ঢাকায় মেসির বন্ধুর গড়াগড়ি এবং...

এক চোখ ঢেকে, মুষ্টিবদ্ধ আরেক হাত উঁচিয়ে ধরেই সব সময় গোল উদ্‌যাপন করেন হার্নান বার্কোস (বাঁ থেকে তৃতীয়)। তাঁর ভঙ্গিটা কাল নকল করে নিয়েছেন বসুন্ধরা সতীর্থরাও। ছবি: প্রথম আলো।
এক চোখ ঢেকে, মুষ্টিবদ্ধ আরেক হাত উঁচিয়ে ধরেই সব সময় গোল উদ্‌যাপন করেন হার্নান বার্কোস (বাঁ থেকে তৃতীয়)। তাঁর ভঙ্গিটা কাল নকল করে নিয়েছেন বসুন্ধরা সতীর্থরাও। ছবি: প্রথম আলো।
>এএফসি কাপে টিসি স্পোর্টসের বিপক্ষে ৫-১ গোলের জয়ের ম্যাচে ৪ গোল করেছেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার হার্নান বার্কোস।

‘ওই দেখো ঢাকায় মেসির বন্ধু গড়াগড়ি খায়।’

বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পাস দিতে গিয়েই আছড়ে পড়লেন মাঠে। ম্যাচ তখন মাত্রই শুরু হয়েছে। তাঁর ওভাবে আছড়ে পড়া দেখে প্রেসবক্সে একজন বলে উঠলেন কথাটা।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে কথাটা হার্নান বার্কোসের কানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার যে ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় এসে গড়াগড়ি খাওয়ার জন্য বাংলাদেশের অসমতল মাঠকে বেছে নেননি, মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন। বসুন্ধরা কিংসে এলেও লিগের প্রথম পর্বে নিবন্ধন করাতে না পারায় এত দিন মাঠে নামা হয়নি তাঁর, পরশু এএফসি কাপে মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলে অভিষেক বার্কোসের।

তাতে ‘মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া’ শুরুটা যদি হয় প্রাথমিক চেনা-জানা, সেই স্মৃতির জায়গা কিছুক্ষণ পরই দখল করে নিয়েছে একের পর এক গোল উদ্‌যাপনের ছবি। বসুন্ধরার জন্য আনন্দ বার্তা হয়ে প্রভাত এ বেলায় আর দিনের আভাষ হয়ে আসেনি। এএফসি কাপে এটি অভিষেক ম্যাচ ছিল গত মৌসুমে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে এসেই লিগ শিরোপা জেতা বসুন্ধরারও। তাতে দল পেয়েছে ৫-১ গোলের জয়, আর সেটি কালই অভিষিক্ত বার্কোসের সৌজন্যেই। চার গোল দিয়ে ঢাকার মাঠে নিজের আগমনী গান শোনালেন বার্কোস।

আর্জেন্টিনার সাবেক স্ট্রাইকার ও মেসির জাতীয় দলের সাবেক সতীর্থ—বাংলাদেশের সঙ্গে বার্কোসের পরিচয়ের শুরু এভাবেই। তাঁকে দলে টেনে একটা চমকই উপহার দিয়েছিল বসুন্ধরা। তবে মেসির সতীর্থ এই পরিচয়ের পাশে তাঁর ৩৫ বছর বয়সটা অনেক শঙ্কাও জাগিয়ে দিচ্ছিল।

কিন্তু এই বয়সেও কী করা যায় তা অন্তত এই এক ম্যাচে বার্কোস বেশ ভালোই দেখিয়েছেন। কিছুটা বুঝিয়ে দিলেন, মাসিক ২০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭ লাখ টাকা) মাইনে দিয়ে তাঁকে কেন বাংলাদেশে আনার দু:সাহস দেখিয়েছে বসুন্ধরা। ম্যাচে তাঁর ফিনিশিং, গোলপোস্টের সামনে তাঁর স্থিরতা বুঝিয়েছে, ২০১২ সালে মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে খেলার সুযোগটা এমনি এমনিই পাননি তিনি। সে সময়ের আর্জেন্টিনা কোচ আলসান্দ্রো সাবেলা এমনি এমনিই সেদিন ব্রাজিলের বিপক্ষে ‘ক্লাসিকো’তে নামিয়ে দেননি তাঁকে।

মাঠের ২২ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে আলাদা করে চেনা গেছে তাঁকে। সেটি শুধু প্রায় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার কারণে নয়, ফুটবল শৈলীও অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রেখেছে তাঁকে।

স্ট্রাইকার চেনা যায় ডি বক্সে—কথাটি ফুটবলে আপ্তবাক্য। ম্যাচের আগের দিন মঙ্গলবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুশীলনে জাত বোঝাচ্ছিলেন বার্কোস। সতীর্থদের পা থেকে আসা বল প্রথম স্পর্শেই জড়িয়ে দিচ্ছিলেন জালে। দুই উইং থেকে বাতাসে ভাসা ক্রসে নেওয়া একের পর এক ভলি আর হেডের ঠিকানা লেখা ছিল পোস্টে।

ফুটবলাররা অনুশীলনে যা করতে পারেন, ম্যাচে তাঁর অর্ধেক করে দেখাতে পারলেই ‘লেটার মার্কস’ দেওয়া যায় অনায়াসে। কাল বার্কোস যেন অর্ধেকের বেশিই করেছেন। ফল, স্কোর বোর্ডে নামের পাশে ৪ গোল। প্রথমার্ধে বক্সের মধ্যে তিনটি বল পেয়ে গোলে পরিণত করেছেন দুটিকে ( ১৮ ও ২৬ মিনিট)। দুটি গোলই উইং থেকে ভেসে আসা বল হেডে জালে জড়িয়ে। দ্বিতীয়ার্ধে আরও দুই গোল করতেও খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। ৬৮ মিনিটে হ্যাটট্রিক করেছেন পেনাল্টি থেকে, আর ম্যাচের শেষ মুহূর্তে চতুর্থ গোলটি থ্রু ধরে ঠান্ডা মাথায় গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে তুলে দিয়ে। শেষ গোলটি বুঝিয়ে গেল, পায়ের সঙ্গে তাঁর মাথায়ও ফুটবলটা সমানভাবেই চলে।

ম্যাচটার মীমাংসা যে করে দিয়েছেন বার্কোসই, তা ম্যাচ শেষে বলেছেন দুই কোচই। বার্কোসের নাম বলার সময় প্রতিপক্ষ কোচের মুখ কালো থাকলেও বসুন্ধরা কোচ অস্কারের মুখে ছিল এক হাজার ভোল্টের আলো, ‘ও বিশ্বমানের খেলোয়াড়। ওর আজকের (কাল) পারফরমেন্স ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ আমার জানা নেই।’

ইতিমধ্যে বার্কোসের জাদুতে মোহিত ঢাকার ফুটবল। ফুটবলার-সমর্থক-কর্মকর্তারাও মোহিত। প্রতিটি গোলের পর জলদস্যুর ভঙ্গিতে এক হাতে চোখ ঢেকে অন্য হাত ওপরে তুলে উদ্‌যাপন করেন বার্কোস। যে কারণে তাঁকে ‘এল পারাটা’ ডাকা হয়, স্প্যানিশ শব্দটার বাংলা অর্থ—জলদস্যু। গতকাল ম্যাচের শেষে বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ইমরুল হাসানের সঙ্গে সমর্থকদেরও এই ভঙ্গিতে ছবি তুলতে দেখা গেল।

বোঝা গেল, এক জলদস্যু ঢাকায় এসেই ফুটবলপ্রেমী মনের দখল নিতে শুরু করেছেন।