মেসি-হ্যাজার্ডদের সঙ্গে বাকিদের বেতনের যত পার্থক্য

বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন হচ্ছে সামান্যই। ছবি : এএফপি
বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন হচ্ছে সামান্যই। ছবি : এএফপি
>

ইউরোপীয় ক্লাবগুলোয় খেলোয়াড়দের বেতনকাঠামোটা ঠিক কেমন? ক্লাবে নিজেদের ভূমিকা ও গুরুত্ব অনুযায়ী কি খেলোয়াড়েরা বেতন পান? পরিসংখ্যান বলছে, না।

লিওনেল মেসির বেতন ঠিক কত?

সঠিক অঙ্কটা জানা প্রায় দুঃসাধ্য। তাও বিভিন্ন সূত্রের বরাতে যেটা জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে মূল বেতন হিসেবে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন পাউন্ড (১৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা প্রায়) করে পকেটে ঢোকাচ্ছেন মেসি। সঙ্গে অন্যান্য পারফরম্যান্স–সংক্রান্ত বোনাস তো আছেই। অঙ্কটা শুনলে একটা মনে হতেই পারে, নিজেদের সোনার ডিমপাড়া হাঁসকে কোনোভাবেই অসন্তুষ্ট রাখতে চায় না বার্সেলোনা। ওদিকে এই মৌসুমেই চেলসি থেকে রিয়াল মাদ্রিদে নাম লেখানো বেলজিয়ান উইঙ্গার ইডেন হ্যাজার্ডের বেতন আবার অত না হলেও চোখ ছানাবড়া করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রতি সপ্তাহে ৪ লাখ পাউন্ড (৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা প্রায়) করে পাচ্ছেন হ্যাজার্ড।

এবার গ্যারেথ বেলের চুক্তির দিকে নজর ফেরানো যাক। জিনেদিন জিদানের আস্থা হারাতে হারাতে ও চোটে জর্জরিত হয়ে ওয়েলস অধিনায়ক এই মৌসুমে খেলতে পেরেছেন মাত্র এগারো ম্যাচ, মিনিটের হিসাবে ৯৯২ মিনিট মাঠে থাকা বেল বেতন পাচ্ছেন হ্যাজার্ডের প্রায় সমান। সপ্তাহে ৩ লাখ ৫০ পাউন্ড (৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা) বেতন পাচ্ছেন তিনি, যা আরেক সতীর্থ কাসেমিরোর চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি। লিগে এখন পর্যন্ত ২৫ ম্যাচ খেলা কাসেমিরো রিয়াল মূল একাদশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও সপ্তাহে বেতন পান ৯০ হাজার পাউন্ড (প্রায় এক কোটি টাকা)। পার্থক্যটা নিজেই হিসাব করে নিন!

বেতন-বৈষম্যের এই সমস্যাটা যে শুধু রিয়াল বা বার্সার মতো ক্লাবগুলোতেই আছে, তা কিন্তু নয়; ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দিকেই তাকিয়ে দেখুন একটু।

গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ, এই মৌসুমের শুরুতে ক্লাব বিশ্বকাপ ও উয়েফা সুপার কাপ জেতা লিভারপুল এবার লিগ জয়ের ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। ৩০ বছর পর লিগ শিরোপা জয়ের আনন্দ করবেন লিভারপুল সমর্থকেরা, কিছুদিন পর। এত সব শিরোপা জয়ের অন্যতম মূল কারণ, কার্যকরী আক্রমণভাগ। যা সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন তিন তারকা—সাদিও মানে, মোহাম্মদ সালাহ ও রবার্তো ফিরমিনো। এই তিনজনের বেতন কত জানেন? সালাহর সাপ্তাহিক বেতন হ্যাজার্ডের অর্ধেক (দুই লাখ পাউন্ড বা ২ কোটি ২২ লাখ টাকা), ফিরমিনো প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন বেলের অর্ধেক (এক লাখ ৮০ হাজার পাউন্ড বা ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা)। ওদিকে মানে পাচ্ছেন সপ্তাহে মাত্র ৯০ হাজার পাউন্ড, যা কাসেমিরোর সমান।

প্রিমিয়ার লিগের দিকে তাকালে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে সাদিও মানের চেয়ে বেশি বেতন পাওয়া উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় রয়েছেন—অলিভিয়ের জিরু (চেলসি, ১ লাখ ১০ হাজার পাউন্ড), বার্নার্ড (এভারটন, ১ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড), ক্রিস্টিয়ান বেনটেকে (ক্রিস্টাল প্যালেস, ১ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড), ক্রিস্টিয়ান পুলিসিক (চেলসি, ১ লাখ ৩২ হাজার পাউন্ড), হুয়ান মাতা (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ১ লাখ ৬০ লাখ পাউন্ড) প্রমুখ। তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্লাবের মূল একাদশের খেলোয়াড় নন। ওদিকে নিয়মিত না খেলেও বার্সেলোনার ওসমানে দেমবেলে পকেটে পুরছেন ২ লাখ ১০ হাজার পাউন্ডের মতো।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পল পগবার কথাই ধরুন। লিগের সবচেয়ে বেশি বেতনভোগী খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম এই তারকা প্রতি সপ্তাহে পকেটে পুরছেন ২ লাখ ৯০ হাজার পাউন্ড (৩ কোটি ২২ লাখ টাকা প্রায়)। অথচ চোটে পড়ে ও ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে এই মৌসুমে লিগে খেলতে নেমেছেনই সাকল্যে পাঁচবার। যেখানে এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগে ক্লাবগুলো ২৯টি করে ম্যাচ খেলে ফেলেছে, সেখানে পগবাকে দেখা গেছে মাত্র পাঁচবার। মেরেকেটে মাঠে থেকেছেন ৫২১ মিনিটের মতো। কিন্তু তাতে কী! বেতন নিতে তো আর সমস্যা নেই!

অথচ লিগের অনেক নিয়মিত মুখ ও নিজ নিজ ক্লাবের অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় পগবার চেয়ে কয়েক গুন কম বেতন পাচ্ছেন। লিভারপুলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন পাচ্ছেন অর্ধেকেরও কম, (১ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড বা ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা প্রায়)। আর্সেনালের নতুন কোচ মিকেল আরতেতার অধীনে নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়া দলটির সাবেক অধিনায়ক গ্রানিত শাকা পাচ্ছেন পগবার তিন ভাগের এক ভাগ বেতন (১ লাখ পাউন্ড বা প্রায় এক কোটি ১১ লাখ টাকা)। একই অবস্থা চেলসির মাতেও কোভাচিচেরও। পেপ গার্দিওলার মিডফিল্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ফার্নান্দিনহো পান এক লাখ ৫০ পাউন্ডের মতো, অর্থাৎ পগবার প্রায় অর্ধেক। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির দ্বৈরথে বাধ সেধে ব্যালন ডি অর জেতা লুকা মদরিচের বেতন জানেন কত? ১ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ড!

এত বছর ধরে রিয়াল মাদ্রিদে খেলার পরেও করিম বেনজেমা ও মার্সেলোর মতো খেলোয়াড়েরা ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডের চেয়ে বেশি বেতন বাড়াতে পারেননি। ওদিকে বার্সেলোনার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংয়ের অবস্থা দেখুন, এক মৌসুম আয়াক্সের হয়ে আলো ছড়িয়ে বার্সায় যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বেতন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৬ হাজার পাউন্ডে (৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা)!

এই মৌসুমেই সান্তোস থেকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়েছেন ব্রাজিলের ১৯ বছর বয়সী উইঙ্গার রদ্রিগো গোয়েস। মূল একাদশে মাঝে মধ্যে সুযোগ পেলেও রদ্রিগোকে এখন মূলত দেখা যায় রিয়ালের বয়সভিত্তিক দলগুলোতেই। বয়সভিত্তিক দলে খেলা সেই রদ্রিগোকে ধরে রাখার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৬৬ হাজার পাউন্ড করে গুনছে রিয়াল। প্রায় একই অবস্থা রিয়ালের আরেক ব্রাজিলিয়ান তরুণ ভিনিসিয়ুসেরও। ৪০ হাজার ইউরো করে পাচ্ছেন তিনি। অথচ মূল দলে নিয়মিত খেলা অনেক তারকাই এই দুজনের চেয়ে কম পাচ্ছেন। কে কে তারা? ক্লেমঁ লংলে (বার্সেলোনা, ৪৫ হাজার পাউন্ড), জেমস ম্যাডিসন (লেস্টার সিটি, ৫৫ হাজার পাউন্ড), ট্যামি অ্যাব্রাহাম (চেলসি, ৫০ হাজার পাউন্ড), অ্যান্ডি রবার্টসন (লিভারপুল, ৫০ হাজার পাউন্ড), রাউল হিমেনেজ (উলভস, ৪১ হাজার পাউন্ড), ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আরনল্ড (লিভারপুল, ৪০ হাজার পাউন্ড)।

প্রতি সপ্তাহে ২ লাখ ৩০ পাউন্ড করে পাচ্ছেন জুভেন্টাসের তরুণ ডিফেন্ডার ম্যাথিস ডি লিট। যা লিভারপুলের ভার্জিল ফন ডাইক (১ লাখ ৬৫ হাজার পাউন্ড) বা রিয়াল মাদ্রিদের সার্জিও রামোসদের (২ লাখ পাউন্ড) চেয়েও বেশি! অন্যান্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম।

গতকালের একটা ঘটনার কথাই ধরুন। তাহিত চংকে চেনেন? না চিনলে আপনাকে শূলে চড়ানো হবে না, নিশ্চিত থাকুন। না চেনারই কথা। ডাচ্‌ এই তরুণ বেশ কয়েক বছর ধরেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একাডেমিতে খেলছেন। মূল দলে আসি আসি করে শেষ মুহূর্তে আসতে পারছেন না। এ পর্যন্ত লিগে মূল দলের হয়ে তিন ম্যাচে সাকল্যে ৩৪ মিনিট খেলেছেন। তাঁর সঙ্গে গতকাল চুক্তি নবায়ন করেছেন ইউনাইটেড, দিয়েছে সাপ্তাহিক ৩০ হাজার পাউন্ডের চুক্তি, যা লিভারপুলের চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী ডিফেন্ডার জো গোমেজের চেয়েও বেশি (২৮ হাজার পাউন্ড)। প্রিমিয়ার লিগে এ মৌসুমে আলো ছড়ানো টড ক্যান্টওয়েল (নরউইচ), জন ম্যাকগিন ও টায়রন মিংস (অ্যাস্টন ভিলা), ওলেকসান্দার জিনচেঙ্কো (ম্যানচেস্টার সিটি)। এই মৌসুমে এই পর্যন্ত ১৩ লিগ গোল করা এভারটনের ডমিনিক কালভার্ট-লুইন গোল প্রতি সপ্তাহে পান মাত্র ২০ হাজার পাউন্ড!

ইউরোপীয় ফুটবলের বেতন-বৈষম্যটা কতটা প্রকট, বুঝতে পারছেন তো?