তামিম একাই ৯১ জনের পাশে

করোনাভাইরাসের দুঃসময়ে দেশের ৯১ জন খেলোয়াড়কে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন ক্রিকেটার তামিম ইকবাল। ছবি: প্রথম আলো
করোনাভাইরাসের দুঃসময়ে দেশের ৯১ জন খেলোয়াড়কে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন ক্রিকেটার তামিম ইকবাল। ছবি: প্রথম আলো

দলের বিপদে বাইশ গজে কখনো একাই লড়তে হয় তামিম ইকবালকে। বিপদের মুহূর্তে দলকে একাই টেনে নিয়ে যান নিরাপদ জায়গায়। দেশের বিপদেও সেভাবেই এগিয়ে এলেন বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক। করোনাভাইরাসের দুঃসময়ে অসহায় হয়ে পড়া খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন বাঁ হাতি ওপেনার। সেই খেলোয়াড়রা শুধু ক্রিকেটেরই নন; ফুটবলার, হকি খেলায়াড়, সাঁতারু, ভারোত্তোলক, জিমন্যাস্ট, কারা নেই তামিমের তালিকায়? খুঁজে খুঁজে গত ৩ থেকে ৪ দিনে দেশের ৯১ জন অসহায়-অসচ্ছল খেলোয়াড়দের আর্থিক সহায়তা করেছেন তামিম। বিকাশের মাধ্যমে যাঁর যেমন প্রয়োজন, পাঠিয়ে দিয়েছেন টাকা।

করোনাভাইরাসের শুরু থেকেই দুস্থদের জন্য তামিম কিছু না কিছু করছেন। জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনাজয়ী সামিউল ইসলামকে আর্থিক সহায়তা করেছেন। সতীর্থ ক্রিকেটার নাজমুল ইসলাম অপু যখন নারায়ণগঞ্জে দুস্থদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, সেখানেও এগিয়ে আসেন তামিম। মোহাম্মদপুরের স্বেচ্ছাসেবী নাফিসা আনজুম অসহায় মানুষের ফোন পেলেই খাবার ও সাহায্য নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন মানুষের দরজায়। প্রথম আলোয় সেই খবর পড়ে তামিম এগিয়ে যান নাফিসার সাহায্যেও।

কিন্তু তামিম ভাবলেন, শুধু অন্যদের উদ্যোগে শামিল হওয়াই যথেষ্ট নয় এই দুঃসময়ে। তাঁর নিজেরও বড় কিছু করা উচিত। পরিচিত খেলোয়াড়, কোচ, সাংবাদিক ও ক্রীড়াঙ্গনে থাকা বন্ধু এবং পরিচিতজনদের কাছে খোঁজ নিতে থাকেন কাদের সাহায্য প্রয়োজন। করোনা আক্রান্ত সময়টায় কাদের দিন কষ্টে কাটছে। সেভাবেই নাম সংগ্রহ করেন সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন খেলার ৯১ জন সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়ের। তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেন এসএ গেমসে সোনাজয়ী সাঁতারু মাহফুজা খাতুন, জাতীয় ফুটবল দলের স্ট্রাইকার তৌহিদুল আলম সবুজ, ক্রিকেটার মিজানুর রহমান, কোচ হুমায়ুন কবির শাহীনসহ অনেকে।

তামিমের উদ্যোগের প্রশংসা করতে গিয়ে মুঠোফোনে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলছিলেন মাহফুজা, ‘তামিম ভাই এটা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। তবে আড়ালে থাকা বিষয়গুলো কিছু কিছু সময় বাইরে আসা উচিত। অন্যরা এতে উৎসাহিত হবে। তামিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। তবে আমার এক ক্রিকেটার বন্ধু ফোন দিয়ে বিষয়টা জানায়। সে বলল, তামিম ভাই ক্রিকেট ছাড়াও অন্য খেলোয়াড়দের সাহায্য করতে চান।’

বাংলাদেশ অ্যাথলেট কমিশনের সদস্য হওয়ার সুবাদে মাহফুজাকে বিভিন্ন সময়ে অসহায় ও বিপদগ্রস্ত খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করতে হয়। তাঁর জন্য অসচ্ছল খেলোয়াড়দের নাম পাঠানোটা তাই কঠিন হয়নি। ‘২০০৩ সাল থেকে খেলাধুলা করছি। কিন্তু এর আগে এভাবে বড় খেলার কোনো খেলোয়াড়কে ছোট খেলার খেলোয়াড়দের সাহায্য করতে দেখিনি’, বলছিলেন আবেগাপ্লুত মাহফুজা।

বসুন্ধরা কিংসের স্ট্রাইকার তৌহিদুল আলম সবুজ বলছিলেন, প্রস্তাবটা শুনেই তামিমকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন তিনি, ‘আমি প্রথম খবরটা শুনি আমার বিকেএসপির বন্ধু হুমায়ুন কবিরের কাছে। ও তামিমের সহকারী কোচ।’ তামিমের উদ্যোগ নিয়ে সবুজ বলছিলেন, ‘আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি এক গেমসের খেলোয়াড় আরেক গেমসের খেলোয়াড়দের সাহায্য করছে। আবার নিজের নাম গোপন রাখতে চাইছে। বড় মনের মানুষ ছাড়া এগুলো করা যায় না।’

তামিমের সহযোগিতা পেয়ে অনেকেই আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। ঘরে বসেই তামিমের সাহায্য পেয়েছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক হকি খেলোয়াড় বলছিলেন, ‘আমার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে সাহরি ও ইফতারি কেনার কোনো টাকা ছিল না। তামিম ভাইয়ের এই উপকারের কথা কোনো দিন ভুলতে পারব না।’

সর্বশেষ জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে সাতটি সোনা জিতে সেরা সাঁতারু হন অ্যানি খাতুন। তামিমের দেওয়া টাকা পেয়ে অ্যানি বলছিলেন, ‘আমার বাবা নেই। দুই ভাই ছোট। কেউ কাজ করতে পারে না। খেলাধুলা করে কিছু টাকা পেতাম। এখন খেলা বন্ধ। আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। তামিম ভাইয়ের সাহায্য পেয়ে অনেক উপকার হয়েছে।’ বাংলাদেশ গেমসে সোনাজয়ী উশু খেলোয়াড় রাজিয়া সুলতানাও খুশি তামিমের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত সহায়তা পেয়ে, ‘আমাকে একজন টাকা পাঠিয়ে বলেছে, এটা তামিম ভাইয়ের পক্ষ থেকে উপহার। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। তামিম ভাইকে ধন্যবাদ।’

সাঁতারু নাঈম সর্দারের এক ভাই রিকশা চালান। আরেক ভাই গ্রামের মসজিদের ইমাম। অভাবের সংসারে তামিমের হঠাৎ সহায়তায় আবেগাপ্লুত নাঈম, ‘এই দুর্দিনে এমন সহযোগিতা আমাদের জন্য বিশাল কিছু। আমি তো টাকা পেয়ে কেঁদেই ফেলেছিলাম।’

তামিম চাননি, তাঁর এই উদ্যোগের কথা জানাজানি হোক। এমনকি কাদের সাহায্য পাঠিয়েছেন, কাকে কত টাকা দিয়েছেন, গোপন রাখতে চেয়েছেন সেসবও। এ নিয়ে তাই কোনো মন্তব্যও করতে রাজি হননি। কিন্তু যাঁরা সাহায্য পেয়েছেন, তাঁদের অনেকে নিজেরাই বলছেন তামিমের এই উদারতার কথা। এক হকি খেলোয়াড়ের কথা, ‘আমি কষ্টে আছি, তবু আজ পর্যন্ত হকির কেউ আমার জন্য এগিয়ে আসেনি। তামিম ঠিকই এগিয়ে এলেন। তাহলে কেন বলব না তাঁর কথা!’