক্ষে নিজের ডিফেন্ডারদের বলেছিলেন প্রায় মাঝমাঠ পর্যন্ত উঠে যেতে, নিজেদের ডি-বক্সে বসে না থাকতে। ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। ওপরে উঠে আসা রামোসদের পেছনের জায়গাটায় এক রকম ‘উৎসব’ করেন লিওনেল মেসি। ৫-০ গোলে ম্যাচ জেতে পেপ গার্দিওলার দল। একটি করে গোল করেন জাভি, পেদ্রো ও জেফরেন সুয়ারেজ। দুটি গোল করেন ডেভিড ভিয়া।

ম্যাচের পরেই মরিনহো সিদ্ধান্ত নেন, বার্সাকে আটকাতে হলে এমন তিনজন মিডফিল্ডারকে নামাতে হবে, যাদের মূল কাজ হবে দলের রক্ষণভাগকে সাহায্য করা। আর প্রতি আক্রমণের সময়ে রোনালদোদের শক্ত ভিত্তি দেওয়া। যে কারণে এর পর এল ক্লাসিকোগুলোতে প্রায়ই দেখা যেত মিডফিল্ডে মেসুত ওজিল খেলছেন না, খেললেও খেলছেন উইঙ্গার হিসেবে। বার্সার বিপক্ষে সামি খেদিরা, জাবি আলোনসো, মাইকেল এসিয়েন, লাসানা দিয়ারা, এমনকি পর্তুগিজ ডিফেন্ডার পেপেও খেলেছেন মিডফিল্ডে।

এ ম্যাচটা তাই বার্সার বিপক্ষে নতুন রিয়ালের জন্ম হওয়ার ম্যাচ।

ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেওয়া সেই স্কোরলাইন। ছবি: এএফপি
ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেওয়া সেই স্কোরলাইন। ছবি: এএফপি

৬. ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ৮-২ আর্সেনাল (ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, ২০১১-১২) 
আর্সেনালের অবস্থা তখন আক্ষরিক অর্থেই তথৈবচ। তারকা কিনতে আর্সেন ওয়েঙ্গারের অনীহা সব সময়েই ছিল, সব সময় খেলোয়াড়দের গড়তে চেয়েছেন। সেবারও সেটাই হয়েছিল। ফলে আর্সেনাল লিগ শুরুই করেছিল খোঁড়াতে খোঁড়াতে। নিউক্যাসলের সঙ্গে ড্র ও লিভারপুলের সঙ্গে হেরে মৌসুম শুরু করা আর্সেনাল মুখোমুখি হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। দলবদল শেষ হওয়ার আর মাত্র দুই দিন বাকি তখন। শেষ দুই দিনে যদি দলে তারকা খেলোয়াড় না আসে, তাহলে তার চড়া মাশুল দিতে হতে পারে আর্সেনালকে, এটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল।

সে বিপর্যয়টাই হয়েছিল ইউনাইটেডের বিপক্ষে। ৪১ মিনিটের মধ্যে অ্যাশলি ইয়ং, ড্যানি ওয়েলবেক ও ওয়েইন রুনির তিন গোলে এগিয়ে গেল ইউনাইটেড। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার একটু আগে গোল করে ব্যবধান কমান ওয়ালকট। দ্বিতীয়ার্ধে আর্সেনালকে আরও চেপে ধরে ইউনাইটেড। একে একে গোল করেন পার্ক জি সুং, নানি। আরও একটি গোল করেন রুনি। গোল খেয়ে মাথা খারাপ হয়ে যায় আর্সেনালের। ফলাফল, ৭৭ মিনিটে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন ইংলিশ রাইটব্যাক কার্ল জেনকিনসন। পরে রুনি ও ইয়ংয়ের আরও একটি করে গোলে ৮-২ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইউনাইটেড।

ম্যাচের পরদিন দলবদলের শেষ মুহূর্তে এক সঙ্গে চারজন নতুন খেলোয়াড়কে কেনেন ওয়েঙ্গার - মিকেল আরতেতা, পার মার্টেস্যাকার, আন্দ্রে সান্তোস ও পার্ক চু-ইয়ং।

রামোসের সেই হেড। ছবি: এএফপি
রামোসের সেই হেড। ছবি: এএফপি

৫. রিয়াল মাদ্রিদ ৪-১ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ (উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০১৩-১৪, ফাইনাল)
রিয়াল মাদ্রিদের পরম আরাধ্য ‘লা ডেসিমা’ জেতার ম্যাচ। তবে ম্যাচে প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিল অ্যাটলেটিকোই। ৩৬ মিনিটে উরুগুয়ের ডিফেন্ডার ডিয়েগো গডিন গোল করে এগিয়ে দেন দলকে। ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রিয়াল সে গোলটা শোধই করতে পারছিল না। অ্যাটলেটিকোর রক্ষণভাগের আশপাশ দিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, গ্যারেথ বেলরা। এরপরেই মঞ্চে আগমন দলের অধিপতি সার্জিও রামোসের। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে দুর্দান্ত এক হেডে রামোস সমতায় ফেরান রিয়ালকে। মৃতপ্রায় রিয়াল বেঁচে ওঠার নতুন সঞ্জীবনী সুধা পায়।

গোল খেয়ে অ্যাটলেটিকোর মন ভেঙে যায় যেন। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয় নির্ভরযোগ্য রাইটব্যাক হুয়ানফ্রানের পায়ের চোট। তখনো প্রয়োজনে অতিরিক্ত একজন খেলোয়াড় বদলি করার নিয়মটা আসেনি। অতিরিক্ত সময়ের আগেই নিজেদের জন্য নির্ধারিত তিনজন খেলোয়াড়কে বদল করে ফেলেছিল অ্যাটলেটিকো। ফলাফল, মাঠে থেকেও যেন ছিলেন না হুয়ানফ্রান, হাঁটতেই পারছিলেন না, রোনালদোদের দৌড়ে ধরা তো দূরে থাক। আর সে সুযোগে অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে আরও তিন গোল করে বসে রিয়াল—গ্যারেথ বেল, মার্সেলো ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কল্যাণে। নিজেদের দশম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জেতে রিয়াল।

ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়া আরেক স্কোরলাইন। ছবি: এএফপি
ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়া আরেক স্কোরলাইন। ছবি: এএফপি

৪. ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ১-৬ ম্যানচেস্টার সিটি (ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ২০১১-১২) ।
আক্ষরিক অর্থেই এই ম্যাচটা সিটির নিজেদের আবির্ভাব ঘোষণা করার ম্যাচ।

নতুন মালিকের অর্থ আসার পর প্রতিবেশীরা যে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছে, ম্যানচেস্টারে যে লাল দলের আর সেই আগের মতো একচ্ছত্র প্রভাব নেই, সেটা এই ম্যাচের পরেই হাতে-কলমে বুঝতে পারেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। এর আগে সিটিতে নতুন নতুন খেলোয়াড় আসা, তাদের বড় বড় কথার তুবড়ি ছোটানোর বিষয় গুলিকে ফার্গুসন ‘বাচাল প্রতিবেশীর কাজ’ বলে পাত্তা না দিতে চাইলেও, এই ম্যাচের পর তিনি বোঝেন, যা রটে, তা কিছু হলেও বটে।

দ্বিতীয়ার্ধে ইউনাইটেডের সেন্টারব্যাক জনি এভান্স লাল কার্ড দেখলে ম্যাচ গোল উৎসবে রূপ নেয়। ৬৯ মিনিটে সিটি ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে যান। ৮১ মিনিটে ড্যারেন ফ্লেচার এক গোল করে ব্যবধান কমালেও শেষ দশ মিনিটে আরও তিন গোল করেন এডিন জেকো আর ডেভিড সিলভা। আর ১৯৯৫ সালের পর ঘরের মাঠে সবচেয়ে বড় পরাজয় জোটে ইউনাইটেডের কপালে।

দুর্দান্ত সেই কামব্যাকের পর। ছবি: এএফপি
দুর্দান্ত সেই কামব্যাকের পর। ছবি: এএফপি

৩. বার্সেলোনা ৬-১ পিএসজি (উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০১৬-১৭,শেষ ষোলো, দ্বিতীয় লেগ)
ঘরোয়া ফুটবলে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় ছাপই রাখতে পারছিল না পিএসজি। চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্যের ভাঁড়ারটা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা দেওয়া যায় প্রথম লেগের পর। বার্সেলোনাকে একদম চেপে ধরে ৪-০ গোলের জয় পায় তারা। পরের রাউন্ডে যেতে হলে পিএসজিকে ন্যূনতম পাঁচটা গোল দিতে হবে, এমন সমীকরণ মাথায় নিয়ে দ্বিতীয় লেগ খেলতে নামেন মেসিরা।

ম্যাচের তিন মিনিটেই গোল করে ব্যবধান ১-০ করেন লুইস সুয়ারেজ। ফরাসি লেফটব্যাক লেভিন কুরজাওয়ার আত্মঘাতী গোলে বিরতির আগে ২-০ গোলের অগ্রগামিতা পেয়ে যায় বার্সেলোনা। বিরতির ঠিক পর পর লিওনেল মেসির এক পেনাল্টি গোলে ব্যবধান ৩-০ করে ফেলে বার্সেলোনা।

পিএসজির তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! মাত্র এক সপ্তাহ আগে পাওয়া পরম আরাধ্য ৪-০ গোলের জয়টা না মূল্যহীন হয়ে যায়। ৬২ মিনিটে গোল করে পিএসজি সমর্থকদের নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেন উরুগুয়ের স্ট্রাইকার এডিনসন কাভানি। ম্যাচের বাকি তখন আধা ঘণ্টার মতো, বার্সেলোনার গোল লাগবে অন্তত তিনটি!

পরের ২৬ মিনিটেও যখন আর কোনো গোল হল না, ভগ্ন মনোরথে অধিকাংশ বার্সা সমর্থকেরা তখন ক্যাম্প ন্যু ছেড়ে বাসার পথ ধরেছেন। তখনই জেগে উঠলেন নেইমার। দুর্দান্ত এক ফ্রি-কিকে স্কোরলাইন ৪-১ করে ফেলেন। জিততে আর দুটি গোল লাগে।

গোল খেয়ে পিএসজিও স্নায়ুর কাছে বশ মানা শুরু করে দেয়। ৯১ মিনিটে পেনাল্টি উপহার দিয়ে বসে বার্সাকে। সে পেনাল্টিতে গোল করে স্কোরলাইন ৫-১ করেন নেইমার। আর ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে সেই নেইমারের ক্রস থেকেই গোল করে বার্সাকে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলেন সার্জি রবার্তো। দুই লেগ মিলিয়ে ৬-৫ গোলের জয় পায় বার্সেলোনা!

এবার কামব্যাকের শিকার খোদ বার্সেলোনা। ছবি : এএফপি
এবার কামব্যাকের শিকার খোদ বার্সেলোনা। ছবি : এএফপি

২. লিভারপুল ৪-০ বার্সেলোনা (উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০১৮-১৯, সেমিফাইনাল দ্বিতীয় লেগ)
দুবছর আগে পিএসজিকে দেওয়া সে ওষুধেই এবার ঘায়েল বার্সেলোনা।

সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ৩-০ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল বার্সেলোনা। ফাইনালে লিভারপুল উঠতে পারবে, এমনটা দূরতম কল্পনাতেও ছিল না কারওর। কেননা ফাইনালে উঠতে হলে ৪-০ গোলে জিততে হতো যে। আর দলের আক্রমণভাগের মূল দুই ভরসা রবার্তো ফিরমিনো আর মোহাম্মদ সালাহ যেখানে নেই, চার গোল করবে কে?

প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জনক, আর পরিস্থিতিই নায়কের সৃষ্টি করে। সেদিন ছিল অখ্যাত বেলজিয়ান স্ট্রাইকার ডিভক অরিগি আর ডাচ মিডফিল্ডার জর্জিনিও ভাইনাল্ডামের নায়ক হওয়ার দিন। ম্যাচের সপ্তম মিনিটে জর্ডি আলবার রক্ষণ ভুলের সুযোগ নিয়ে দলকে এগিয়ে দেন অরিগি। দ্বিতীয়ার্ধে বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমে দুই মিনিটের মধ্যে হুট করে দুই গোল করে বসেন ভাইনাল্ডাম! মেসিদের চোখেমুখে তখন অবিশ্বাস, এ কী হচ্ছে!

ম্যাচের ৭৯ মিনিটে কর্নার থেকে ডিভক অরিগি যখন গোল করে লিভারপুলকে ৪-০ গোলের জয় এনে দেন, তার অনেক আগেই আসলে হেরে বসেছিল বার্সেলোনা। অন্তত মাঠে তাঁদের অভিব্যক্তি দেখে সেটাই মনে হয়েছিল।

জার্মানদের উল্লাস। ছবি: এএফপি
জার্মানদের উল্লাস। ছবি: এএফপি

১. ব্রাজিল ১-৭ জার্মানি (ফিফা বিশ্বকাপ ২০১৪, সেমিফাইনাল)
নিজের দেশে বিশ্বকাপ। পরম আরাধ্য ‘হেক্সা’ বা ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের উদ্‌যাপন দেশের মাটিতেই হবে, এ আশায় ২০১৪ বিশ্বকাপ শুরু করেছিল ব্রাজিল। সেমিফাইনাল পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা পায় টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেবারিট জার্মানিকে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, এটা ভেবেই ম্যাচ দেখতে বসেছিলেন সবাই। কিন্তু পরের নব্বই মিনিটে যা হলো, বিশ্বের কোনো ফুটবল দর্শক সেটা আগে থেকে কল্পনা করতে পেরেছিলেন বলে দাবি করতে পারবেন না। চোটের কারণে ম্যাচটা খেলতে পারেননি সবচেয়ে বড় তারকা নেইমার। ম্যাচের আগে নেইমারের জার্সি নিয়ে অশ্রুসিক্ত সতীর্থরা নেইমারকে জয় উপহার দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলেও সে কান্নাই যেন ব্রাজিলের দুর্বলতাটাকে দেখিয়ে দিয়েছিল বিশ্বের সামনে। অধিনায়ক সিলভার অনুপস্থিতিও দুর্বল করে দিয়েছিল তাদের। পরে যে দুর্বলতার ষোলোআনা ফায়দা তুলে নেয় জার্মানি।

কর্নার থেকে গোল করে উৎসবের সূচনাটা করে দেন টমাস মুলার। পরে ২৩ থেকে ২৯, এই ছয় মিনিটকে ব্রাজিল সমর্থকদের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম ছয় মিনিট বানিয়ে একে একে গোল করেন মিরোস্লাভ ক্লোসা, টনি ক্রুস, সামি খেদিরা। ডি-বক্সের বাইরে চিরায়ত জার্মানদের যান্ত্রিক ফুটবল, আর ডি-বক্সের মধ্যে সে সময়ের জার্মান লিগ চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন মিউনিখের সৌজন্যে শেখা দুর্দান্ত পাসিং ফুটবল, এই দুয়ের মিশেলে হাপিত্যেশ করতে থাকে হলুদ বাহিনী। দ্বিতীয়ার্ধে উইঙ্গার আন্দ্রে শুরলা আরও দুই গোল করে স্কোরলাইন ৭-০ করে দেন। শেষ দিকে অস্কারের গোলটা ব্রাজিলিয়ানদের কতটুকু শান্তি দিয়েছে, কে জানে!

৭-১ স্কোরলাইনটা শুধু এই দশকই নয়, বরং তর্কযোগ্যভাবে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর স্কোরলাইন। পরে ফাইনালে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাকেও হারায় এই জার্মানি, জিতে নেয় নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা।