ক্রোনিয়ের রহস্যময় মৃত্যু ও আকাশপথের দুঃখগাথা

হানসি ক্রনিয়ে খেলোয়াড়ি জীবনে, মৃত্যুর পরে। ছবি: সংগৃহীত
হানসি ক্রনিয়ে খেলোয়াড়ি জীবনে, মৃত্যুর পরে। ছবি: সংগৃহীত
কোবি ব্রায়ান্টের মৃত্যুশোক এখনো পুরোনো হয়নি। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে, তবু শাপেকোয়েনস দলটার জন্য এখনো হয়তো কাঁদেন অনেক ফুটবলপ্রেমী। খেলা যুগে যুগে আনন্দ যেমন দিয়েছে, কষ্টও যে কম দেয়নি! কখনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন প্রিয় খেলোয়াড়, প্রিয় দল, কখনো ভক্তরা প্রাণ দিয়েছেন খেলার প্রতি তাঁদের ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে। কেউ বেঁচে ফিরেছেন অবিশ্বাস্যভাবে, কারও কারও মৃত্যু রয়ে গেছে চিরদিনের রহস্য হয়ে। খেলার জগতে ঘটে যাওয়া এমন স্মরণীয় কিছু ট্র্যাজেডি নিয়েই এবারের আয়োজন। ধারাবাহিকের আজ শেষ পর্ব—


আজও রহস্য ক্রনিয়ে

অন্য অনেকের মতো হানসি ক্রনিয়েরও ঘৃণিত হওয়ার কথা ছিল। ম্যাচ গড়াপেটা, পাতানো—এসবের সঙ্গে কোনো ক্রিকেটার জড়িত হলে তাঁকে কে পছন্দ করবে? ক্রনিয়ে জড়িয়েছিলেন। কিন্তু কেন জানি তিনি ঘৃণিত নন। অশ্রদ্ধা? বুকে হাত দিয়ে এটাও খুব বেশি ক্রিকেট সমর্থক বলতে পারবে না।

অথচ ক্রনিয়ে নিজে স্বীকার করেছিলেন জুয়াড়িদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন তিনি। সরাসরি ম্যাচ পাতাননি, কিন্তু ম্যাচ–পূর্ববর্তী খবরাখবর ফাঁস করেছিলেন। অর্থের লোভে সতীর্থদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন খারাপ খেলার জন্য! এত কিছুর পরও ক্রনিয়ের জন্য একটা দুর্বল জায়গা আছে ক্রিকেট সমর্থকদের মনে। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের মনে তো অবশ্যই। নইলে কি আর ‘সর্বকালের সেরা ১১ দক্ষিণ আফ্রিকান’—এর একজন হিসেবে তাঁকে বেছে নেয় তারা? তাও আবার তাঁর রহস্যজনক মৃত্যুর দুই বছর পর!

হ্যাঁ, ক্রনিয়ের মৃত্যুটা এখনো রহস্যই সবার কাছে। দিল্লি পুলিশ যেদিন দাবি করল ভারতীয় এক জুয়াড়ির পাল্লায় পড়ে ম্যাচ পাতানোয় ভূমিকা রেখেছিলেন ক্রনিয়ে, এর আগপর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক ছিলেন ‘ক্রিকেট বিশ্বের ভদ্রলোক’। যান্ত্রিক দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে যেন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন তিনি। দেখিয়েছিলেন অধিনায়কত্ব কতটা দারুণ, কতটা আধুনিক হতে পারে। কিন্তু ওই যে পাতানো ম্যাচের অভিযোগ আর তাতে স্বীকারোক্তি, সে কারণে ২০০০ সালের অক্টোবরে ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয় ক্রনিয়েকে।

এটাও ট্র্যাজেডি। কিন্তু ক্রনিয়ে-ভক্তদের জন্য এর চেয়েও বড় ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছিল। বছর দু-এক পরের ঘটনা। ২০০২ সালের ১ জুন। জোহানেসবার্গ থেকে নিজের শহর জর্জে ফিরছিলেন। বিমানে তিনিই একমাত্র যাত্রী। জর্জ বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় বিধ্বস্ত হলো বিমানটা। দুজন পাইলটসহ ক্রনিয়ের সমাধি হলো কুটেনিকোয়া পাহাড়ে। দুর্ঘটনা বলেই মেনে নিয়েছিল সবাই। কিন্তু ২০০৭ সালে ক্রনিয়ের এক সময়ের গুরু ও তখন পাকিস্তান দলের কোচ বব উলমারের রহস্যজনক মৃত্যুর পর দানা বাঁধে সন্দেহ। ম্যাচ পাতানোর চক্রটা তাদের তথ্য-প্রমাণ সব মুছে ফেলার চেষ্টা করেনি তো?

ক্রনিয়ের যেসব ম্যাচ নিয়ে গড়াপেটার অভিযোগ উঠেছিল, তখন তো কোচ হিসেবে উলমারও ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলে!

এ প্রশ্নের জবাবটাও নিজের সঙ্গে নিয়ে গেছেন ক্রনিয়ে।

বিধ্বস্ত হওয়ার পর সেই বিমান, বিমানে ওঠার আগে শাপেকোয়েনস দল। ছবি: সংগৃহীত
বিধ্বস্ত হওয়ার পর সেই বিমান, বিমানে ওঠার আগে শাপেকোয়েনস দল। ছবি: সংগৃহীত

রূপকথার শেষ ট্র্যাজেডিতে
পিতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর। মাত্র ২১ বছর বয়সেই সে জন্য বিয়ে করেছিলেন থিয়াগিনহো। বছর না ঘুরতেই স্ত্রী সুসংবাদ দিলেন, বাবা হতে যাচ্ছেন তিনি। সেই খুশিতে একটা ভিডিও বানালেন থিয়াগিনহো। কাল্পনিক একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করার ভিডিও। এক সপ্তাহ পর সেই ভিডিওটাই হয়ে থাকল স্ত্রীর কাছে থিয়াগিনহোর স্মৃতি হয়ে। মানুষটা হারিয়ে গেলেন!

ব্রাজিলের শাপেকো শহরের জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব শাপেকোয়েনসের স্ট্রাইকার ছিলেন থিয়াগিনহো। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পাঁচ বছরের মাথায় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের প্রথম শ্রেণিতে উঠে আসে শাপেকোয়েনস। কিন্তু ১৯৭৯ সালে আবার ছিটকে পড়া সিরি ‘আ’ থেকে, ফিরতে ফিরতে আরও ৩৪টি বছর। এর মাঝে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের প্রায় তলানিতেও ঘুরে এসেছে তারা। ২০০৯ সালেও সিরি ‘ডি’-তে ছিল ক্লাবটি। ২০১৪ সালে সিরি ‘আ’-তে ফিরলেও ২০ দলের মধ্যে ১৫তম হয়ে কোনোমতে টিকে থাকা। পরের মৌসুমে এক ধাপ এগিয়ে চৌদ্দতম। ২০১৫ সালেই দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় প্রধান ক্লাব টুর্নামেন্ট কোপা সুদামেরিকানার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেই প্রথম স্বপ্নজাল বুনতে শুরু করে ক্লাবটি। পরের বছর সে স্বপ্নটাই পাখা মেলল। মহাদেশীয় পর্যায়ে বড় বড় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে উঠে এল ফাইনালে। ফিরতি লেগটা ঘরের মাঠে হওয়ার কথা থাকায় মনে হচ্ছিল ভাগ্য নিজেই বোধ হয় চাচ্ছিল, লেখা হোক শাপেকোয়েনসের রূপকথা। কে জানত রূপকথা নয়, গল্পটা শেষ হবে ট্রাজেডিতে!

কলম্বিয়ান ক্লাব অ্যাটলেটিকো ন্যাসিওনালের বিপক্ষে সুদামেরিকানা কাপের ফাইনালের প্রথম লেগ খেলতে কলম্বিয়ার মেডেলিন যাচ্ছিল শাপেকোয়েনস। লা মিয়া চার্টার্ড ফ্লাইটে ক্লাবের ২২ জন খেলোয়াড় ২৩ জন কর্মকর্তা, ২১ জন সাংবাদিকসহ ছিলেন মোট ৭৭ জন যাত্রী।

সাও পাওলো থেকে বলিভিয়ার সান্তাক্রুজ পর্যন্ত ফ্লাইট ঠিকঠাকই গেল। যাত্রাবিরতির পর সান্তাক্রুজ থেকে বিমান ছাড়তে কিছুটা দেরি হয়ে গেল। ফলে বলিভিয়ার কোবিজায় জ্বালানি নিতে পরের যে বিরতিটা নেওয়ার কথা ছিল, সেটা বাতিল করতে হলো পাইলটকে। কারণ ততক্ষণে কোবিজা বিমানবন্দরের জ্বালানি সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাবে। পাইলট সিদ্ধান্ত নিলেন কোবিজার বদলে কলম্বিয়ার বোগোটা বিমানবন্দরে গিয়ে জ্বালানি নেবেন।

সান্তাক্রুজ থেকে মেডেলিনের দুরত্ব ১৫৯৮ নটিক্যাল মাইল, কোবিজার দুরত্ব ৫১৪ নটিক্যাল মাইল, বোগোটার দূরত্ব ১৪৮৬ নটিক্যাল মাইল। বোঝাই যাচ্ছে পাইলট বিশাল বড় এক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আবার সেই পরিকল্পনায়ও স্থির থাকতে পারলেন না। আরেকবার বদলে সিদ্ধান্ত নিলেন মেডেলিনে গিয়েই থামার। মেডেলিনের কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দরে নিজেদের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার কথাটা জানাতে পারলেন না ঠিকঠাক, ফলে ল্যান্ড করার অনুমতি পেতেও একটু দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণে যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। আগুন লেগে গেল বিমানে, বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ থেকে বেঁচে ফিরলেন মাত্র ৬ জন! থিয়াগিনহো ছিলেন না সেই ৬ জনের মধ্যে!

তিনজন খেলোয়াড় বেঁচে ছিলেন মাত্র। এর মধ্যে গোলরক্ষক জ্যাকসন ফোলম্যানের হারিয়েছেন দুটি পা-ই।

সম্মান জানিয়ে ওই বছর অ্যাটলেটিকো ন্যাসিওনাল অনুরোধ করেছিল কোপা সুদামেরিকানার ট্রফি শাপেকোয়েনসকে দিয়ে দিতে। সেই অনুরোধ রেখেছিল কোপা সুদামেরিকানা কর্তৃপক্ষ।

কোবি ব্রায়ান্ট, যে শোক পুরোনো হয়নি এখনো। ছবিঃ সংগৃহীত
কোবি ব্রায়ান্ট, যে শোক পুরোনো হয়নি এখনো। ছবিঃ সংগৃহীত



বাস্কেটবলের ‘ব্ল্যাক মাম্বা’
১৩ বছরের মেয়ে জিয়ানার একটা বাস্কেটবল ম্যাচে খেলার কথা ছিল। মেয়েকে পৌঁছে দিতেই হেলিকপ্টারে করে যাচ্ছিলেন কোবি ব্রায়ান্ট। লস অ্যাঞ্জেলস লেকারসের হয়ে খেলার সময় থেকেই শহরের কুখ্যাত যানজট এড়াতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন ব্রায়ান্ট। ওই যাত্রায় কন্যা জিয়ানাসহ তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও সাতজন।

কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালাবাসেসের কাছে পার্বত্য অঞ্চলে সেই হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। কাউকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। মাত্র ৪১ বছর বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান সর্বকালের অন্যতম সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড়। দিনটা এ বছরের ২৭ জানুয়ারি।

‘ব্ল্যাক মাম্বা’ নামে খ্যাতি ছিল তাঁর বাস্কেটবলে। নামটা নিজেই বেছে নিয়েছিলেন। কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনোর কিল বিল সিনেমাটা খুব পছন্দ ছিল তাঁর। ওই সিনেমাতেই ক্ষুরধার ও ভয়ংকর আক্রমণাত্মক এক গুপ্তঘাতকের ‘কোড নেম’ ছিল এটা।

লেকারসের হয়ে ২০ বছরের ক্যারিয়ারে ১৮ বার অলস্টার টিমে জায়গা করে নিয়েছেন, পাঁচবার জিতেছেন এনবিএ চ্যাম্পিয়নশিপ। দুবার ফাইনালের মোস্ট ভ্যালুয়েবল খেলোয়াড় (এমভিপি), ২০০৮ সালে লিগের এমভিপি, দুবার অলিম্পিক সোনা। ২০১৬ সালে অবসরের পর ব্রায়ান্টের দুটি জার্সি নম্বর—৮ ও ২৪ চিরকালের জন্য তুলে রেখেছে লেকারস। ইতিহাসে আর কোনো বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের এই সম্মান জোটেনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে গড়েছিলেন এনবিএর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেকের রেকর্ড, সবচেয়ে কম বয়সে স্কোর করেছেন ৩৩০০০ ক্যারিয়ার পয়েন্টও। ক্যারিয়ার শেষ করেন ৩৩৬৪৩ পয়েন্ট নিয়ে, সর্বকালের সর্বোচ্চ পয়েন্ট তালিকায় তৃতীয় স্থানে থেকে।

২০১৫ সালে নিজের বিদায়ী মৌসুমের আগে বাস্কেটবলকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠি ছাপা হয়েছিল সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে, ওই চিঠি থেকে বানানো একটা অ্যানিমেশন শর্ট ফিল্মের জন্য অস্কারও জিতেছিলেন ব্রায়ান্ট। সেই চিঠিতেই লিখেছিলেন, কোনো দিন বাস্কেটবলকে ছেড়ে যেতে চান না। সে জন্যই অবসরের পরেও যুক্ত ছিলেন বাস্কেটবলে, মেয়েকেও বানাতে চেয়েছিলেন বড় বাস্কেটবল খেলোয়াড়।

আর নিয়তি! মৃত্যু ব্রায়ান্টকে কেড়ে নিল অবসরের মাত্র চার বছর পরেই, সঙ্গে তাঁর মেয়েকেও!