'হোম অব ক্রিকেটের' অন্য ইতিহাস

ক্রিকেটের বাইরেও অনেক গল্প আছে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের। ছবি: শামসুল হক
ক্রিকেটের বাইরেও অনেক গল্প আছে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের। ছবি: শামসুল হক

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে ‘হোম অব ক্রিকেট’ হিসেবেই চেনে এ প্রজন্ম। ‘এ প্রজন্ম’ বলতে যাদের জন্ম ২০০০ সালের পর। তবে এ স্টেডিয়ামের আগের পরিচয়—২ নম্বর জাতীয় স্টেডিয়াম অথবা মিরপুর স্টেডিয়াম। জাতীয় নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নামটি এ স্টেডিয়ামের সঙ্গে ‘ট্যাগ’ হওয়াটা যেমন বেশি দিন আগের ঘটনা নয়, ‘হোম অব ক্রিকেট’ নামটিও কিন্তু খুব বেশি দিন আগে যোগ হয়নি স্টেডিয়ামটির পরিচয়ের সঙ্গে।

২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফুটবল ও ক্রিকেট ভাগাভাগি করে খেলা হলেও মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম ছিল পুরোই ফুটবলের দখলে। ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর ক্রিকেটের পক্ষে আর পিঠা ভাগের মতো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ভাগাভাগি করে খেলা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। সে কারণেই মিরপুর স্টেডিয়ামকে পুরোপুরি ক্রিকেটকে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবটা আসে। ২০০৫ সালের ১ মার্চ থেকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম হয়ে যায় পুরোপুরি ক্রিকেটের। আজকের বিসিবি কার্যালয়, ক্রিকেট একাডেমি, এর মাঠসহ অন্যান্য সব স্থাপনা ২০০৫ সালের পরই গড়ে ওঠে।

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম এখন সাকিব আল হাসানদের ঘরের উঠান। এ মাঠে ক্রিকেটের কত বীরত্বগাথা, কত নতুন ইতিহাস! এ মাঠেই টেস্টে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে বাংলাদেশ, এ মাঠেই ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দল আত্মসমর্পণ করে গেছে বাংলাদেশের কাছে। এসব আমরা সবাই-ই জানি। তবে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের অন্য ইতিহাসটাও কম রোমাঞ্চকর নয়।

এ প্রজন্ম কি জানে, এ মাঠেই একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল? আবাহনী-মোহামেডানের হৃদয় উত্তাল করা অনেক দ্বৈরথের মঞ্চ ছিল এ মাঠ? এ মাঠেই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই দেখতে এসে প্রাণহানির ঘটনা আছে? ক্রিকেটের গল্পগুলোকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে মিরপুর মাঠের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতিতে চোখ রাখাটা কিন্তু দারুণ এক অভিজ্ঞতাই হতে পারে নতুন প্রজন্মের খেলাপ্রেমীদের কাছে—

শুরুতেই ইতিহাস
১৯৮৮ সালে মিরপুর স্টেডিয়ামে প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল অষ্টম এশিয়ান ক্লাব কাপ ফুটবলের বাছাইপর্বের খেলা। মাঠটি তখন আনকোরা, ফ্লাডলাইট টাওয়ার বসলেও সেটি কার্যকর ছিল না। এশিয়ান ক্লাব কাপে (এখনকার এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগ) বাংলাদেশের লিগ শিরোপাধারী দল মোহামেডান খেলেছিল শ্রীলঙ্কার স্যান্ডার্স ক্লাব ও ইরানের পিরুজি ক্লাবের বিপক্ষে। স্যান্ডার্সের সঙ্গে ড্র করলেও মোহামেডান সেবার ২-১ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল পিরুজিকে। ইরানের ক্লাবটি তখন এশিয়ার অন্যতম সেরা ও শক্তিধর। পিরুজিকে হারিয়ে মিরপুর স্টেডিয়ামের শুরুর ইতিহাসটা দারুণভাবে রাঙিয়েছিল মোহামেডান।

প্রথম আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ
২০০৪ পর্যন্ত মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডানের অনেক ম্যাচই অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে প্রথম ম্যাচটা ছিল ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে, ফেডারেশন কাপের ফাইনাল। প্রথম আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে দর্শক সমাগম নিয়ে সংশয় ছিল সবার মধ্যে। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে সেদিন মিরপুর স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় ভরা। ফখরুল ইসলাম কামালের (এফআই কামাল) গোলে সে ম্যাচে মোহামেডানকে হারায় আবাহনী।

ফুটবল ম্যাচে প্রাণহানি
আশির দশকে মিরপুর এলাকা মূল ঢাকা থেকে একটু বিচ্ছিন্নই ছিল। এমন অবস্থা ছিল নব্বই দশকের শুরু দিকেও। মিরপুরে লিগের অনেক ম্যাচে গোলযোগ হয়েছে—এমন ঘটনা আছে। কোনো এক রহস্যজনক কারণে মোহামেডানের সমর্থকেরা মিরপুরে আসতে পছন্দ করতেন না। এর মূল কারণ অনেকেই বলেন মিরপুরের অধিবাসীদের মধ্যে আবাহনী সমর্থকদের আধিক্য। এমনকি মিরপুরের অবাঙালি অধিবাসীরাও আবাহনীকে সমর্থন করতেন। আজকের পাঠকদের কাছে ব্যাপারগুলো রূপকথার মতো মনে হলেও এগুলো সবই সত্যি। এ মাঠে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানেই হলো মাঠের বাইরেও দুই দলের সমর্থকদের লড়াই। বড় অঘটনটা ঘটে যায় ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে। ফেডারেশন কাপের ফাইনালে উচ্ছৃঙ্খল দর্শকদের ছুরির আঘাতে নিহত হয়েছিলেন এক তরুণ।

সবুজ দলের ভারত-বধ, লাল দলের শিরোপা
১৯৮৯ সালে হলো প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ। জমজমাট টুর্নামেন্টে ভারতের জাতীয় দলকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল তরুণ ও উঠতি ফুটবলারদের নিয়ে গড়া বাংলাদেশ সবুজ দল। অলোক মুখোপাধ্যায়-বিকাশ পাঁজি-কৃষাণু দে-সুদীপ চট্টোপাধ্যায়দের ভারতীয় দল তখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। বাংলাদেশ সবুজ দল ভারতকে হারিয়েই থেমে যায়নি, হারিয়ে দেয় সে সময়ে এশিয়ার অন্যতম সেরা ক্লাব চীনের লিয়াওলিং এফসিকেও। তবে বাজিমাতটা করে জাতীয় ফুটবল দলের মোড়কে বাংলাদেশ লাল দল। থাইল্যান্ড ও ইরান অনূর্ধ্ব-২৩ দলের সঙ্গে ড্র করে সেমিতে সবুজ দলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে তাঁরা টাইব্রেকারে হারিয়ে দেয় দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দলকে। কোরিয়ার দলটির নাম ‘বিশ্ববিদ্যাল দল’ হলেও সেটি ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সেরা উঠতি ফুটবলারদের নিয়ে গড়া। স্বাধীনতার পর ওটাই ছিল কোনো আমন্ত্রণমূলক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রথম শিরোপা জয়।

দ্রুততম মানব বিমল
১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমসে ফুটবল ও অ্যাথলেটিকসের ভেন্যু ছিল মিরপুর স্টেডিয়াম। গেমসের আগে এখানে বসে অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক। সেবার সাফে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে রেকর্ড গড়ে সোনা জেতেন বাংলাদেশের স্প্রিন্টার বিমল চন্দ্র তরফদার। মিরপুরের মাঠে এটি স্মরণীয় এক স্মৃতি হয়েই আছে এখনো।

মাত্র এ কয়টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ!
মিরপুর স্টেডিয়ামে খেলতে খুব আগ্রহী ছিল না ফুটবল। সে কারণেই হয়তো এ মাঠে ফিফা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচের সংখ্যা হাতে গোনা। এর মধ্যে বাংলাদেশ খেলেছে মাত্র চারটি ম্যাচ। ১৯৯৩ সালে ষষ্ঠ সাফ গেমসের ফুটবল এ মাঠে হলেও কয়েকটি ম্যাচ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। সেবার সাফের ফাইনাল হয়েছিল এ মাঠে (ভারত-নেপাল)। বাংলাদেশ দল মিরপুরে সবচেয়ে বেশি খেলেছে মিয়ানমারের বিপক্ষে—দুটি ম্যাচ। বাকি দুটির একটি মালদ্বীপ ও অন্যটি ছিল তাজিকিস্তানের বিপক্ষে। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে সাফ গেমসের আগে মিয়ানমার দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে আসে। দুটিতেই বাংলাদেশ জিতেছিল ৩-১ গোলে। সাফ গেমসে বাংলাদেশ গোলশূন্য ড্র করে মালদ্বীপের বিপক্ষে। তাজিকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটিতে হারে ২-০ গোলে।

ঈদের দিন ম্যাচ
এ মাঠে ফুটবলের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি ছিল ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ ও তাজিকিস্তানের মধ্যকার ম্যাচটি ফিফার দেওয়া যে তারিখে হয়েছিল, সেদিন ছিল ঈদুল ফিতর। ফিফার সময়সূচি তো মানতেই হবে। অগত্যা ঈদ ভুলে মাঠে নামতে হয়েছিল বাংলাদেশ দলকে।

আজকের হোম অব ক্রিকেটের ইতিহাসটা এ রকমই সাফল্য-ব্যর্থতা আর বৈচিত্র্যে ভরা। ক্রিকেট সেখানে শুধুই বর্তমান।