ইতিহাস কথা বলে যে স্টেডিয়ামে

লকডাউনে জনশূন্য ইতিহাসের সাক্ষী ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ছবি: শামসুল হক
লকডাউনে জনশূন্য ইতিহাসের সাক্ষী ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ছবি: শামসুল হক
>ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। খেলাধুলার ইতিহাস তো বটেই দেশের জন্মলগ্নের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেও মিশে আছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের নাম

প্রস্তাবটা প্রথম আসে সৌরভ গাঙ্গুলীর কাছ থেকেই। করোনা-আক্রমণে সারা দুনিয়াতেই বন্ধ হয়ে গেছে খেলাধুলা। অলস পড়ে রয়েছে বিভিন্ন স্টেডিয়ামসহ, নানা ক্রীড়া স্থাপনা। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি, ভারতের সাবেক অধিনায়ক তাই কলকাতার ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনকে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এখনো পর্যন্ত সে ধরনের জরুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলেও করোনার এই মহামারির সময় স্টেডিয়ামকে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করার ধারণাটা সমাদৃত হয়েছে দারুণভাবেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে করোনা-আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামসহ দেশের যেকোনো ক্রিকেট স্থাপনা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই তুলে দিতে চান তাঁরা। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসানও বলেছেন প্রয়োজনে দেশের সব স্টেডিয়ামকে করোনা-আক্রান্তদের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।

এ মুহূর্তে গোটা দুনিয়াই করোনা-মহামারির বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া এ মহামারি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই। উহানে আগেই করোনা-আক্রান্তদের জন্য বিভিন্ন স্টেডিয়াম ও ক্রীড়া স্থাপনায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থান করা হয়েছিল। এ মুহূর্তে ব্রাজিলের সাওপাওলোর পাকেয়াম্বু স্টেডিয়ামকে করোনা-আইসোলেশন সেন্টারে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ভারতের আসামের গুয়াহাটির ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়াম, তেলেঙ্গানার একটি স্টেডিয়ামও করোনা-আইসোলেশন সেন্টারে রূপ নিয়েছে। ক্রিকেটের ঐতিহাসিক মাঠ লর্ডসকেও করোনার এই সময়ে হাসপাতালে রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)।

ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে খেলার স্থাপনাকে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের নজির সারা দুনিয়াতেই আছে। বাংলাদেশেও এটি নতুন কিছু নয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ( সে সময়ের ঢাকা স্টেডিয়াম) ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্নভাবে। ১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকা স্টেডিয়াম পরিণত হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছাউনিতে। বিজয়ের দিনে মুক্তিবাহিনীর প্রথম দল হিসেবে ঢাকায় প্রবেশ করা দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে ও গ্যালারিতে সেনা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছিল মেজর (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) মঈনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে। স্বাধীনতার পরপর অগোছালো দেশে ঢাকা স্টেডিয়াম থেকেই আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও অফিসাররা।

২০০০ সালে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের দিন পাখির চোখে দেখা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ছবিটি তুলেছিলেন প্রথম আলোর বিশেষ আলোকচিত্রী শামসুল হক
২০০০ সালে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের দিন পাখির চোখে দেখা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ছবিটি তুলেছিলেন প্রথম আলোর বিশেষ আলোকচিত্রী শামসুল হক

জেনারেল মঈন ২০০০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ বইয়ে সেনা ক্যাম্প হিসেবে কেন ঢাকা স্টেডিয়ামকে বেছে নিয়েছিলেন তার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘আমি ঠিক করলাম আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামেই অবস্থান নেব। কারণ ঢাকা স্টেডিয়ামে সুরক্ষিত, আচ্ছাদিত এবং ৮০০ লোকের থাকাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদি এখানে বিদ্যমান।’ (পৃষ্ঠা-১৭)।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কেবল সেনা ক্যাম্পই স্থাপিত হয়নি, স্বাধীনতার প্রত্যুষে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও এখানে ঘটেছিল। এই স্টেডিয়ামের মাঠেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের পর মিত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদায়ী প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামের মাঠেই।

অনেক কিছুরই সাক্ষী এই মাঠ। ১৯৫৫ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামেই ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ‘হোম’ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছিল পাকিস্তান। তার ৪৫ বছর পর এ মাঠেই বাংলাদেশ খেলে অভিষেক টেস্ট, প্রতিপক্ষ ছিল সেই ভারতই। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বক্সিং—কী হয়নি এ মাঠে! দেশের ফুটবল ইতিহাসের বেশির ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচের সাক্ষী এ মাঠ। ক্রিকেটের বেড়ে ওঠার কালটা কেটেছে এ মাঠেই। ১৯৭৮ সালে এ মাঠেই ২৪ দেশকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯তম এশীয় যুব ফুটবলের জমজমাট আসর। ১৯৮৫, ১৯৯৩ আর ২০১০ সালের সাফ গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের পর ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর্দা উঠেছিল এ মাঠেই। সে বছরই লিওনেল মেসি, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, গঞ্জালো হিগুয়েইন, সার্জিও আগুয়েরো, হাভিয়ের মাচেরানো, ওবি ডি মিকেল, ভিনসেন্ট এনিমিয়ারা আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে মাতিয়েছিলেন এ স্টেডিয়ামের মাঠ। ২০০৬ সালে জিনেদিন জিদান হেঁটেছিলেন ঢাকা স্টেডিয়ামের ঘাসে। বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলীরও স্পর্শ ধন্য এ দেশের খেলাধুলার আঁতুড় ঘর।

এমন একটা মাঠ পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে দেশের জন্মলগ্নের ইতিহাস আর খেলাধুলার ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়েছে। করোনাভাইরাসের এ দুঃসময়ে এই মাঠ যদি আর্তের সাহায্যে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এর ইতিহাসই হবে সমৃদ্ধ। সুসময়-দুঃসময়, যা-ই বলি না কেন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ছাড়া বাংলাদেশের চলে নাকি!