মেসির বিশ্বকাপ না জেতা ফুটবলের অবিচার

লিওনেল মেসি। এএফপি ফাইল ছবি
লিওনেল মেসি। এএফপি ফাইল ছবি
>কী সেই স্বর্ণ শীর্ষবিন্দু, যেটা মেসির সোনালি ক্যারিয়ারে নেই? এটা এখন আর না বললেও চলে, মেসির ক্যারিয়ারের একমাত্র অপূর্ণতা যে বিশ্বকাপ না-জেতা, সেটা সবারই জানা। তবু বারবার চলে আসে সেই প্রসঙ্গ।

অনিন্দ্যসুন্দর জন্মদিনের কেকের ওপর চেরি ফলটা না থাকলে কেমন হয়! সৌন্দর্যটা যেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। লিওনেল মেসির সোনায় মোড়ানো ক্যারিয়ারটাও ঠিক যেন সে রকম—চেরি ফলবিহীন জন্মদিনের দুর্দান্ত সুন্দর কেক! সোনা দিয়ে তৈরি মুকুটটিতে যে একটা স্বর্ণ শীর্ষবিন্দু থাকবে, সেটাই নেই।

কী সেই স্বর্ণ শীর্ষবিন্দু, যেটা মেসির সোনালি ক্যারিয়ারে নেই? এটা এখন আর না বললেও চলে, মেসির ক্যারিয়ারের একমাত্র অপূর্ণতা যে বিশ্বকাপ না-জেতা, সেটা সবারই জানা। তবু বারবার চলে আসে সেই প্রসঙ্গ। আরেকটি বিশ্বকাপ প্রায় কাছে চলে এসেছে, কাতারে ২০২২ সালের এই বিশ্বকাপই হয়তো মেসির ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। এর আগে তো মেসির বিশ্বকাপ না-জেতার আক্ষেপের গল্প মানুষের মুখে মুখে ঘুরবেই।

১৬ বছরের পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারে কী জেতা বাকি আছে মেসির? পেশাদার ফুটবলে পা রেখেছেন বার্সেলোনা দিয়ে, এখনো সেই একই ক্লাবে খেলছেন মেসি। এর মধ্যে জিতেছেন ১০টি লা লিগা শিরোপা। ইউরোপের ক্লাব ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় পরেছেন চারবার। ছোট-বড় মিলিয়ে বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন ৩০টি শিরোপা। কিন্তু যখনই মেসির ক্যারিয়ার নিয়ে কথা ওঠে, একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে, কী জিতেছেন আর্জেন্টিনার হয়ে?

২০০৫ সালের যুব বিশ্বকাপ আর ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকের সোনা, এই তো! সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার, সর্বকালের সেরাদের তালিকায়ও ওপরের দিকেই রাখতে হবে তাঁকে। শুধু আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জিততে পারেননি বলে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে একটি বিশ্বকাপ জিততে পারেননি বলে তাঁকে নিয়ে কত কথাই না বলে মানুষ! তাই ২০১৪ বিশ্বকাপ আর ২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকা—টানা তিনটি ফাইনাল হারার পর রাগে-দুঃখে-অভিমানে জাতীয় দলকে বিদায়ই বলে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার ‘ছোট্ট জাদুকর’।

বিশ্বজোড়া ভক্ত আর ফুটবলপ্রেমীদের অনুরোধে মেসি আবার আকাশি-সাদা জার্সিতে ফিরেছেন। ফিরেই দলকে ২০১৮ বিশ্বকাপে তুলতে রেখেছেন ভূমিকা। কিন্তু বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে আবার সেই হতাশার গল্প! ফ্রান্সের কাছে হেরে শেষ ষোলো থেকেই বিদায় মেসি আর তাঁর দলের। মেসিকে কি ভাগ্যও বঞ্চিত করেনি? ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালের কথাই ধরুন, জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হারা ম্যাচে গঞ্জালো হিগুয়েইন সহজ সুযোগ মিস না করলে গল্পটা অন্য রকমও হতে পারত! অথবা ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যাওয়ার পর মেসি নিজেও যদি মিস না করতেন!

২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকার গল্পটাও তো একই রকম। চিলির বিপক্ষে আর্জেন্টিনার দুটি ফাইনালই গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। ২০১৫ সালে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম শটে মেসি গোল পেলেও টানা দুই শটে গোল করতে পারেননি হিগুয়েইন ও বানেগা। ২০১৬-তে ভাগ্যের কী পরিহাস! মেসি নিজেই ব্যর্থ হয়েছেন গোল করতে।

ফুটবল বিশ্বে একটা কথা প্রচলিত আছে—ফুটবল দেবতা নাকি কারও পাওনা মেটাতে বিমুখ হন না! এই যেমন বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই অসাধারণ ফুটবল উপহার দিয়ে আসা স্পেনের প্রাপ্য মিটিয়েছেন ২০০৮ ইউরো, ২০১০ বিশ্বকাপ আর ২০১২ ইউরোর শিরোপা উপহার দিয়ে। ম্যারাডোনার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা দিয়েছেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মুকুট পরিয়ে।

এই ফুটবলেই আবার প্রাপ্য বাকি থেকে যাওয়ার গল্পও আছে। ইউসেবিও আর ইয়োহান ক্রুইফের কখনো বিশ্বকাপ না-জেতা তো তা-ই বলে। আবার ডি স্টেফানো বা জর্জ বেস্টের মতো ফুটবলারদের কখনো বিশ্বকাপ খেলতে না পারাটাকেই-বা কী বলবেন! এসব হিসাব টেনেই হয়তো ২০০৮ সালে অলিম্পিক সোনাজয়ী মেসির সাবেক সতীর্থ অস্কার উসতারি বলেছেন, ‘মেসির বিশ্বকাপ জিততে না পারা হবে ফুটবলের অবিচার। মেসির সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ করাটা বোকামি। জাতীয় দলে ওর সঙ্গে যা হচ্ছে (শিরোপা জিততে না পারা) তা নিয়ে আমি ওকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। কারণ, এসব ওর মতো একজনের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন।’

দেখা যাক কাতার বিশ্বকাপ মেসির ভাগ্যে কী লিখে রেখেছে। ফুটবল দেবতা কি মেসির প্রাপ্য মেটাবেন, নাকি আরও অনেক বঞ্চিতের মতো তাঁকেও বিশ্বমঞ্চ থেকে ফিরতে হবে শূন্য হাতে! চাপা একটা কান্না নিয়েই বিদায় বলতে হবে ফুটবল বিশ্বকে!