একটিই ওষুধ, ঘরে থাকুন

সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। প্রথম আলো ফাইল ছবি

খুব কঠিন সময় পার করছি আমরা। করোনাভাইরাস যেন আমাদের সবকিছুই গ্রাস করে নিতে উদ্যত! আমার জীবদ্দশায় অন্তত আমি পৃথিবীর মানুষকে এ রকম সময়ের মুখোমুখি হতে দেখিনি। এর আগেও পৃথিবীতে বৈশ্বিক মহামারি এসেছে। কিন্তু তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এবার সেটা হচ্ছে।

এখন আমরা কী করব? করোনাভাইরাসের কাছে হেরে যাব! না, এর সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হবে এবং সেই লড়াইয়ে জিততে হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা, আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা আমাদেরই হাতে। আমাদের ওপরই নির্ভর করছে আমরা এটাকে কোথায় নিয়ে যাব। আমরা যদি সচেতন থাকি, তাহলে আমাদের অত বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে না। আর যদি সচেতন না হই, সেটার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। আমরা অনেকেই হয়তো এই মুহূর্তে তা উপলব্ধি করতে পারছি না।

চীন আমাদের সামনে খুব ভালো উদাহরণ। তাদের দেশেই কোভিড-১৯ রোগের শুরু, আবার তারাই পেরেছে এই মহামারিকে খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে। তবে এই উদাহরণ থেকে অনেক দেশই শিক্ষা নিতে পারেনি। তাদের সেটার মূল্য দিতে হচ্ছে। ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর দিকে তাকালেই সেটি বুঝতে পারবেন। চিকিৎসাব্যবস্থা বলেন, আর্থ-সামাজিক অবস্থা বলেন, সব দিক দিয়েই অনেক উন্নত দেশ তারা। জনসংখ্যার ঘনত্বও আমাদের মতো বেশি নয়। অথচ শুধু সময়মতো সচেতন না হওয়ায় তারা আজ এই ভাইরাসের কাছে পুরোপুরি পরাজিত।

আশার কথা, বাংলাদেশের অবস্থা সে তুলনায় এখন পর্যন্ত অনেক ভালো। আমরা চাই না তাদের অবস্থায় যেতে। সেটার একটাই ওষুধ—সচেতনতা। ঘরে থাকা। আমরা সবাই মিলে যদি সচেতন হই, জনসমাগম এড়িয়ে আরও কিছু দিন ধৈর্য্য ধরে ঘরে থাকি, তাহলে আমাদের দেশে এটা ওরকম মারাত্মক পর্যায়ে নাও যেতে পারে।

এটা ঠিক যে, দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকাটা অনেকের জন্যই কঠিন। কিন্তু অন্যভাবে যদি চিন্তা করেন, এই মুহুর্তে আমাদের ঘর থেকে বের হওয়ার খুব বেশি প্রয়োজনও নেই। সরকার সবার জন্য সেই ব্যবস্থাই করেছে। স্কুল-কলেজ ছুটি। অফিস-আদালতও বন্ধ।

হ্যাঁ, আড্ডা প্রিয় বাঙালী খুব বেশি ঘরে বসে থাকতে ভালোবাসে না। আমি নিজেও খুব আড্ডা প্রিয়। কাজ না থাকলেও দিনে অন্তত এক বেলা বাইরে যাওয়া আমার চাই। বিশ্বাস করুন, সেই আমি গত ৮-১০ দিন ধরে ঘরে। কারণ এটা সময়ের দাবি। অসুখটা আমার হলে তো শুধু আমার একারই হবে না, আমি আরও অনেককে সেটা দিব। পরিবারের সবাই আক্রান্ত হবে। কাজেই এই সময়ে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিজেকে পরিবর্তন করা। ঘরে থাকা। নিজেকে, অন্যকে এবং দেশকে ভালো রাখতে এটাই আপাতত সবচেয়ে জরুরী।

ঘরে থাকার এই সময়টা আমাদেরকে পরিবারের কাছে আসারও তো সুযোগ করে দিয়েছে! অন্য সময় হয়তো আমরা সন্তানদের অত বেশি সময় দিতে পারিনা, যেটা এখন দেওয়া যাচ্ছে। আর ঘরে থাকলে সময় কাটে না, তাও তো না! অনেক কিছুই করার আছে ঘরে। আমি নিজেই এমন অনেক কাজ করছি, যেটা আগে করিনি। ঘর ঝাড়– দেওয়া, ঘর মোছা, থালা-বাসন ধোয়া- সবই কাজেই হাত লাগচ্ছি এবং সেটা উপভোগও করছি।

পরিস্কার থাকা, নিয়মিত সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, আশপাশ পরিস্কার রাখা- করোনাভাইরাস ঠেকাতে এসবও করতে হচ্ছে। এগুলো করলেও দেখবেন ঘরে অকেকটা সময় কেটে যায়। আমরা যারা বাইরে বাইরে থাকি তারা হয়তো বুঝি না, তবে বাসায় করার মতো অনেক কাজই থাকে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে করোনাভাইরাস আমাদের দেশে খুব বেশি ছড়ায়নি। সেজন্য এই সময়ে এসে অনেকের ধারণা হওয়াটা স্বাভাবিক, সবকিছু বুঝি ঠিকঠাক হয়ে গেছে। বাস্তবে কিন্তু সেরকম নাও হতে পারে। সরকার যেহেতু ছুটি বাড়িয়েছে, সেটা বুঝেশুনেই বাড়িয়েছে। আমাদেরও তাই উচিত আরেকটু ধৈর্য্য ধরা। বিশেষ করে এপ্রিল মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ আমরা যেন ঘরে থাকি। দেখবেন, এই দুই সপ্তাহ আমাদের জীবনটাই বদলে দেবে।

আমার মতে এটাই আসল সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার। আমরা যেন ইটালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভুল না করি। ওইসব দেশে যখন রোগটা অত বেশি ছড়ায়নি, তারা সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সেটার চরম মূল্যই এখন দিচ্ছে তারা। আমাদেও দেশে যদি শঙ্কা না থাকতো তাহলে তো সরকারই আমাদের বলে দিত, আপনারা ঘর থেকে বের হোন। ছুটি বাতিল করে দিত।

সরকার যে সব বন্ধ করে রেখেছে, নিশ্চয়ই তার পেছনে কারণ আছে। আমাদের দেশে সংক্রমণের হার এখনও হয়তো কম। তার মানে কিন্তু এই নয় যে সংক্রমন বাড়ার শঙ্কা চলে গেছে। সেটা এখনও খুব ভালোভাবেই আছে। যদি আমরা চাই আমাদের দেশের পরিস্থিতি ইটালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভয়াবহ না হোক, তাহলে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই এই উপলব্ধি আসাটা জরুরী।

আবারও বলি, আমাদের নিজেদের ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যত। আমরা কি ভবিষ্যতের জন্য একটা ভালো উদাহরণ তৈরি করবো? আমরা কি বলতে পারবো যে, ওই সময়টাতে আমরা খুব ভালোভাবে সবকিছু সামাল দিতে পেরেছিলাম? যেটা করা দরকার ছিল সেটা করেছিলাম বলেই বাংলাদেশের অবস্থা বাকি দেশগুলোর মতো হয়নি। আমরাই আমাদেরকে বাঁচিয়েছিলাম। অথবা ইতিহাস অন্যরকমভাবেও লেখা হতে পারে, যেটা আমরা কেউই চাইবো না।

কাজেই বাসায় থাকুন। ঘরের কাজ করুন। তাতে সময়টা যেমন ভালো কাটবে, আমরাও পারবো আমাদের ইতিহাসটাকে সুন্দরভাবে লিখতে।

লেখক: জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে বিসিবির নির্বাচক কমিটির সদস্য।