তিন খেলার তিন অধিনায়ক এক রুমে থাকতাম

>আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাস-আক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। এক অণুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এই সময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলে দিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো
মাহবুব হারুন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
মাহবুব হারুন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

কিছুদিন আগেও ছিলাম প্রচণ্ড ব্যস্ত। অথচ এখন সময় কাটছে শুয়ে-বসে! আমি একটা করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। করোনাভাইরাসের এমন পরিস্থিতিতেও সপ্তাহে দুদিন অফিসে যেতে হয়। বাকি দিনগুলোয় বাড়িতে বসে টিভি দেখে সময় কাটাই। দুই ছেলের সঙ্গে আড্ডা দিই। কখনো ওরা কম্পিউটারে গেমস খেলে, আমি হয়ে যাই ওদের একমাত্র দর্শক।

কে জানত এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে বিশ্ব, এভাবে থমকে যাবে সব? কোথাও খেলাধুলা নেই। আমরা মাঠের মানুষ, ঘরে বসে এসব দেখতে একটুও ভালো লাগে না। সময় পেলেই অ্যালবামের পাতা উল্টে পুরোনো ছবি দেখি। সে দিন হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল। আমি আর মুন্না ভাই (প্রয়াত ফুটবলার মোনেম মুন্না) আবাহনী ক্লাবে গল্প করছি।


করোনাভাইরাসের কারণে অসহায় হয়ে পড়া মানুষকে সহযোগিতা করতে ভাবি (ইয়াসমিন মোনেম সুরভী) মুন্না ভাইয়ের জার্সিটা নিলামে তুলেছেন। এই জার্সির ছবি দেখে কত কথা মনে পড়ে গেল! আবাহনী ক্লাবে আমি ছিলাম মুন্না ভাইয়ের রুমমেট। আমাদের রুমে থাকতেন আরও একজন—ক্রিকেটার আকরাম খান। তখন মুন্না ভাই ফুটবলের জাতীয় দলের অধিনায়ক। আমি হকি দলের অধিনায়ক। আর ক্রিকেটের অধিনায়ক আকরাম ভাই। তিন খেলার তিন অধিনায়ক এক রুমে থাকতাম। কি যে অসাধারণ দিন ছিল! এখন তো এসব ভাবাই যায় না।


ধানমন্ডি আবাহনী ক্লাবের নিচতলার ৬ নম্বর কক্ষটা ছিল আমাদের। মুন্না ভাই বিদেশ থেকে আসার সময় প্রচুর চকলেট আনতেন। মুন্না ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। আমাকে তাই অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই ভালোবাসতেন।

আবাহনীর যেদিন ফুটবল ম্যাচ থাকত আগের দিন সন্ধ্যায় মুন্না ভাই বলতেন, ‘চল, নারায়ণগঞ্জ যাব।’ আমরা দুজন তাঁর বাড়ি যেতাম। উনি মা-বাবাকে সালাম করে দোয়া নিয়ে আসতেন। এই দুর্দিনে শুধু মুন্না ভাই নয়, রহমত ভাই (হকি ফেডারেশনের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক খাজা রহমত উল্লাহ), জুম্মন ভাই (প্রয়াত হকি খেলোয়াড় জুম্মন লুসাই), পুশকিন ভাই (প্রয়াত হকি খেলোয়াড় জাহিদুর রহমান পুশকিন) সবার কথাই ভীষণ মনে পড়ে।


মাঝে মাঝে টিভিতে পুরোনো খেলার হাইলাইটস দেখি। খেলা দেখতে দেখতে ফিরে যাই মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে। হকি মাঠের কত স্মৃতি! ক্রীড়া সাংবাদিক দিলু ভাই (দিলু খন্দকার) আমাকে বলতেন, ‘তুমি বাংলার শাহবাজ।’


পাকিস্তানের সাবেক হকি তারকা শাহবাজ আহমেদ তখন মোহামেডানে নিয়মিত খেলেন। আমরা আবাহনীতে। মিডিয়ায় আমাকে শাহবাজের সঙ্গে তুলনা করতে দেখলে ভীষণ গর্ব হতো। মাঠে শাহবাজের বিপক্ষে যতই লড়াই হোক না কেন, ম্যাচ শেষে আমরা ছিলাম বন্ধু। শুধু শাহবাজ নয়, ভারতের হকি তারকা ধনরাজ পিল্লাইও আমার কাছের বন্ধু।


২০১২ সালের একটা ঘটনা। আমি তখন জাতীয় দলের কোচ। দিল্লি গেলাম দল নিয়ে। সেখানে দেখা হলো পিল্লাইয়ের সঙ্গে। এই প্রজন্মের অনেক খেলোয়াড়ই পিল্লাইকে আদর্শ মানে। ও তখন এয়ার ইন্ডিয়ার ম্যানেজার। আমাকে দেখে পিল্লাই বুকে জড়িয়ে ধরল। ছেলেরা আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব দেখে অবাক। আবাহনীতে খেলার সময় পিল্লাই বেশির ভাগ সময় আমার সঙ্গে থাকত। উপমহাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হতেই ওর খোঁজ নিয়েছি। এখনো নিয়মিত ফোনে কথা হয় আমাদের।


করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, বোঝা মুশকিল। আমার মনে হয় করোনা-পরবর্তী সময়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে সৌজন্য করমর্দন করতে চাইবে না। হারিয়ে যাবে প্রাণখোলা আড্ডা। আমাদের মতো আড্ডাবাজ লোকের জন্য এসব মানা খুব কঠিন। এখন সবাই বাড়িতে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করছি। যাঁরা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন, তাঁদের উচিত সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করা। জরুরি দরকার ছাড়া বাইরে বের না হওয়াই ভালো।


পৃথিবীতে মহামারি আগেও এসেছে। প্লেগ, কলেরায়ও কম মানুষ মারা যায়নি। আবার এসব দুর্যোগ মানুষ কাটিয়েও উঠেছে। আমাদের এই অন্ধকার সময়ও একদিন নিশ্চয়ই দূর হবে।