যে সিরিজে অস্ট্রেলীয়দের ওপর হামলা করেছিল ভারতীয় দর্শকেরা

গ্যালারিতে আগুন জ্বলছে, তবু খেলা চলছে। সংগৃহীত ছবি
গ্যালারিতে আগুন জ্বলছে, তবু খেলা চলছে। সংগৃহীত ছবি
>

ভারত-অস্ট্রেলিয়ার একটা টেস্ট সিরিজ কুখ্যাত দর্শক হাঙ্গামার জন্য। আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে গন্ডগোল তো হয়েছিল-ই। সেবার অস্ট্রেলিয়া দলের ওপরও হামলা চলেছিল।

সিরিজটা ইতিহাসে স্মরণীয় গোলযোগের কারণেই। ১৯৬৯-৭০ মৌসুমে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দল ভারত সফর করে। পাঁচ টেস্টের সিরিজ অস্ট্রেলিয়া ৩-১ ব্যবধানে জিতেছিল। কিন্তু মুম্বাইয়ের প্রথম টেস্টে আম্পায়ারের একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে যে তুলকালাম বেঁধেছিল সেটা ক্রিকেট ইতিহাসেরই এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে। ভাবলে অবাক লাগে, আজকের দিনে এ ধরনের ঘটনা যদি কোনো টেস্টের মধ্যে হতো, তাহলে সিরিজ তো দূরে থাক, সেই টেস্ট ম্যাচটিও শেষ হতো কিনা সন্দেহ।

স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে বড় বড় সাইজের পাথর পড়ছে মাঠে খেলোয়াড়দের আশপাশে, তারা খেলে চলেছেন; এটা আজকের দিনে অকল্পনীয় এক দৃশ্য। অথচ, ৫১ বছর আগে এমন পরিবেশেই শেষ হয়েছিল একটা টেস্ট, গোটা সিরিজ। মুম্বাইয়ে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে গোলযোগ বেঁধেছিল। কলকাতায় অস্ট্রেলীয় দলের টিম বাসেও হামলা হয়েছিল। টিকিট নিয়ে গোল বেঁধেছিল কলকাতায়। টিকিট নিয়ে দর্শকদের চাহিদা মেটাতে না পেরে বড় ফ্যাসাদে পড়তে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সে সময়ের ক্রীড়ামন্ত্রী রাম চ্যাটার্জিকে। দর্শকেরা তাঁর কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছিল। তিনি পালিয়েছিলেন পেছন দরজা দিয়ে। পরে খবর এসেছিল হাজার পাঁচেক টিকিটপ্রার্থী নাকি ঘিরে রেখেছে তাঁর বাড়িও। কলকাতাতেই টেস্টের আগে অস্ট্রেলিয়ার শেষ অনুশীলন সেশন পণ্ড গিয়েছিল হাজার দশেক কৌতূহলী দর্শকের ভিড়ে।

কী হয়েছিল মুম্বাইয়ে?

মুম্বাইয়ের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিরিজের প্রথম টেস্ট। টসে জিতে ব্যাটি করা ভারত গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জির দুর্ধর্ষ বোলিংয়ে ৪২ রানেই হারিয়ে ফেলে প্রথম তিন উইকেট। এরপর চতুর্থ উইকেটে অশোক মানকড় ও মনসুর আলী খান পতৌদির ১৪৬ রানের এক জুটিতে মোটামুটি ঘুরে দাঁড়ায় স্বাগতিকেরা। কিন্তু মানকড় ৭৪ আর পতৌদি ৯৫ রানে আউট হয়ে যান। ভারত এরপর বেশি দূর যেতে পারেনি। তারা তাদের শেষ ৬ উইকেট হারায় মাত্র ৩২ রানে। ম্যাকেঞ্জি ৬৯ রানে নেন ৫ উইকেট। অস্ট্রেলিয়া এর জবাবে কিথ স্টেকপোলের সেঞ্চুরি ও ইয়ান রেডপাথের ৭৭ রানে ৭৪ রানের লিড নেয়। ২১ রানে ৫ উইকেট হারিয়েও তাদের সংগ্রহ ছিল ৩৪৫। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে ভারত একপর্যায়ে ৮৯ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে বসে। এ সময় অজিত ওয়াদেকার ও শ্রীনিবাসন ভেঙ্কটরাঘবনের মধ্যে গড়ে ওঠা এক ছোট জুটি ভারতকে ১১৪/৭-এ নিয়ে গেলেও সমস্যা শুরু হয়।

খেলোয়াড়ি জীবনে একটু উল্টাপাল্টা শট খেলার জন্য কুখ্যাত ছিলেন ভেঙ্কটরাঘবন (পরবর্তীকালে ভারতের অধিনায়ক ও আইসিসির এলিট আম্পায়ার)। মুম্বাইয়ে সেদিন অ্যালান কনোলির বলে গায়ের যত শক্তি আছে তা দিয়ে ব্যাট ঘুরিয়েছিলেন ভেঙ্কট। ব্যাটে না লেগে বলটা সোজা চলে যায় উইকেটকিপার ব্রায়ান টেবারের হাতে। উইকেটকিপার হালকা একটা আপিল করেছিলেন বটে ,কিন্তু তিনিও নিজেও জানতেন ওটা আউট ছিল না। কিন্তু আম্পায়ার শম্ভু পান আঙুল দেন তুলে। ব্যাপারটা এতটাই আকস্মিক ছিল যে ভেঙ্কটও হাঁটা দেন। কিন্তু নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে দাঁড়ানো ওয়াদেকার জানতে চান, কীসের ভিত্তিতে আম্পায়ার আউটটি দিলেন। সিদ্ধান্তটি এতটাই ভুল ছিল যে অস্ট্রেলীয় উইকেটরক্ষকও ভেঙ্কটের কাছে স্বীকার করেছিলেন ভুলটি। রেডিও ধারাভাষ্যকার তো রীতিমতো চিৎকারই জুড়ে দিলেন—ভেঙ্কট মোটেও আউট নন। ব্যস, আর যায় কোথাও মুহূর্ত রণক্ষেত্রে ব্রাবোর্ন মাঠ। দর্শকেরা চাচ্ছিলেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বিল লরি যেন ভেঙ্কটকে মাঠে ডাকেন। কিন্তু লরি এ ব্যাপারে ছিলেন পুরোপুরি অনড়।

মাঠ ছাড়ার জন্য খেলোয়াড়দের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২০ মিনিটেরও বেশি। সংগৃহীত ছবি
মাঠ ছাড়ার জন্য খেলোয়াড়দের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২০ মিনিটেরও বেশি। সংগৃহীত ছবি

পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর খেলা আবারও শুরু হয়। অস্ট্রেলীয় দল আত্মবিশ্বাসী ছিল ম্যাচের ফল নিজেদের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু এ সময় অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের পায়ের কাছে বড় বড় ইটের ভাঙা অংশ পড়তে লাগল। ব্রাবোর্ন মাঠ এ সময় পুলিশ ঘিরে ফেলে। এর মধ্যেই খেলা আবার শুরু হয়। কিন্তু দর্শকদের হাঙ্গামার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের আশ্রয় নিতে হয় ড্রেসিং রুমে। কিন্তু সেখানেও রেহাই মেলেনি। চারদিক থেকে বড় বড় পাথর আর বোতলের ভাঙা অংশ এসে পড়তে থাকে অস্ট্রেলীয় দলের ড্রেসিং রুমে। ভারত ১২৫ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল চতুর্থ দিনের শেষে।

খেলাটা শেষ অবধি গড়িয়েছিল পঞ্চম দিনে। তার আগেই ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামের মালিক ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়া (সিসিআই) কিছু নিয়ম কানুন জারি করে। দর্শকদের শরীর তল্লাশি করা হয়। যেকোনো ধরনের বোতল নিষিদ্ধ করা হয় মাঠে। খেলতে নেমে ভারত অলআউট হয় ১৩৭ রানে। শেষ দিনেও ২০ হাজার দর্শক মাঠে এসেছিল। অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ছিল মাত্র ৬৪, সেটা ১ উইকেট হারিয়েই করে ফেলেছিল অস্ট্রেলিয়া। এই ম্যাচে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দর্শকদের উসকে দেওয়ার অভিযোগ বহিষ্কার করা হয়েছিল অল ইন্ডিয়া রেডিওর ধারাভাষ্যকার দেবরাজ পুরিকে।

মুম্বাইয়ের (তখন বোম্বে) প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জেতার পর কানপুরে দ্বিতীয় টেস্টটা ড্র হয়েছিল। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলার তৃতীয় টেস্টে ভারত জেতে ৭ উইকেটে। তবে কলকাতা ও চেন্নাইয়ের (তখন মাদ্রাজ) শেষ দুই টেস্টে জিতে অস্ট্রেলিয়া ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয়।

তবে এ সিরিজটা সবাই মনে রেখেছে মুম্বাই ও কলকাতার ঘটনাগুলোর জন্যই।