পেলে কি সত্যিই যুদ্ধ থামিয়েছিলেন?

সান্তোসের জার্সিতে পেলে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৯৬৯ সালে। ছবি: সংগৃহীত
সান্তোসের জার্সিতে পেলে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৯৬৯ সালে। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ায় সত্যিই গৃহযুদ্ধ থামিয়েছিলেন পেলে?

তিনি অনেকের মতেই সর্বকালের সেরা ফুটবলার। এমন সব অর্জন আছে যা যুক্তিকে হার মানায়। কিংবা আর কখনো সেসব কীর্তির পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। যেমন ধরুন তিনবার বিশ্বকাপ জয়। পেলের এই কীর্তি ছুঁতে পারেনি আর কোনো ফুটবলার। অথবা পেশাদার ফুটবলে ১ হাজার গোল। যদিও পেলের এই হাজার গোল নিয়ে হাজার প্রশ্নও আছে।

ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি তবু ‘ও রেই’—রাজা! ক্যারিয়ারকে উত্তুঙ্গ উচ্চতায় তুলে তারপর ফুটবল ছেড়েছেন। শুধু শিরোপাজয় নয় পেলেকে নিয়ে অনেক ‌‘মিথ’-ও আছে। যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার গল্প তার মধ্যে একটি। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বের আনাচে-কানাচে ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে সে গল্প। ঐতিহাসিকেরা অবশ্য এখনো প্রশ্ন করে চলছেন, কালোমানিক কি সত্যিই যুদ্ধ থামিয়েছিলেন?

১৯৬৯ সাল। সান্তোস তখন বিশ্ব সফরে। তার আগের সময়টা একটু জেনে নেওয়া যাক।

লাতিন আমেরিকান ফুটবলে তখন সান্তোসের রাজত্ব। ব্রাজিলিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে টানা পাঁচবার,দুটি কোপা লিবার্তোদোরেস, বেনফিকা ও মিলানকে হারিয়ে দুটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও জিতেছিল সান্তোস। এরপর ঘরোয়া কিংবা মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় সান্তোসের কেমন যেন অরুচি এসে গেল। কোপা লিবার্তোদোরেস না খেলে বিশ্ব সফরে বের হতে শুরু করল সান্তোস। টাকা কামাইয়ের পুঁজি হিসেবে পেলের মতো অবিশ্বাস্য প্রতিভা তো ছিলেনই।

অন্য তারকারাও ছিলেন। সবাইকে নিয়ে ঠাসা সূচিতে কয়েক দফা নানা দেশে ফুটবল খেলেছে সান্তোস।শুধু ১৯৫৯ সালেই মাত্র ২২ দিনের ব্যবধানে ইউরোপে নয়টি দেশে ১৫টি ম্যাচ খেলেছিল ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটি। আন্দ্রেস ক্যাম্পমারের বই ‌‘গোলাজো’তে পেলে নিজেই বলেছিলেন, ‘মনে আছে ১৯৬০ সালে সান্তোসের হয়ে আমি একাই ১০৯ ম্যাচ খেলেছি। সে বছর কোনো বিরতি ছিল না।’

পরোক্ষ সায় ছিল ব্রাজিলিয়ান সরকারেরও। ১৯৬১ সালে তাঁকে‌ ‘জাতীয় সম্পদ’ ঘোষণা করা হয়েছিল। বিদেশি ক্লাবে বেচতে নিষেধ করা হয়েছিল। এতে পেলেকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে টাকা কামাইয়ের সুযোগটা পেয়ে যায় সান্তোস।

এভাবে ১৯৬৯ সালে আফ্রিকা সফরে বের হয় সান্তোস। এর দুই বছর আগেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয় নাইজেরিয়ায়। দেশটির পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদের লক্ষ্যে ‌এক জোট হয়ে ‘বায়াফ্রা’ রাষ্ট্র গঠন করেছিল। এই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল ২০ লাখেরই বেশি সাধারণ মানুষ। ঘরছাড়া হয় আরও ৪৫ লাখ।

এই যুদ্ধের মাঝেই নাইজেরিয়ায় নেমেছিল সান্তোস ফুটবল দল। লাগোসে ২৬ জানুয়ারি একটি ম্যাচ খেলার কথা ছিল তাদের। কিংবদন্তি বলে, সান্তোস দল পা রাখার পর বন্দুকের গর্জন থেমে গিয়েছিল। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি রাখে দুই পক্ষ। এর মধ্যে প্রীতি ম্যাচে নাইজেরিয়ার সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে সান্তোস। জোড়া গোল করেছিলেন পেলে। দর্শকদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন উঠে দাঁড়িয়ে সম্মাননা।

তবে অন্য কিছু সূত্রের দাবি, এই যুদ্ধবিরতি হয়েছিল প্রীতি ম্যাচের দুই সপ্তাহ পর বেনিনে। তখনকার বায়াফ্রা রাষ্ট্রের সীমান্ত অঞ্চলে।

কিন্তু সান্তোসের অফিশিয়াল সাইটে দাবি করা হয়, ওই অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক স্যামুয়েল ওগবেমুদিয়া স্থানীয়ভাবে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। খুলে দিয়েছিলেন বেনিনের সঙ্গে বায়াফ্রার সংযোগ সেতু। এতে দুই অঞ্চলের প্রায় ২৫ হাজার ফুটবলপ্রেমীর সামনে খেলা হয়েছিল এই প্রীতি ম্যাচ।

পেলের দলীয় সতীর্থ গিলমার ও কুতিনহোর ভাষ্য, যুদ্ধবিরতি খুব সময় টিকেছিল। সান্তোসের বিমান উড়াল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার যুদ্ধ শুরু হয়। বিমান থেকেই অস্ত্রের গর্জন শুনতে পেয়েছিলেন তারা। সান্তোস কিংবদন্তি লিমার ভাষ্য,‌ ‘যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়া আমাদের দাপটের পক্ষে একটি অর্জন। আমরা বলতে পারতাম, চারপাশে তো যুদ্ধ, ওখানে যাব কেন? কিন্তু আমরা তা করিনি।সেখানে যেতে চেয়েছি, খেলাটা বাধ্যতামূলক ছিল না।’

২০০৫ সালে টাইম ম্যাগাজিন এ নিয়ে লিখেছিল,‌ ‘বড় বড় কূটনীতিবিদরা দুই বছর চেষ্টা করেও আফ্রিকার ভয়ংকরতম এই রক্তপাত থামাতে পারেননি। কিন্তু ১৯৬৯ সালে নাইজেরিয়ায় ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে পা রাখার পর তিন দিনের জন্য যুদ্ধ থেমেছিল।’

কিন্তু পেলের এই যুদ্ধ থামানোর গল্প নিয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকেছেন নাইজেরিয়ান ব্লগার ওলাজো আয়েগবাও। সান্তোসের সফরে আসার সে সময়ের সংবাদপত্র ঘেঁটে আয়েগবাও দেখেছেন, যুদ্ধবিরতির কথা কোথাও লেখা হয়নি। বেনিনের সেতু খুলে দেওয়া হয়েছিল।তবে এটি সান্তোস আসার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এটা ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

পেলে নিজেও এ নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলেছেন। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন, ‘আমরা লাগোসে থাকাকালীন বায়াফ্রানরা যে সেখানে আক্রমণ করবে না তা নিশ্চিত করেছিল নাইজেরিয়ানরা।’ এর পর অবশ্য নানা সাক্ষাৎকারে একই গল্পকে ‌‘রোমান্টিক ইমেজ’ দিয়েছেন পেলে। অবশ্য প্রায় পঞ্চাশ বছর পর এসব স্মৃতি তাঁর পরিষ্কার মনে থাকারও কথা না। এমনও হতে পারে এই যুদ্ধ বিরতির ঘটনা অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো সময়ে?

১৯৬৭ সালে কঙ্গো ও গ্যাবনে প্রীতি ম্যাচ খেলেছে সান্তোস। ২০১২ সালে গ্যাবনে ফিরে পেলে বলেছিলেন, ‘ওরা বলেছিল আমরা এখানে আসতে পারব না। কারণ যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আমরা এখানে (লিব্রেভিল) খেলেছি, আর কিনশাসাতেও খেলেছি। তখন আলী বঙ্গ (গ্যাবন) ছিলেন প্রেসিডেন্ট এবং তিনি বলেছিলেন , যুদ্ধ থামাতে হবে। কারণ সবাই পেলের খেলা দেখবে। তারা যুদ্ধ থামিয়েছিল। আমরা খেলে চলে যাই। এটা ছিল অসাধারণ স্মৃতি। কখনো ভুলব না।’

অর্ধশতাব্দী পর সান্তোসের সেই বিখ্যাত সফরে এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে খোলনলচে জানার সুযোগ নেই। বোঝার উপায় নেই, সান্তোস আফ্রিকাতে টাকা কামানোর সঙ্গে মানবিক উদ্দেশ নিয়েও গিয়েছিল কি না? গল্পটা পরে বানানো হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তরুণ ফুটবলারদের নিংড়ে টাকা কামাইয়ের বিষয়টি যৌক্তিক করতেই এই গল্প ফাঁদা হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

জবাব ইতিহাসের পাথরচাপা কুঠুরিতে।