মাহমুদউল্লাহর দলও যদি আজ তা পারত!

বাংলাদেশ কি জয় দিয়ে শেষ করতে পারবে পাকিস্তান সফর? ছবি: এএফপি
বাংলাদেশ কি জয় দিয়ে শেষ করতে পারবে পাকিস্তান সফর? ছবি: এএফপি

লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে লাল সবুজ পতাকা পাহারা দিচ্ছেন সশস্ত্র দুই পাকিস্তানি সৈনিক—এই ছবিটি দেখে পুলক অনুভব করা ছাড়া এখন পর্যন্ত এই সিরিজ আর কোনো সুখানুভূতি উপহার দিতে ব্যর্থ। খেলার সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো কিছু থেকে যখন আনন্দ খুঁজতে হয়, সেটিই আসলে বুঝিয়ে দেয় মাঠের চালচিত্র।

পরপর দুটি ম্যাচ, একটির চেয়ে আরেকটি খারাপ। প্রথমটিতে ১৪১ রানের পুঁজি নিয়েও শেষ ওভার পর্যন্ত লড়াই করার সান্ত্বনা ছিল। দ্বিতীয় ম্যাচ তো র‍্যাঙ্কিংয়ে দুই দলের পার্থক্য বুঝিয়ে দেওয়ার এক ডকুমেন্টারি। পাকিস্তান ১, বাংলাদেশ ৯।

সিরিজ শুরুর আগে র‍্যাঙ্কিংকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল। টি-টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের শীর্ষস্থান উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিয়ে বড়াই করার মতো। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স তো ভয়াবহ। সর্বশেষ ১০ ম্যাচে মাত্র একটিই জয়। গত অক্টোবরে শ্বাসরোধী নিরাপত্তায় প্রায় বন্দী শ্রীলঙ্কার তরুণ এক দলের কাছেও ৩-০ ম্যাচে হোয়াইটওয়াশ হতে হয়েছে। আজ সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে চোখ রাঙাচ্ছে যে অপমান।

এই সিরিজের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১০ টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের জয় মাত্র দুটি। পরপর দুই ম্যাচে। ২০১৫ সালে প্রথম জয়ের ম্যাচে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোস্তাফিজুর রহমানের সাড়ম্বর আবির্ভাব। কাকতালীয়ভাবে সেই ম্যাচ আর এই সিরিজের প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংস হুবহু এক—১৪১/৫! পার্থক্য বলতে সেবার তা করেছিল পাকিস্তান, এবার বাংলাদেশ। সাকিব (৩২ বলে অপরাজিত ৫১) আর সাব্বিরের (৪১ বলে অপরাজিত ৫৭) কল্যাণে জয় এসেছিল ৭ উইকেটে। এই দুজনের কেউই এবার নেই । পরের বছর এশিয়া কাপে ৫ উইকেটে জয়ের নায়ক আছেন। তবে না-থাকার মতোই। সেই ম্যাচে ১০০ স্ট্রাইক রেটে ৪৮ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ সৌম্য সরকার ছিলেন ওপেনার। পাকিস্তানে দুই ম্যাচে ৬ আর ৭ নম্বরে। দুবারই ইনিংসের বাকি তখন মাত্র ১৪ বল।

বড় একটা সমস্যার কথাও বলে দিচ্ছে এটি। পাকিস্তান সফর নিয়ে অনিশ্চয়তা ক্রিকেটারদের মানসিক প্রস্তুতিতে অবশ্যই ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, তবে মাত্রই বিপিএল খেলায় ক্রিকেটীয় প্রস্তুতি নিয়ে খুব একটা অভিযোগ করার কিছু ছিল না। এখন দেখা যাচ্ছে, সমস্যা করেছে ওই বিপিএলই! এক অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ছাড়া সব ব্যাটসম্যানই বিপিএলে ব্যাট করেছেন টপ অর্ডারে। ওপেনিংয়েই বেশি। বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপে তাই ওপেনারের ছড়াছড়ি। মিডল অর্ডার বলতে কিছু নেই। নিরাপত্তা শঙ্কায় পাকিস্তানে না-যাওয়া বাংলাদেশের সাদা বলের ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জিকে এক সাক্ষাৎকারে টপ অর্ডারে ব্যাটিং আর চার-পাঁচ-ছয়ে ব্যাটিংয়ে মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্যের কথাই তুলে ধরতে দেখলাম। মুশফিকুর রহিমকে না-পাওয়ার হাহাকারটা যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগটা একটু বেশিই। হারলে এমন সব কথাবার্তা হতে থাকে, যার বেশিরভাগই ক্রিকেটীয় যুক্তি বিবর্জিত। এবার তামিম ইকবালকে নিয়ে যেমন হচ্ছে। প্রথম ম্যাচে তামিম আর নাঈমের ৭১ রানের জুটিটা হয়ে গেছে ‘অপরাধ’। কারণ তা করতে ১১ ওভার ‘খেয়ে’ ফেলা। কেউ এই প্রশ্নটা তুলছে না, হাতে ১০ উইকেট থাকার পরও পরের ৯ ওভারে কেন ৭০ রানের বেশি উঠল না?

দ্বিতীয় ম্যাচে ৫৩ বলে ৬৫ করেও সেই তামিমই আবার কাঠগড়ায়। ক্রিজে পৌঁছানোর মরিয়া চেষ্টার অভাবে রান আউট হওয়ার দোষে তিনি দোষী, কিন্তু এর আগের ১০ বলে ১৯ রান তুলে গেম প্ল্যানটা কি তিনি বুঝিয়ে দেননি! মিডল অর্ডারে সাকিব আর মুশফিক থাকলে যেমন নির্ভার ব্যাট চালানো যায়, এখানে অনভিজ্ঞ মিডল অর্ডার কি তাঁকে সেটি করার স্বাধীনতা দিচ্ছে? মাঝখানে অনেক ঝড়ঝাপটা পার হয়ে কত দিন পর তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা—বাংলাদেশের আবেগপ্রবণ সমর্থকদের কাছ থেকে এই বিবেচনা আশা করাটা অবশ্য একটু বেশিই হয়ে যায়।

কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর কথাটাকেই বরং এই সিরিজের দুই তৃতীয়াংশের যথার্থ ময়নাতদন্ত বলে মনে হচ্ছে। অভিজ্ঞতা আর স্কিলে দুই দলের মধ্যে বড় পার্থক্য। অভিজ্ঞতা কথাটা ওই দুজনকে মনে করিয়ে দিল। প্রথম ম্যাচে ১৪১ টপকাতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হওয়া পাকিস্তানকে পার করেছেন শোয়েব মালিক। যাঁর ৩৮তম জন্মদিন বেশি দূরে নয়। দ্বিতীয় ম্যাচে বাবর আজমের বদলে মোহাম্মদ হাফিজ ম্যাচসেরা হলেও এমন কোনো অন্যায় হতো না। এই হাফিজ ৩৯ পেরিয়ে ৪০-এর দিকে ধাবমান। এই দুজনের ক্যারিয়ারেরই অবিচুয়ারি লিখে ফেলেছিলেন প্রায় সবাই। মিসবাহ-উল হক যে সেই দলে ছিলেন না, তা তো পরিষ্কারই। নিজে ৪২ পেরিয়ে যাওয়ার পরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। বয়সটা যে নিছকই একটা সংখ্যা—এটা মিসবাহর চেয়ে ভালো আর কে জানে! আর পাকিস্তান ক্রিকেটে মিসবাহর জানাটাই এখন শেষ কথা। একই সঙ্গে দলের কোচ ও প্রধান নির্বাচক—এই দ্বৈত ভূমিকায় দেখা দিয়ে যিনি অভূতপূর্ব এক কাণ্ড করে ফেলেছেন।

গত পরশু টেলিভিশনের এক টক শোতে সঞ্চালক প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশ দলের সমস্যাটা কোথায়? ডমিঙ্গোর কথার প্রতিধ্বনি করে অভিজ্ঞতা আর স্কিলের পার্থক্যের কথা বলেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, মার্টিন জনসনের কথাটাও বলতে পারতাম। এই মার্টিন জনসনটা কে? ইংল্যান্ডের এক ক্রিকেট সাংবাদিক। অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৮৬-৮৭ অ্যাশেজ শুরুর আগে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে ইংল্যান্ডের লেজেগোবরে অবস্থা দেখে যিনি লিখলেন, ‘এই ইংল্যান্ড দলের মাত্র ৩টি সমস্যা। তারা ব্যাট করতে পারে না, বল করতে পারে না আর ফিল্ডিং করতে পারে না।’

কদিন পর সেই ইংল্যান্ডই ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট জিতে গেল, সিরিজ জিতে ধরে রাখল অ্যাশেজও। নির্বিকার মার্টিন জনসন মন্তব্য করলেন, ‘রাইট লাইন, রং টিম।’ পরে জনসন সেই সিরিজ নিয়ে লেখা বইয়ের নামও দিয়েছেন ‘ক্যানট ব্যাট, ক্যানট বোল, ক্যানট ফিল্ড’।

প্রথম দুই ম্যাচের বাংলাদেশকে দেখেও মাত্র তিনটি সমস্যাই চোখে পড়েছে। ‘ক্যানট ব্যাট, ক্যানট বোল, ক্যানট ফিল্ড’। মাইক গ্যাটিংয়ের সেই ইংল্যান্ড মার্টিন জনসনকে যেভাবে জবাব দিয়েছিল, মাহমুদউল্লাহর বাংলাদেশও যদি আজ তা পারত!