যে সন্তানেরা হেঁটেছে বাবা-মায়ের পথে

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার সঙ্গে দাবা খেলছে তাঁর ছেলে তাহসিন। ছবি: প্রথম আলো
গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার সঙ্গে দাবা খেলছে তাঁর ছেলে তাহসিন। ছবি: প্রথম আলো

বাবার সঙ্গে একই বোর্ডে বসে দাবা খেলছেন ছেলে। আবার মায়ের পাশাপাশি ছেলেও একই ট্র্যাকে সাইকেল চালাচ্ছেন। আবার মায়ের মতোই টেবিল টেনিস বোর্ড মাতিয়ে চলেছেন ছেলে। কিংবা শুটার মাকে দেখে ছেলে হাতে তুলে নিয়েছেন পিস্তল। ঘরোয়া ক্রীড়াঙ্গনে এমন দৃশ্য দেখা যায় না বললেই চলে। দেশের খেলাধুলার ব্যতিক্রমী এই গল্পটা শুনুন...

গ্র্যান্ডমাস্টার বাবার পথে তাহসিন
গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান নিজেকে বেশ ভাগ্যবানই ভাবেন। ঘরের মধ্যে এমন অনুশীলন সঙ্গী আর কেই বা এভাবে পেয়েছেন? দাবার বোর্ডে বাবা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ছেলে তাহসিন তাজওয়ারের লড়াইটা এখন চিরায়ত এক দৃশ্য। ১৪ বছর বয়সী তাহসিন এরই মধ্যে বাবার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। জাতীয় যুব গেমসে হয়েছে রানার আপ। দুবার অংশ নিয়েছে জাতীয় দাবায়। এর মধ্যে পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় দাবায় হয়েছে নবম। আরেকবার হয়েছে সপ্তম। ভারতে মুম্বাই ওপেনের বয়সভিত্তিক ক্যাটাগরিতে হয়েছে তৃতীয়। প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় দাবা, আন্তর্জাতিক ও রেটিং টুর্নামেন্ট মিলিয়ে বাবার সঙ্গে এ পর্যন্ত খেলেছে ছয়বার। এর মধ্যে পাঁচবার ড্র করেছে, একবার হেরেছে তাহসিন। রাজধানীর সেন্ট যোসেফ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রের মাঝে অমিত সম্ভাবনা দেখেন বাবা, ‘নিজের ছেলে বলে বলছি না, ওর মধ্যে অনেক সম্ভাবনা। ও আমার খেলার বড় সমালোচক। ওর বয়সে আমি এতটা ভালো খেলিনি। আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছি। ওকে সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে দেখতে চাই।’ বাবার মতো মা তাহসিন সুলতানা লাবণ্যও দাবা খেলেন। দাবা খেলেই সংসার চলে জিয়ার। দেশ-বিদেশে নিয়মিত খেলতে যান জিয়া। সঙ্গে নিয়ে যান ছেলেকে। এভাবে বাবা-মায়ের খেলা দেখতে দেখতেই দাবা ভালো লেগে যায় তাহসিনের। এখন তো খেলাটা রক্তের সঙ্গেই মিশে গেছে।

সাবরিনার সঙ্গে ছেলে রওনক। বাবা-মার মতো সেও নিজেকে শুটার হিসেবে গড়ে তুলছে। ছবি: প্রথম আলো
সাবরিনার সঙ্গে ছেলে রওনক। বাবা-মার মতো সেও নিজেকে শুটার হিসেবে গড়ে তুলছে। ছবি: প্রথম আলো

উদাহরণ গড়তেই রওনককে শুটিংয়ে আনা সাবরিনার
ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলো ছড়িয়েছেন শুটার দম্পতি সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকি ও সাবরিনা সুলতানা। ঢাকায় ১৯৯৩ এসএ গেমসে এয়ার রাইফেলে সোনা জেতেন রিংকি। সাবরিনা এসএ গেমস, সাফ শুটিং, কমনওয়েলথ শুটিং মিলিয়ে জিতেছেন ৯টি সোনা। এই দম্পতির বড় ছেলে রওনক চৌধুরী এরই মধ্যে শুটিংয়ে হাত পাকিয়েছে। যুব গেমসে জিতেছে রুপা, জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ। বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে রাজধানীর সী ব্রি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ১৫ বছর বয়সী ছেলের মধ্যে সম্ভাবনা দেখেন মা সাবরিনা, ‘ওর শুটিংয়ের বেসিক জ্ঞান অসম্ভব ভালো। নিয়মিত অনুশীলন করলে অনেক ভালো করবে।’ ছেলেকে একরকম জিদ করেই শুটিংয়ে এনেছেন, ‘আমার বাবা আমাকে শুটিংয়ে এনেছিলেন। কিন্তু আমার ছেলে ফুটবল ভালো বাসতো। আর আমি চেয়েছি ও শুটার হোক। কারণ এই দেশে যারা খেলোয়াড় তাদের বেশির ভাগই সন্তানদের সেই খেলায় দিতে চান না। কিন্তু আমি একটা উদাহরণ তৈরি করতে চেয়েছি।’

ছেলে সুফিয়ানকে নিয়ে গর্ব করেন টিটি তারকা সোমা। ছবি: প্রথম আলো
ছেলে সুফিয়ানকে নিয়ে গর্ব করেন টিটি তারকা সোমা। ছবি: প্রথম আলো

সুফিয়ানকে নিয়ে গর্বিত টিটির চ্যাম্পিয়ন সোমা
পল্লীমা সংসদ আন্তঃস্কুল টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে যেদিন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আবু সুফিয়ান, সামনে দাঁড়িয়ে সেটা দেখতে পারেননি সোনাম সুলতানা সোমা। পাঁচ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সোমা ওই দিন খবরটা শুনেই কেঁদে ফেলেছিলেন। নিজের ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে অসংখ্যবার বিজয়মঞ্চে উঠেছেন, কিন্তু ছেলের সাফল্যে এতটা আনন্দ জানা ছিল না সোমার, ‘আমি অনেক জিতেছি। অনেক পদক পেয়েছি। কিন্তু ও যেদিন প্রথম চ্যাম্পিয়ন হলো সেদিনের মতো এত আনন্দ কোনো দিন পাইনি। এ অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না।’ নড়াইলে বাড়ি, জাতীয় দলের ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজাকে মামা ডাকেন। মাশরাফির মতোই ক্রিকেটার হতে চাইতো সুফিয়ান। কিন্তু বাড়িতে বাবা মোহাম্মদ আলী এবং মায়ের অনুশীলন দেখে খেলাটা ভালো লাগে। এরপর নিয়মিত খেলছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। ছেলে একদিন জাতীয় দলে খেলবে, দেশের হয়ে জিতবে এসএ গেমসে সোনা—সোমার চাওয়া এখন এটাই, ‘আমাদের বাসায় খেলার সব সরঞ্জাম আছে। একটা রোবট আছে খেলার জন্য। ওর সঙ্গে অনুশীলন করে সুফিয়ান। আমি স্বপ্ন দেখি ছেলে জাতীয় দলে খেলবে, এসএ গেমসে সোনা জিতবে।’

শিমুলকে ঘিরেই যত স্বপ্ন সাইক্লিস্ট শিলার। ছবি: প্রথম আলো
শিমুলকে ঘিরেই যত স্বপ্ন সাইক্লিস্ট শিলার। ছবি: প্রথম আলো

শিমুলকে ঘিরেই যত স্বপ্ন সাইক্লিস্ট শিলার
দিনটা আজও মনে আছে সাইক্লিস্ট ফারহানা সুলতানা শিলার। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ মায়ের পাশাপাশি সাইকেলে প্যাডেল চালিয়েছিলেন ছেলে শিমুল মোল্লা। সেবার বিজেএমসির হয়ে খেলে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন শিলা। আর শিমুল সেনাবাহিনীর হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরই মধ্যে স্বাধীনতা কাপে ১টি রুপা ও ১টি ব্রোঞ্জ জিতেছেন শিমুল। আর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছেন ১টা রুপা ও ৩টা ব্রোঞ্জ। শিলার অর্জন অনেক। ২২ বছরের ক্যারিয়ারে বিভিন্ন ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় জিতেছেন ৮০টি সোনার পদক। এশিয়ান আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপে জিতেছেন ২টি রুপা ও ২টি ব্রোঞ্জ। এশিয়ান ট্র্যাক অ্যান্ড সাইক্লিংয়ে ১টি রুপা ও ১টি ব্রোঞ্জ জিতেছেন। অবসরের পর সেনাবাহিনীর সাইক্লিং দলের কোচ হিসেবে যোগ দেন। তখন থেকেই ছেলেকে সাইক্লিস্ট হিসেবে গড়ে তোলেন। খেলার সুবাদে ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়েছে। এখন ছেলের মাঝেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন শিলা।