'হাতের ঘামে লবণের কাজ হয়ে যেত'

তামিম ইকবালের সুবাদে কাল অতীতের স্বাদ পেয়েছেন ভক্তরা। ফাইল ছবি
তামিম ইকবালের সুবাদে কাল অতীতের স্বাদ পেয়েছেন ভক্তরা। ফাইল ছবি
গতকাল রাতে তামিম ইকবালের লাইভে এসে যেন টাইম মেশিনে করে ৯০'র দশকে ফিরে গিয়েছেন তিন সাবেক অধিনায়ক।

বাংলাদেশ ক্রিকেট কী ছিল আর কী হয়েছে! গতকাল তামিম ইকবালের ফেসবুক লাইভ শেষে দর্শকরা হয়তো এমন কিছুই ভাবছিলেন। ওয়ানডে অধিনায়ক তামিমের সঙ্গে গতকাল লাইভে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের তিন টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান, খালেদ মাহমুদ ও হাবিবুল বাশার। একই সঙ্গে জাতীয় দলে খেলেছেন। ক্রিকেট বোর্ডেও আছেন বিভিন্ন পদে। তাদের আড্ডায় উঠে আসে ৯০ দশক ও ২০০০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের চিত্র। তামিমের সঞ্চালনায় সাবেক তিন ক্রিকেটারই স্মৃতির পাতা খুলে বসেন। এক ঘন্টার জন্য সবাই যেন টাইম মেশিনে করে ২০ বছর পেছনে চলে গেলেন।

আজকাল প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন করে কম্পিউটার বিশ্লেষক থাকে। বিশ্বের যে কোন ক্রিকেটারের নাম স্কিনে ভাসতেই তাঁর শক্তি, দুর্বলতা চোখের সামনে এসে যায়। প্রতিপক্ষ দলের ক্রিকেটারের শক্তি-দুর্বলতা বুঝে পরিকল্পনা সাজানো হয়। বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের অধিনায়ক নাইমুর প্রতিপক্ষদের শক্তি-দুর্বলতার তথ্য বের করতেন একরকম গোয়েন্দাগিরি করে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলতে আসা বিদেশি ক্রিকেটারদের কাছ থেকে অন্য দেশের ক্রিকেটারদের বিভিন্ন তথ্য জেনে নিতেন। প্রচুর খেলা দেখতেন। টিভিতে খেলা দেখে শক্তি-দুর্বলতা বুঝার চেষ্টা করতেন।

তামিমের এক প্রশ্নের জবাবে নাইমুর বলছিলেন, '১৯৯৫ সালের এশিয়া কাপ আমার অভিষেক। তখন তো ফিজিওই ছিল না, কম্পিউটার বিশ্লেষক তো চিন্তাই করা যায় না। বিপক্ষ দলে কে কেমন খেলে এই তথ্য আমরা পেতাম প্রিমিয়ার লিগ খেলতে আসা বিদেশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলে। তখন জয়সুরিয়া, রাঙ্গাতুঙ্গা, ওয়াসিম আকরাম, রমন লাম্বারা ঢাকা লিগ খেলত। আর খেলা দেখতাম। এসবই ছিল তথ্যের মূল উৎস।'

নাইমুলের কথার ফাঁকেই হাবিবুল জানালেন আরেক মজার তথ্য। ১৯৯৫ এশিয়া কাপে ভারতীর বোলারদের কীভাবে খেলতে হবে জানার জন্য সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার অরুণ লালকে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কোচের একটি বিশাল বহর থাকে। নাইমুরের কথার সুর ধরেই আরেক অধিনায়ক জানালেন, আগে নাকি এক গর্ডন গ্রিনিজই সব কোচ ছিলেন, 'জাতীয় দলে ১০-১২ জনের একটা কোচিং স্টাফ থাকে। আগে আমাদের এক গর্ডন গ্রিনিজই ছিলেন সব। ট্রেনার, ফিজিও কিছুই ছিল না।'

অনুশীলনের সুবিধাও ছিল অপ্রতুল। সপ্তাহে নাকি ৩ দিন ব্যাটিং করার সুযোগ হতো লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের। অনুশীলন সুবিধার স্বল্পতার কারণে শুধু উপরের সারির ব্যাটসম্যানরাই নাকি ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেতেন। মাহমুদ মুখে চওড়া হাসি টেনে বলছিলেন, 'আগের অনুশীলনের সুবিধা আর এখনকার অনুশীলনের সুবিধায় অনেক ফারাক। আমরা তিনদিনে একবার ব্যাট করার সুযোগ পেতাম। ক্লাব ক্রিকেটে বল থাকত না, অনুশীলন হতো না।'

ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাবিবুলকে ক্রিকেট খেলতে এসে খাওয়ার কষ্ট পেতে হয়েছে, 'শুরুটা আমারও এমনই ছিল। ছোট শহর থেকে এসেছিলাম নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট খেলে। বাসাবোতে ছোট বাসায় থাকতাম। টেম্পুতে করে অনুশীলনে আসতাম। খাওয়ার সমস্যা হতো অনেক।' বিদেশ সফরে দৈনিক ভাতাও ছিল অল্প। এক বেলা ফাস্ট ফুড ছাড়া ভালো কিছু খাওয়া কপালে জুটত না। বাংলাদেশের প্রথম নিউজিল্যান্ডের গল্প করতে গিয়ে হাবিবুল বলেন, 'প্রথম নিউজিল্যান্ড সফরে দৈনিক ভাতা ছিল ৭ ডলার। ভাত খেতে ইচ্ছে করত। খেতে পারতাম না কারণ টাকা ছিল না। ম্যাকডোনাল্ডস খেয়ে থাকতাম। "পেটে বালিশ" কথাটা খুব চালু ছিল তখন।' নাইমুর ও মাহমুদও তখনকার নামমাত্র দৈনিক ভাতা নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন।

এখনকার ক্রিকেটার নানা ধরনের এনার্জি ড্রিং পান করেন। তখন নাকি লেবুর পানিতে চিনি মিশিয়েই তৈরি হতো ক্রিকেটারদের পানীয়। নাইমুর হাসতে হাসতেই বলছিলেন, 'তামিম, তোমরা তো অনেক ধরনের এনার্জি ড্রিং নষ্টও কর। আমাদের সময় এনার্জি ড্রিংয়ের গল্প শোন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মোটামুটি পরিস্কার একটা বাথরুম ছিল। সেখান থেকে পানি আনত। বাজার থেকে লেবু আর চিনি আনত। এই দুইটা হাত দিয়ে গুলিয়ে নিত। লবন দিত না। কারণ হাতের ঘামে তো লবনের কাজ হয়ে যেত। আমাদের পেটও খারাপ হতো না।'

তামিমের চাচা আকরাম খানের গল্পও চলে আসে নাইমুরের গল্পে। ১৯৯৫ সালের এশিয়া কাপে নাকি স্লো ওভার রেটের কারণে পাকিস্তানি অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম ও বাংলাদেশ অধিনায়ক আকরাম খানকে ডেকে পাঠান ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড। দুই অধিনায়ককেই ম্যাচ ফি'র ৩০ ভাগ জরিমানা করা হয়। আকরাম খান নাকি লয়েডকে বলেছিলেন, 'তুমি চাইলে ১০০ ভাগ জরিমানা করতে পার। কারণ আমাদের কোন ম্যাচ ফি নেই।'

তখন বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা এক ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের দিকেই চেয়ে থাকত। যা পারিশ্রমিক আসত ওই ঢাকা লিগ খেলেই আসত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হতো কালেভদ্রে। কখনো কখনো প্রিমিয়ার লিগ খেলেও পারিশ্রমিক মিলত না। তবে ক্লাব ক্রিকেটের উন্মাদনা ছিল অদ্বিতীয়। দল বদলের সময় নাকি তারকা ক্রিকেটারদের অপহরণ করা হতো। দল বদল শেষ হলে তবেই বাড়ি ফেরা হতো নাইমুরদের।

সময়ের সঙ্গে সব বদলেছে। আবেগ জায়গা ছেড়ে দিয়েছে পেশাদারিত্বের জন্য। ক্রিকেটে এসেছে চাকচিক্য ও অর্থকড়ি। দুই দশক আগে এসব কিছুই ছিল না। তবু প্রচণ্ড আবেগের কারণে খেলা চালিয়ে গেছেন ক্রিকেটাররা। নাইমুর-মাহমুদদের আগের প্রজন্মকে লড়তে হয়েছে আরও বড় লড়াই। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন ৭০-৮০'র দশকের ক্রিকেটাররা। কাল তামিমের লাইভে সেই যুগের ক্রিকেটারদেরও স্মরণ করেছে তিন সাবেক ক্রিকেটার। মাহমুদ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলছিলেন, 'আমাদের আগে যারা ক্রিকেট খেলেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা সবসময় থাকবে। উনারা তো নিজেদের পয়সায় ক্রিকেট খেলেছে। উনারা '৭১ এর পর ক্রিকেট খেলেছেন বলেই আমরা এসেছি। আজ তোমরা এসেছ। কদিন আগে অনূর্ধ্ব-১৯ দল বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ দলও একদিন চ্যাম্পিয়ন হবে। এটাই নিয়ম।'