আকরাম খান সেদিন যদি ব্যর্থ হতেন...

>বাংলাদেশের ক্রিকেটে ইতিহাসের এমন একটা মুহূর্ত, এমন একটা দিন আমরা সবাই ভুলে গেলাম!
আকরাম খানের সেই ৬৭ রানের ইনিংসটির ওপরই দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ফাইল ছবি
আকরাম খানের সেই ৬৭ রানের ইনিংসটির ওপরই দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের এ আতঙ্কে আসলে আমাদের কারওরই মাথার ঠিক নেই। নয়তো দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এমন একটা তারিখ, এমন এক মুহূর্ত আমরা ভুলে গেলাম কীভাবে! কোনো একটি বিশেষ ইনিংস, বিশেষ একটি ম্যাচ যে একটি দেশের ক্রিকেট ইতিহাস গড়ে দিতে পারে, সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্যই। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পথ ঠিক করে দেওয়া এমন একটি ইনিংসেরই তারিখ ছিল গতকাল ৪ এপ্রিল। কিন্তু সেটি চলে গেছে নিভৃতেই।

১৯৯৭ সাল। আইসিসি ট্রফিতে খেলছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ-যাত্রার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সত্যিকার স্বপ্নটা তো আরও বড়, আমাদের টেস্ট খেলতে হবে। দুনিয়ার সব বড় বড় দলের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের একটা জায়গা করে নিতে হবে, হয়ে উঠতে হবে সমীহ জাগানিয়া এক দল। গত ২৩ বছরে আমরা বিশ্বকাপের স্বপ্ন পূরণ করেছি। টেস্ট মর্যাদা পেয়েছি, বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছি। কিন্তু এসবের কিছুই হতো না যদি আকরাম খান ৬৭ রানের একটা ইনিংস না খেলতেন। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে সীমাহীন চাপের মুখে দাঁড়িয়ে সাবেক অধিনায়কের খেলা সেই ইনিংসটিই এ দেশের ক্রিকেটের ইতিহাস গড়ে দেওয়া এক আখ্যান। কুয়ালালামপুর শহর থেকে একটু দূরে সুগোই বুলো নামের একটা জায়গায় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেই ইনিংসটি তিনি খেলেছিলেন ৪ এপ্রিল। এ দেশের ক্রিকেটের অতীত নিয়ে কিছু লিখতে গেলে বা বলতে গেলে, আকরামের সে ইনিংসটি যে আসবেই।

৯৭’র আইসিসি ট্রফির দ্বিতীয় রাউন্ডে সেদিন ছিল হল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা। দাপটের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে এ রাউন্ডের তৃতীয় ম্যাচে এসে বাংলাদেশ পড়ে যায় ‘বাঁচা মরার লড়াইয়ে’র গ্যাঁড়াকলে। হংকং ও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ছিল দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম দুই ম্যাচ। হংকংকে সহজেই হারালেও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিতে বৃষ্টির কারণে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হয় বাংলাদেশকে। অথচ, প্রথমে বোলিং করে আইরিশদের ১২৯ রানে গুঁড়িয়ে দিয়ে সে ম্যাচেও জয়ই দেখছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বৃষ্টির পর নানা অজুহাতে আইরিশরা খেলতে রাজি না হওয়ায় ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে দেওয়া হয়। সে কারণেই সেমিফাইনালে উঠতে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ম্যাচটি ছিল ‘ডু অর ডাই।’ ডাচদের সঙ্গে না জিতলে আবারও বিশ্বকাপের আশা শেষ হয়ে যাবে, জিতলে দল যাবে সেমিতে—সমীকরণটা ছিল এমনই।
নেদারল্যান্ডস সে ম্যাচে আগে ব্যাটিং করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বোলিংয়ের সামনে খুব সুবিধা করতে পারেনি। মাত্র ১৭১ রানেই শেষ হয় তাদের ইনিংস। ১৭২ করলেই সেমিফাইনাল। সেদিন সুগোই বুলোর রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গর্ডন গ্রিনিজের দলের মধ্যাহ্নভোজনটা মন্দ হয়নি। কিন্তু ইনিংস শুরু হতেই সেদিন মিলিয়ে গিয়েছিল সবার হাসি। তীব্র উৎকণ্ঠা পেয়ে বসেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। বেতারে দেশে বসে ধারাভাষ্য শুনছিলেন তাঁরা আরও একটি হতাশার ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার জন্য নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলেন। ১৫ রানেই যে সেদিন নেই হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ৪ উইকেট।

১৭২ রানের লক্ষ্যমাত্রাটা তখন অনেক দূরেরই মনে হচ্ছিল। আতহার আলী খান, নাঈমুর রহমান, সানোয়ার হোসেন আর আমিনুল ইসলাম ফিরে যাওয়ার পর বিরাট দায়িত্ব চাপে আকরাম খান আর মিনহাজুল আবেদীনের কাঁধে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ায় বিপাকে পড়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এ ম্যাচটা যেন বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়, গোটা বাংলাদেশের প্রার্থনা ছিল সেটিই। হারটা তো এড়ানো যাবে। ১ পয়েন্ট পেলে তাও আশা বেঁচে থাকত। হেরে গেলে যে সব শেষ। এদিকে ডাচ ক্রিকেটাররা দ্রুত ২০ ওভার শেষ করে দিতে চাচ্ছিল। ২০ ওভার হয়ে গেলে বৃষ্টি আইনে জয় হবে তাদেরই। বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান আকরাম আর মিনহাজুলের লক্ষ্য তখন যেভাবেই হোক, দেরি-টেরি করে, বৃষ্টি আসার সুযোগ করে দেওয়া।

আকরাম-মিনহাজুল দুজনই দেরি করছিলেন। একবার প্যাভিলিয়ন থেকে নতুন গ্লাভস চান, তো পর মুহূর্তেই ব্যাট। পানির তেষ্টাও খুব বেশিই যেন পাচ্ছিল তাদের সেদিন। আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারির কাছ সতর্কবার্তাও পেলেন। সময়ক্ষেপণে কাজ হয়েছিল। বৃষ্টি এসে খেলা গেল বন্ধ হয়ে। সবাই যেন কিছুটা হলেও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল।

কিন্তু একি! বৃষ্টি এক সময় থেমেও গেল। সে সময় ছোট হয়ে এলে লক্ষ্যমাত্রা। ৩৩ ওভারে ১৪১। লক্ষ্য কমলেও সে সময়ের প্রেক্ষাপটে কঠিনই ছিল সেটি। তখন তো আর টি-টোয়েন্টির যুগ নয়। এক সময়ে মিনহাজুল বিদায় নিলে পুরো দায়িত্বটা এসে পড়ে আকরামের কাঁধে। কিন্তু সেদিন কী যেন ভর করেছিল তাঁর ওপর। প্রচণ্ড চাপের মুখেও উইকেটের চারদিকে একের পর এক শট নিতে থাকলেন তিনি। কখনো কাভার ড্রাইভ, কখনো বোলারস ব্যাক ড্রাইভ। তবে এটা ঠিক পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে সেদিন কোনো শট খেলেননি আকরাম। বাংলাদেশের অধিনায়কের রুদ্রমূর্তি যেন ডাচ বোলারদেরও হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। নয়তো প্রথম দিকে দুর্দান্ত বোলিং করা ডাচরা হঠাৎ করেই যেন বোলিং করা ভুলে গিয়েছিলেন। আকরাম সেদিন শেষ পর্যন্ত উইকেটে ছিলেন। দলকে জিতিয়েই ফিরেছেন তিনি। মাঝখানে এনামুল হক (মণি), সাইফুল ইসলাম, খালেদ মাহমুদ আর মোহাম্মদ রফিক ছোট ছোট অথচ কার্যকর কয়েকটি ইনিংস খেলে সঙ্গ দিয়ে গেছেন অধিনায়ককে। ১৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলা, এরপর গুরুত্বপূর্ণ আরেক ব্যাটসম্যানের বিদায় (মিনহাজুল), কঠিন পরিস্থিতিতে আকরাম সেদিন যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, তা এক কথায় অনন্য। প্যাভিলিয়নে ফিরেই আবেগের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন দিয়েছিলেন। আবেগের কাছে সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিল গোটা দেশ। এক ইনিংসেই খাদের কীনারা থেকে উঠে আসে বাংলাদেশের ক্রিকেট। বাকিটা তো ইতিহাস।

কোনো সেঞ্চুরি নয়, একটা ৬৭ রানের ইনিংস। তাঁর ওপরই দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস। এ প্রজন্মের কাছে কল্পগল্পের মতো মনে হতে পারে—কিন্তু এটাই সত্যি। আজ ২৩ বছর পর দাঁড়িয়ে মনে হতে পারে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে একটা ৬৭ রানের ইনিংস! এটা আর এমন কি! কিন্তু একবার ভাবুন তো, আকরাম যদি সেদিন ব্যর্থ হতেন!